ফোবানা সম্মেলন ২০২৫: আটলান্টায় প্রবাসী বাঙালির মহা উৎসব

‘দূর পরবাস’-এ জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]

আটলান্টার শহরতলি ডুলুথের গ্যাস সাউথ এরিনা কনভেনশন সেন্টারে আগস্ট মাসের শেষ সপ্তাহান্তে এক টুকরো বাংলাদেশে রূপ নিয়েছে। ২৯ থেকে ৩১ আগস্ট পর্যন্ত ফেডারেশন অব বাংলাদেশি অ্যাসোসিয়েশনস ইন নর্থ আমেরিকার (ফোবানা) তিন দিনব্যাপী সম্মেলন চলাকালে প্রবাসী বাঙালির প্রাণচাঞ্চল্যে, দেশজ সংস্কৃতির বর্ণাঢ্য আবহে মুখর ছিল এলাকাটি। যুক্তরাষ্ট্রের ২৪টি অঙ্গরাজ্য থেকে ৭৪টি সংগঠন, বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যালামনাই, সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক সংগঠন মিলিয়ে পনেরো হাজারের বেশি মানুষ যোগ দেন এবারের আয়োজনটিতে।

মূল মিলনায়তনের ধারণক্ষমতা ছিল মাত্র ১ হাজার ৪০০ আসনের, কিন্তু শনিবার রাতে সেখানে মানুষের ঢল নামায় আয়োজক কমিটিকে প্রবেশপথ বন্ধ করে দিতে হয়। বাইরে অপেক্ষমাণ অনেকেই প্রবেশের সুযোগ পাননি, তবু অনুষ্ঠানস্থলের ভেতর-বাইরে এক উৎসবমুখর পরিবেশ বিরাজ করেছে। আয়োজক সংগঠনের সহসভাপতি দিলু মওলা বলেন, ‘ফোবানা প্রবাসে বাঙালির সবচেয়ে বড় মিলনমেলা। এবারের আয়োজন আমাদের প্রত্যাশার চেয়েও বেশি সফল হয়েছে। মানুষের সাড়া ছিল অভূতপূর্ব।’

কনভেনশন সেন্টারের ৩০ হাজার বর্গফুট জায়গাজুড়ে বসেছিল বর্ণাঢ্য মেলা। এতে ৩০টির বেশি পেশাদার ভেন্ডরের পাশাপাশি অসংখ্য ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা অংশ নেন। দেশি খাবারের স্টলে ভিড় লেগে ছিল সারাক্ষণ। বিরিয়ানি, ফুচকা, চটপটি, মিষ্টি—সবকিছুতেই প্রবাসীরা খুঁজে পেয়েছেন শিকড়ের টান। আয়োজকদের হিসাবে, শুধু খাবারের বিক্রি হয়েছে দেড় থেকে তিন লাখ ডলারের মধ্যে। শাড়ি, জামা, গয়না, কসমেটিকস ও বুটিক পণ্যের দোকানগুলোতেও ছিল একই রকম ভিড়। পরিচিত তারকা তানিয়া, টনি ডায়েসসহ আরও কয়েকজন সেলিব্রিটি নিজেদের স্টল নিয়ে হাজির হলে ক্রেতাদের আগ্রহ বেড়ে যায় বহুগুণ।

মূল মিলনায়তনের আসর জমে উঠেছিল একের পর এক তারকাখচিত পরিবেশনায়। জনপ্রিয় সংগীতশিল্পী সামিনা চৌধুরী, কনা, প্রীতম হাসান ও প্রতীক হাসান, শাহনাজ বেলী, রিজিয়া পারভীন, ব্যান্ড ফিডব্যাকসহ অসংখ্য শিল্পীর গান আর নাচে দর্শক–শ্রোতারা মোহিত ছিলেন। কোনো কোনো সময়ে সমবেত কণ্ঠে দর্শকেরা শিল্পীদের সঙ্গে গলা মেলান। দাঁড়িয়ে থাকা মানুষের ভিড় থেকে ওঠা করতালি বারবার জানান দিচ্ছিল—এই আয়োজন শুধু প্রবাসীদের কাছে নয়, বরং নতুন প্রজন্মের কাছেও এক অবিস্মরণীয় অভিজ্ঞতা হয়ে থাকবে।

শুরুর দিন উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন জর্জিয়া অঙ্গরাজ্যের গভর্নর লেফটেন্যান্ট বার্ট জোন্স। মূল বক্তা ছিলেন বাংলাদেশ ইনভেস্টম্যান্ট ডেভেলপমেন্ট অথরিটির (বিডা) চেয়ারম্যান চৌধুরী আশিক বিন হারুন।

মূল মিলনায়তনের অনুষ্ঠান ছাড়াও ৯টি ভিন্ন কক্ষে সাহিত্য আড্ডা, সেমিনার, গোলটেবিল বৈঠকসহ নানা রকম আয়োজন চলেছে তিন দিনব্যপী। বিনিয়োগ-বাণিজ্যবিষয়ক সেমিনারে যোগ দেন বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান চৌধুরী আশিক বিন হারুন। সাহিত্য সভা ও কাব্যজলসায় কবি উৎপল দত্তসহ প্রবাসী কবিরা স্বরচিত কবিতা পাঠ করেন এবং আবৃত্তি পরিবেশন করেন সরোয়ার কামাল, কাকলী বিশ্বাস প্রমুখ আবৃত্তিশিল্পীরা। এতে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বাচিকশিল্পী ভাস্বর বন্দ্যোপাধ্যায়। প্রবাসী লেখকদের নতুন বইয়ের মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানও ছিল আলোচিত। বিশিষ্ট সাংবাদিক খালেদ মহিউদ্দিনের অংশগ্রহণে সাংবাদিকতাবিষয়ক ওপেন ফোরাম ছিল উপচানো ভিড়ে পূর্ণ।

প্রবাসে বেড়ে ওঠা তরুণদের জন্য বিশেষভাবে আয়োজন করা হয় ইয়ুথ ফোরাম। বিশিষ্ট শিল্প উদ্যোক্তা রাফি সাঈদ নিজের জীবনের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে নতুন প্রজন্মকে উদ্যোক্তা হওয়ার আহ্বান জানান। অন্যদিকে নারী নেতৃত্ব ও ক্ষমতায়ন বিষয়ক সেশনে অংশ নেন সুবর্ণা ডিউকসহ অনেকে।

মূলমঞ্চে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশন ইউএসএর (সিইউএইউএসএ) পরিবেশনা ছিল মনোমুগ্ধকর। সিইউএইউএসএ জর্জিয়া শাখার উপদেষ্টা সরোয়ার কামালের সঞ্চালনায় এ পর্বে বক্তব্য দেন সিইউএইউএসএর প্রেসিডেন্ট রাইহানুল ইসলাম চৌধুরী, কবি ও সাংবাদিক ওমর কায়সার এবং সংগীত পরিবেশন করেন সিইউএইউএসএ ক্যালিফোর্নিয়া শাখার জেনারেল সেক্রেটারি মোহাম্মদ কামাল।

ফোবানার সার্বিক আয়োজন সম্পর্কে সরোয়ার কামাল বলেন, আমেরিকার প্রবাসীরা একটি বছর অপেক্ষা করে থাকেন ফোবানা উৎসবের জন্য। প্রতিবার এই উৎসবকে ঘিরে নিজের মাতৃভূমিকে ফিরে পাই আমরা।

এবারের উৎসবে যোগ দিয়েছেন আমেরিকায় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় অ্যালামনাইয়ের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ও নির্বাহী সদস্য মোস্তফা আমিন খোকন। তিনি বলেন, ফোবানা কেবল গান বা নাচের আয়োজন নয়—এটি প্রবাসীদের জন্য শিকড়ের সন্ধান, পরিচয়ের পুনর্নির্মাণ এবং পরবর্তী প্রজন্মের হাতে সংস্কৃতি তুলে দেওয়ার এক অনন্য মাধ্যম।

কনভেনশন সেন্টারের চারপাশে খোলা আকাশ, সবুজ ঘাস আর সন্ধ্যার পর ঝলমলে আলোকসজ্জা মিলিয়ে পুরো পরিবেশ যেন হয়ে উঠেছিল এক উৎসবের শহর। ফোবানার সহসভাপতি দিলু মওলার ভাষায়, ‘এখানে একসঙ্গে দাঁড়ালে বোঝা যায় আমরা প্রবাসে ছড়িয়ে থাকলেও আমাদের শিকড় এক, আমাদের হৃদয় বাংলাদেশে।’

এভাবেই তিন দিনব্যাপী ফোবানা সম্মেলন ২০২৫ প্রমাণ করল—প্রবাসে থেকেও বাঙালির ঐতিহ্য, সংস্কৃতি আর মমতার বন্ধন অটুট, আর এই বন্ধন প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে বহমান থাকবে।