হঠাৎ এক অন্য রকম ভ্রমণ

হঠাৎ কোথাও আকস্মিক রওনা দেওয়া আমার অভ্যাস, তা–ও প্ল্যান ছাড়া। হোক না সে পথ দূরের বা কাছের। সোমবার, ছেলে জনাথান টেনিস ট্যুরে তিউনিসিয়াতে। মেয়ে জেসিকা দুই দিনের অফিশিয়াল কাজে প্যারিসে এবং আমার স্ত্রী মারিয়া অফিসে, আমি আমার নিজের জগতে।

বড় ভাই ভিজিটিং প্রফেসর হিসেবে সপ্তাহ ধরে বেশ কিছু পিএইচডি শিক্ষার্থীকে শিক্ষা প্রদানে গিয়েছেন ইতালির পিসা বিশ্ববিদ্যালয়ে। আমাকে সকালে ফোন করে বললেন এবারে পিসা বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি শিক্ষার্থীদের প্রশিক্ষণে আমরা অ্যাপ্লাই করছি লার্নিং ফ্রম লার্নার এবং লার্নিং বাই ডুইং কনসেপ্ট। আমি ডেমোন্সট্রেট করতে চাই কি না জানতে চাইলেন। ভাবলাম, তা করা যেতে পারে। ব্যস আর দেরি নয়, ঝটপট করে টিকিট কিনতেই একটু জটিলতা দেখা দিল। সরাসরি কোনো ফ্লাইট নাই। কী করি?

ভাবলাম একটু ভিন্ন ধরনের জার্নি হোক তাহলে। সে আবার কী? কথায় বলে এক গুলিতে ছয় বাঘ, তেমনটি হলো। মারিয়া কাজ থেকে বাসাতে আসতেই বললাম, আমি আজই বাড়ি ছাড়ছি, ফিরব বৃহস্পতিবার। মারিয়া বলল, তোমার বন্ধু আসবে লন্ডন থেকে আর তুমি বাড়ি ছাড়বে, সেকি? বললাম, তারা আসবে শুক্রবার, আমি ফিরব বৃহস্পতিবার রাতে। স্টকহোম বিমানবন্দরের উদ্দেশে রওনা দিয়েছি।

বিমানবন্দরে বাসে বসে ছোট ভাই শাহীনকে ফোনে বললাম, ডিনারের ব্যবস্থা কর, আমি আসছি। ছোট মাছ যেন থাকে। তার স্ত্রী রান্না করে ভালো। ও একটু অবাক হলো প্রথমে। তবে জানে, এমন ধরনের ঘটনা আমি ঘটিয়ে থাকি, তাই বিষয়টি তার জন্য নতুন কিছু নয়। তা ছাড়া সন্ধ্যায় সবাই বাসাতে থাকবে, তার পরিবারের সবার সঙ্গে দেখা হবে। ল্যান্ড করলাম লন্ডন গ্যাটউইকে। পরে ট্রেনে করে এলাম লন্ডন ভিক্টোরিয়া ট্রেন স্টেশনে এবং শাহিনের সঙ্গে দেখা হলো ভিক্টোরিয়া স্টেশনে।

একসঙ্গে তার বাড়িতে পৌঁছাতে একটু দেরি হয়ে গেল। শাহিনের ছেলে-মেয়ে ঘুমিয়ে গেছে। বাড়িতে ঢুকে ডিনার শেষে কথাবার্তা সেরে ঘুমাতে গেলাম। সকালে ঘুম থেকে উঠে সবার সঙ্গে দেখা করে সকালের নাশতা সেরে ওরা স্কুল এবং কাজে রওনা দিল; আমিও চলে গেলাম বিমানবন্দরে। চেকিং পর্ব শেষে ঢুকে গেলাম প্লেনে, ইতালির পিসার উদ্দেশ্যে।

ছিটে বসতেই পাশে এক ছেলে এসে হাজির। বেশ ফিটফাট এবং স্মার্ট। সাজিয়ে–গুছিয়ে কথা বলতেই তার ভাবভঙ্গিতে কিছুটা অস্বাভাবিক মনে হলো। ছেলেটি নিজে থেকেই তার পরিচয় দিয়ে জানিয়ে দিল যে সে সমকামী। সে দেদার আমাকে অবাক করতে শুরু করল। সে বলে, আমি এই প্রথম বিয়ের পর স্বামী ছাড়া ট্রাভেল করছি। স্বামী? পরে জানলাম সমকামীদের মধ্যেও স্বামী-স্ত্রী রয়েছে। তার কথাবার্তা, ভাবভঙ্গি, সবকিছুতেই মেয়েলি ভাব রয়েছে, শুধু চেহারা ছাড়া। কেন যেন মনে হলো সুযোগ যখন হয়েছে, দেখি কত দূর কী জানা যায়। প্রশ্ন করতেই সব বলতে শুরু করল কোনো রকম জড়তা ছাড়া। বয়স ২২ বছর। নাম রেন্টাল। পেশায় ফটো মডেল।

যাচ্ছে ইতালির একটি শহর মিলানোতে। জন্মসূত্রে সে নিকারাগুয়ান। বাবা আমেরিকান। ১৪ বছর বয়সে তার মা অন্তঃসত্ত্বা হন। বাবা তার মাকে ছেড়ে নিরুদ্দেশ। মা তাকে নিয়ে মুভ করেন মাইয়ামিতে। রেন্টালের বয়স ৮ বছর হতেই তার মা এক ধনী ইতালিয়ানকে বিয়ে করে পাড়ি জমান ইতালিতে। রেন্টাল প্রথম থেকে জানত যে সে সমকামী। তবু সে চেষ্টা করেছে অন্য ছেলেদের মতো চলাফেরা করতে। কিন্তু তার কথায় সে তার জন্মের শুরুতেই সমকামী, যা তার মা জানতে পারে রেন্টালের বয়স যখন ১৮ বছর। রেন্টাল ইতালির হাইস্কুল শেষে লন্ডনে পড়াশোনা করতে ইংল্যান্ডের ব্রাইটনে মুভ করে। পরে সেই কলেজের এক শিক্ষকের প্রেমে পড়ে। ২০ বছর বয়সে বিয়ে করে সে কলেজের এক ইংলিশ শিক্ষক টমাসকে। দুই বছর হলো তারা স্বামী-স্ত্রী হিসেবে বসবাস করছে ব্রাইটনে।

গল্প শেষ না হতেই ল্যান্ড করলাম পিসাতে। রেন্টাল বিদায় নিয়ে চলে গেল মিলানোর পথে। আর আমি ট্যাক্সি নিয়ে হোটেল বোলোনিয়াতে আসতে, আমার ভাবনায় এসেছিল রেন্টাল এবং তার জীবনের কথা। তার কথায় মনে হলো, সে তার জীবনের ভ্যালু খুঁজে পেয়েছে। তার সমাজে সে স্বীকৃতি পেয়েছে। কী অবস্থা তাদের, যাদের সমাজে এমনটি ভাবনাতেও নেই যে তারা সমাজে সমকামী হিসেবে স্বীকৃতি পেতে পারে, বিয়ে তো পরের কথা? এবং রয়েছে নিশ্চিত হাজারো রেন্টাল পৃথিবীর অনেক দেশে!

যা–ই হোক, আমি হোটেলে এসে ফ্রেশ হয়ে ডিনারের জন্য চলে এলাম লবিতে। সেখানে দেখা হলো বড় ভাই মান্নান মৃধা এবং তার সহকর্মীদের সঙ্গে। আলোচনার শুরুতে জানতে পারলাম তাদের যৌথ প্রশিক্ষণের বর্ণনা। ১২টি দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের সমন্বয়ে তাদের এ ইইউ প্রজেক্ট। দেশগুলোর মধ্যে রয়েছে সুইডেন, স্পেন, ইতালি, পর্তুগাল, এস্তোনিয়াসহ আরও কয়েকটি এবং প্রশিক্ষণের মূল লক্ষ্য, লার্নিং ফ্রম লার্নার, লার্নিং বাই ডুইং অ্যান্ড লার্নিং ফ্রম ইচ আদার।

এবারের কোর্সে রয়েছে ২০ জন পিএইচডি শিক্ষার্থী। এদের সবার সেশনে রয়েছে থিওরি এবং লাঞ্চের পরে রয়েছে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর সমন্বয়ে ডেমোনেস্ট্রেশন। এদের শিক্ষায় রয়েছে গ্লোবালাইজেশন এবং একে অপরের থেকে জানা ও শেখার সমন্বয়। বর্তমান গ্লোবাল বিশ্বে চাকরির ক্ষেত্রে এ ধরনের চাহিদা রয়েছে বিধায় ইইউ এ ফান্ডিংয়ের ব্যবস্থা করেছে।

সব শুনে মনে হলো, সাধারণ শিক্ষাপ্রাপ্ত শিক্ষার্থীরা কি এদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে পারবে? সম্ভব হবে কি ইইউর টপ জবগুলো পাওয়া? যা-ই হোক, আমার শিক্ষার ওপর লেখার কনসেপ্টের সঙ্গে হুবহু মিলের কারণে সন্ধ্যাটি ছিল মনোমুগ্ধকর। বেশ রাত হয়ে গেল সবাই সকালে ব্যস্ত হয়ে পড়বে, তাই চলে এলাম হোটেলে এবং বেশ টানা একটি ঘুম দিতে অ্যালার্ম বেজে উঠল। সকালে ব্রেকফাস্ট সেরে মান্নান ভাইয়ের সঙ্গে বেরিয়ে পড়লাম ঠিকই, তবে দুজনে দুই ভিন্ন জায়গাতে।

মান্নান ভাই গেলেন তাঁর বিশ্ববিদ্যালয়ে আর আমি গেলাম পিসা ট্যুরে। আরনো নদীর পাড় দিয়ে চলে গেলাম লিনিং টাওয়ার দেখতে। পরে বেশ খোঁজাখুঁজির পর পেলাম দেখা গ্যালিলিওর স্টুডিও। বিশ্বখ্যাত বৈজ্ঞানিক গ্যালিলিও, যিনি আবিষ্কার করেছেন টেলিস্কোপ। লিনিং টাওয়ার থেকে এক্সপেরিমেন্ট করেছেন গ্রাভিটির ওপর। বলেছেন পৃথিবী সূর্যের চারদিকে ঘোরে। তিনি জন্মগ্রহণ এবং পড়াশোনা করেছেন এ পিসা শহরে। কীভাবে তাঁর শহর না দেখে ফিরে আসি সুইডেনে? সবকিছু শেষে সন্ধ্যায় দেখা হলো মান্নান ভাইয়ের সঙ্গে। প্রশিক্ষণের ওপর আলোচনার সঙ্গে ডিনার পর্ব শেষে ফিরে এলাম হোটেলে। ভোর পাঁচটায় ঘুম থেকে উঠে ট্যাক্সি করে পিসা বিমানবন্দর থেকে রওনা দিয়েছি সিসিলিয়া আইল্যান্ডের কাতানিয়া বিমানবন্দরের উদ্দেশ্যে। সিসিলিয়া, ইতালির অন্য একটি শহরে। দেড় ঘণ্টা পরে ল্যান্ড করলাম কাতানিয়া বিমানবন্দরে।

ল্যান্ড শেষে লাঞ্চ সেরে পরের ফ্লাইটে বার্লিন এবং প্রায় দুই ঘণ্টা পরে এসে হাজির হলাম স্টকহোম আরল্যান্ডা বিমানবন্দরে। বাড়িতে পৌঁছাতে আজ সারা দিন কেটে গেল। পাঠক, এবারের জার্নির মূল উদ্দেশ্য ছিল এ বিশেষায়িত শিক্ষা প্রশিক্ষণের কনসেপ্টের ওপর মূল্যায়ন করা, যা সত্যি ‘ক্রিয়েট সাম রিয়েল ভ্যালু’।
এবারের প্রশিক্ষণ গড়েছে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর মধ্যে সমন্বয় এবং সর্বোপরি গ্লোবাল সিঙ্ক্রোনাইজেশন, যা পিসা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা আনন্দের সঙ্গে উপলব্ধি করেছে।

অধ্যাপক মান্নান মৃধার দলের পরবর্তী গোলস অ্যান্ড অবজেক্টিভস হবে এ ইইউ প্রজেক্টের মাধ্যমে বিশেষায়িত শিক্ষা প্রশিক্ষণ চালু করা ইউরোপের এবং বিশ্বের অন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে, যাতে গোটা বিশ্বের বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে সুশিক্ষার সমন্বয় ঘটে। আজ এসব কথা লিখতে আমার ভাবনায় ঢুকেছে। কবে হবে এমনটি বাংলাদেশের শিক্ষা প্রশিক্ষণে?

যেখানে জানার জন্য হবে শেখা এবং সুশিক্ষাই হবে বাংলাকে সোনার বাংলা করার চাবিকাঠি! ১৭ কোটি মানুষের দেশ বাংলাদেশ। আর কত দিন দেখতে হবে বিশ্বের রাস্তাঘাটে কর্মরত ফেরিওয়ালা বাঙালি ভাইদের? যাদের ভালোবাসার সহধর্মিণী রয়েছে বাংলাদেশে। যাদের আদরের ছেলেমেয়ে রয়েছে বাংলাদেশে। আর এরা কর্মরত হয়ে বাস করছে দূর পরবাসে পৃথিবীর নানা প্রান্তে শুধু বেঁচে থাকার কারণে।

সব সমস্যার সমাধান দিতে পারে শুধু সঠিক এবং সুশিক্ষা। তাই আবারও জোর দিয়ে বলতে চাই প্রিয় দেশবাসীকে, বলতে চাই রাষ্ট্রকে-শাসনতন্ত্র নয়, দুর্নীতিমুক্ত গণতন্ত্র সঙ্গে, সু এবং সঠিক শিক্ষার সমন্বয়ে বাংলাকে গড়ে তোলা হোক সোনার বাংলায়, নিজের এবং দেশের স্বার্থে।

লেখক: রহমান মৃধা