জাতীয় অভিবাসন নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন
প্রবাসীরা বিদেশে সংখ্যালঘু, স্বদেশে বঞ্চিত। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচন উপলক্ষে আয়োজিত টেলিভিশন বিতর্কে কোটি শ্রোতা-দর্শকের সামনে ডোনাল্ড ট্রাম্প অবলীলায় বলেন, ওহাইও রাজ্যের স্প্রিংফিল্ড শহরে হাইতি অভিবাসীরা নাকি সেখানকার বাসিন্দাদের পোষা প্রাণী খেয়ে ফেলছেন, তাঁদের তাড়িয়ে দেওয়া হবে। বেপরোয়া ট্রাম্প ও রকম কিছু নিউইয়র্ক রাজ্যের বাংলাদেশি অধ্যুষিত বাফালো শহরের অভিবাসীদের নিয়ে বললেও হয়তো নির্বাচনের চূড়ান্ত ফলাফলে তা প্রভাব ফেলত না। কার্যসিদ্ধির জন্য সংখ্যালঘু প্রবাসীদের নানাভাবে ব্যবহার করা হয়। অথচ সামষ্টিক সিদ্ধান্তে তাঁদের মতামত প্রতিফলিত হয় না। স্বদেশেও প্রবাসীদের নিয়ে অনেক উচ্ছ্বাস প্রকাশ করা হয়। অথচ তাঁদের ডেকে ভালোমন্দ জিজ্ঞাসা করার সমন্বিত উদ্যোগ কোনো সরকার নেয়নি। অধিকাংশ ক্ষেত্রে প্রশাসনিক কর্মকর্তারা প্রবাসী কল্যাণ নীতি নির্ধারণ করেন, যাঁদের প্রবাসী কমিউনিটি বিনির্মাণ বা এর কার্যক্রমের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা নেই।
২০১৬ সালের প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান নীতিমালায় বলা হয়ছিল, অভিবাসী শ্রমিকদের জন্য বিমানবন্দরে পৃথক অভিবাসন কাউন্টার স্থাপন করতে হবে, যাতে বহির্গমন ও প্রত্যাবর্তন–সংক্রান্ত তথ্যসম্ভার সংরক্ষণ করা যায়। দীর্ঘ আট বছর পর অন্তর্বর্তী সরকার সেটি বাস্তবায়ন করায় অভিনন্দন জানাই। প্রবাসী লাউঞ্জ উদ্বোধনকালে প্রধান উপদেষ্টা এ সম্পর্কে মতামত আহ্বান করেছিলেন বিধায় কিছু কথা বলা দরকার মনে করছি। ২০১০ সালে প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো (বিএমইটি) ২৫০ টাকা ফির বিনিময়ে ইমিগ্রেশন ক্লিয়ারেন্স কার্ড বা স্মার্ট কার্ড প্রদান কার্যক্রম চালু করলেও দফায় দফায় আদম ব্যাপারীদের জালিয়াতির কারণে এ বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে কার্যক্রমটি সাময়িকভাবে বন্ধ করে দেওয়া হয়। ২০১৩ সালে প্রণীত বৈদেশিক কর্মসংস্থান ও অভিবাসী আইনে, পেশায় নিযুক্ত হওয়ার উদ্দেশ্যে অন্য দেশে গমনকারীদের ‘অভিবাসী’ হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে। বিমানবন্দরে লাউঞ্জটি যদি অভিবাসীকর্মীদের হয়রানি কমিয়ে সেবা বাড়ানোর উদ্দেশ্যে করা হয়ে থাকে তাহলে নাম হওয়া উচিত অভিবাসী লাউঞ্জ, যাঁদের বিএমইটি প্রদত্ত (জাল কার্ডসহ) স্মার্ট কার্ডের মাধ্যমে শনাক্ত করা যাবে। আর এটি যদি সব প্রবাসীর সেবার জন্য করা হয়ে থাকে তাহলে প্রবাসীদের শনাক্ত করার জন্য আলাদা একটি কার্ড বিনা মূল্যে বিতরণ করতে হবে। কারণ, দিন শেষে দেখা যাবে এখানে যাঁরা সেবা নিচ্ছেন তাঁদের অনেকেই প্রবাসী নন।
অভিবাসনসংক্রান্ত শব্দাবলি, যেমন প্রবাসী, অভিবাসী, অনিবাসী, অনাবাসী—এগুলো নিয়ে তালগোল পাকানো হয়েছে। প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় ২০২৩ সালে জাতীয় ডায়াসপোরা নীতি প্রণয়ন করে এসব শব্দ সংজ্ঞায়িত করার উদ্যোগ নিলেও এখন পর্যন্ত তা সংশোধিত খসড়া পর্যায়ে ফাইলবন্দী। এই নীতি প্রণয়নে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে থাকা প্রবাসী কমিউনিটির সঙ্গে কোনো মতবিনিময় করা হয়নি, এমনকি বিষয়টি সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা দেওয়া হয়নি। যে কারণে ডায়াসপোরা শব্দের অর্থ অনেকের কাছে দুর্বোধ্য। ‘ডায়াসপোরা’ শব্দটি স্বদেশ ছেড়ে অন্যান্য দেশে ছড়িয়ে থাকা জনগোষ্ঠী বা জাতিকে বোঝানোর জন্য ব্যবহৃত হয়। এই ইংরেজি শব্দটি গ্রিক শব্দযুগল ডিয়া ও স্পেইরো থেকে এসেছে, যার নেতিবাচক অতীত রয়েছে। যেমন ব্যাবিলনের সম্রাট দ্বিতীয় নেবুচাদনেজার জেরুজালেম দখল করে ইহুদিদের বিতাড়িত করলে তারা সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ে। কোনো দেশ না থাকায় পরবর্তী সময়ে তাদের ইহুদি ডায়াসপোরা বলা হয়, যে সূত্রে ডায়াসপোরা শব্দটি ব্যাপক পরিচিতি লাভ করে। ডায়াসপোরা নীতির খসড়ায় প্রবাসীদের মোটা দাগে দুই ধরনে ভাগ করা হয়েছে। অনিবাসী বাংলাদেশি (নন-রেসিডেন্ট বাংলাদেশি, সংক্ষেপে এনআরবি), যাঁরা দীর্ঘ সময় স্থায়ীভাবে অন্য দেশে বসবাস করলেও নাগরিকত্ব (পাসপোর্ট) বা নাগরিক অধিকার পাননি এবং বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত (পিপল অব বাংলাদেশি অরিজিন, সংক্ষেপে পিওবি), যাঁরা ও যাঁদের পরবর্তী প্রজন্ম অন্য দেশের নাগরিকত্ব (পাসপোর্ট) পেয়েছেন। আমার মতে, সর্বস্তরে বাংলা চর্চার জাতীয় অঙ্গীকার মেনে, ডায়াসপোরা শব্দের পরিবর্তে অভিবাসন/অভিবাসী এবং এর দুই ধরনকে অনিবাসী (এনআরবি) ও অনাবাসী (পিএবি) বললে সহজবোধ্য হয়। সংশোধিত খসড়ার সূচনায় বৈদেশিক ঋণ ও লেনদেনের ওপর ইতিবাচক প্রভাব বৃদ্ধিতে ডায়াসপোরাদের বিনিয়োগের গুরুত্বের কথা বলা হয়েছে। অর্থাৎ একই মন্ত্রণালয় থেকে দুটি নীতি সমান্তরালভাবে বাস্তবায়নের চেষ্টা চলছে—একটি প্রবাসী আয় বাড়ানোর জন্য অভিবাসী কর্মীদের বিদেশে পাঠানোর ব্যবস্থা করা, অন্যটি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে ডায়াসপোরাদের সম্পৃক্ত করা। দুই নীতিতেই অনেক ভালো কথা লেখা থাকলেও বাস্তবে চলছে প্রবাসীদের দিয়ে অর্থ উপার্জন, যা একটি গণপ্রজাতন্ত্রী রাষ্ট্রের নৈতিক অবস্থানকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। অন্যদিকে অর্থ উপার্জনের চিত্রটিও ক্রমেই পাল্টে যাচ্ছে। কারণ, সবচেয়ে বেশি রেমিট্যান্স আসছে যুক্তরাষ্ট্র থেকে, যেখানে অভিবাসীকর্মীর চেয়ে ডায়াসপোরার সংখ্যা ঢের বেশি। তাই এসব জগাখিচুড়ি বাদ দিয়ে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান নীতি এবং জাতীয় ডায়াসপোরা নীতি একীভূত করে একটি সর্বজনীন ও কল্যাণমূলক জাতীয় অভিবাসন নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করা সময়ের দাবি।
সর্বজনীন নীতি প্রণয়নের জন্য প্রথমে অভিবাসনের বৈশ্বিক পটভূমি দেখে নেওয়া দরকার। ধর্ম কিংবা বিজ্ঞান, উভয় বিচারে মানবসভ্যতার উন্মেষ ও বিকাশের সঙ্গে অভিবাসন নিবিড়ভাবে সম্পৃক্ত। অভিবাসনের অন্যতম কারণগুলো হলো অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক ও পরিবেশগত। দ্বিতীয় শিল্পবিপ্লবের উপাদান, যেমন বাষ্পীয় ইঞ্জিন, যান্ত্রিক উৎপাদন, রেলপথ, পণ্যবাহী জাহাজ ইত্যাদি অবলম্বন করে উত্তর গোলার্ধের শীতপ্রধান দেশগুলো অর্থনৈতিক ও পরিবেশগত (অতিশীতল আবহাওয়া) কারণে দক্ষিণ গোলার্ধে উপনিবেশ সৃষ্টি ও অভিবাসন শুরু করে। পরবর্তী সময়ে বৈশ্বিক বাজারের নানাবিধ চাহিদার কারণে বহুমুখী উৎপাদন বৃদ্ধি পায় এবং দক্ষিণ গোলার্ধের দেশগুলো থেকে শুরু হয় উল্টো অভিবাসন, প্রাথমিকভাবে যার কারণ অর্থনৈতিক হলেও পরে পরিবেশ বিপর্যয়ও অন্যতম কারণ হয়ে ওঠে। উত্তর থেকে দক্ষিণের অভিবাসন একচেটিয়া হলেও দক্ষিণ থেকে উত্তরের অভিবাসনে নানা সংকট সৃষ্টি হওয়া বা করার প্রেক্ষাপটে ১৯৫১ সালে আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা (আইওএম) গঠিত হয়। মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারত আমাদের এক কোটি শরণার্থীকে আশ্রয় দিয়েছিল এবং ৯ মাস খাইয়েছিল—এ রকম একটি বয়ান চালু থাকলেও পরের অংশটুকুর কৃতিত্ব জাতিসংঘের, যেখানে আইওএমের সম্পৃক্ততা ছিল। ১৯৯৮ সালে আইওএমের ঢাকা অফিসের কার্যক্রম শুরু হয়। ২০১৬ সালে এটি জাতিসংঘের অনুমোদিত সংস্থায় রূপান্তরিত হলে কার্যপরিধি বৃদ্ধি পায়, যে পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৮ সালে জাতিসংঘের সদস্যদেশগুলোর সম্মতিক্রমে অভিবাসনবিষয়ক বৈশ্বিক চুক্তির ২৩টি উদ্দেশ্য ঘোষণা করা হয়। এই উদ্দেশ্যগুলোর ভেতরে মানব পাচার প্রতিরোধ, বৈধ রেমিট্যান্স, অভিবাসীদের ক্ষমতায়ন, দক্ষতা উন্নয়ন, মর্যাদাপূর্ণ প্রত্যাবর্তনের মতো প্রবাসীদের মৌলিক অধিকার অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। ২০২২ সালে আইওএম আয়ারল্যান্ডের রাজধানী ডাবলিনে প্রথম বৈশ্বিক ডায়াসপোরা সম্মেলনের আয়োজন করে। সম্মেলনের এজেন্ডা ছিল অভিবাসনবিষয়ক বৈশ্বিক চুক্তির ১৯ নম্বর উদ্দেশ্য, যেখানে বলা হয়েছে, দেশের টেকসই উন্নয়নে প্রবাসীরা যেন পুরোপুরি অবদান রাখতে পারেন সেই পরিবেশ তৈরি করা। অর্থাৎ জাতিসংঘ ঘোষিত টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার ১৭টি অভীষ্টের প্রতিটিতে প্রবাসীদের অবদান রাখার বিষয়টি দেশের অভিবাসন নীতিমালায় প্রতিফলিত হতে হবে। ডাবলিন সম্মেলনে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেন তৎকালীন প্রবাসী কল্যাণমন্ত্রী ও সচিব। পরের বছর তাঁরা ঢাকার প্যান প্যাসিফিক সোনারগাঁও পাঁচ তারকা হোটেলে একটি কর্মশালা আয়োজন করে জাতীয় ডায়াসপোরা খসড়া নীতির ঘোষণা দেন, যদিও সেখানে যাঁদের নিয়ে নীতি প্রণয়ন সেই প্রবাসীদের উপস্থিতি ছিল না।
একটি সর্বজনীন জাতীয় অভিবাসন নীতি দ্রুত প্রণয়ন করা অনেক কারণে জরুরি। এখানে দুটি কারণ উল্লেখ করছি। আন্তর্জাতিক কারণটি বোঝার জন্য বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম শিল্প দুর্ঘটনা হিসেবে সাভারের রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির বিষয়টি বলে রাখি। ২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল সাভারের একটি পোশাক তৈরির কারখানার ওই ভয়াবহ দুর্ঘটনায় সহস্রাধিক শ্রমিকের মৃত্যু ঘটলে বাংলাদেশে কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তা ও শ্রম অধিকার পরিস্থিতি নিয়ে আন্তর্জাতিক মহলে ব্যাপক সমালোচনা শুরু হয়। অনেক ক্রেতা বাংলাদেশ থেকে পোশাক আমদানি বন্ধ করে দেওয়ায় তৈরি পোশাকশিল্প বড় ধরনের সংকটে পড়ে। এখনো তৈরি পোশাক রপ্তানিতে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে প্রতিযোগীদের তুলনায় বাংলাদেশ পিছিয়ে আছে। পরিস্থিতি সামলাতে কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তা–পরিস্থিতির উন্নতি ঘটলেও শ্রম অধিকার ও শ্রমিককল্যাণ–বিষয়ক নীতিমালা প্রণয়েন অপ্রতুলতা রয়ে গেছে। এ জন্য অন্তর্বর্তী সরকার ‘শ্রম সংস্কার কমিশন’ গঠন করেছে। তাই প্রস্তাব রাখছি, বৈদেশিক কর্মসংস্থানকে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ে সরিয়ে নিয়ে প্রবাসী শ্রমিকদের কল্যাণের বিষয়টিও যেন কমিশনের কার্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। প্রসঙ্গে আসি, লক্ষ করছি জাতিসংঘের অভিবাসনবিষয়ক সংস্থা আইওএমের ঢাকা অফিস অভিবাসন–ব্যবস্থাপনা এবং বাংলাদেশ থেকে মানব পাচার নিয়ে ইদানীং জোরেশোরে কথা বলছে, এমনকি প্রতিবেদনও তৈরি করেছে। দ্রুত জাতীয় অভিবাসন নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের মাধ্যমে একটি মজবুত পাটাতনে না দাঁড়ালে, তৈরি পোশাক খাতের মতোই রেমিট্যান্স আয়ের খাতটিও আন্তর্জাতিক চাপের মুখে টালমাটাল হয়ে পড়তে পারে।
অভ্যন্তরীণ কারণ হচ্ছে, প্রবাসীদের দেশের সঙ্গে নিবিড়ভাবে সম্পৃক্ত না করলে, টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার ১৭টি অভীষ্টে অবদান রাখা তো দূরের কথা, কিছু প্রবাসীর কর্মকাণ্ডে দেশের ভাবমূর্তি সংকটে পড়ার আশঙ্কা। শুরুতে বলেছিলাম, বিদেশে প্রবাসীরা সংখ্যালঘু সম্প্রদায়, তাদের শক্তি বাড়াতে একতাবদ্ধ থাকতে হয়। গত শতক পর্যন্ত সেভাবেই ছিল, কিন্তু এই শতকের শুরু থেকে দেশে বিভাজনের রাজনীতি ও সহিংসতা বৃদ্ধির প্রভাব প্রবাসেও পড়তে শুরু করে। এই প্রভাব শুধু প্রবাসী রাজনৈতিক দলাদলিতে সীমাবদ্ধ থাকেনি, মেরুকরণ দেখা গেছে সামাজিক, পেশাদারি, এমনকি ব্যবসায়ীদের সংগঠনেগুলোতেও। গত দুই দশকে দেশ থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার হয়েছে, যার সঙ্গে সুযোগসন্ধানী ও অসৎ কিছু প্রবাসীও জড়িত। দেশ থেকে দিকনির্দেশনা পেলে দল–মতনির্বিশেষে ঐক্যবদ্ধ হয়ে প্রবাসী কমিউনিটি এই দুষ্কৃতকারীদের প্রতিহত করতে পারবে। কারণ, তারা হালাল উপার্জনকারী প্রকৃত দেশপ্রেমিক, দেশের জন্য কিছু করতে পারলে নিজেদের ধন্য মনে করে। সম্প্রতি সুইজারল্যান্ডের জেনেভা বিমানবন্দরে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টা আসিফ নজরুল কয়েকজন প্রবাসী দ্বারা হয়রানির শিকার হন। অথচ এই উপদেষ্টাই শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে প্রবাসীদের জন্য বিশেষ লাউঞ্জ নির্মাণের ব্যবস্থা করেছেন। এটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, বরং গত দুই দশক ধরে চলমান। কোনো রাষ্ট্রপ্রধান বিদেশ সফরে গেলে সফররত দেশের প্রবাসীরা হট্টগোল করেন, মারামারি পর্যন্ত হয়। বাংলাদেশ ছাড়া এ ধরনের আচরণ অন্য দেশের প্রবাসীদের মধ্যে চোখে পড়ে না। বিগত সরকারের আমলে বেশ কয়েক বছর ধরে টোকিওস্থ বাংলাদেশ দূতাবাস রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে বিরোধী দলের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত প্রবাসীদের আমন্ত্রণ জানায়নি। পক্ষান্তরে বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার আসার পর আগের সরকারের যেসব প্রবাসীর সঙ্গে দূতাবাসের দহরম–মহরম ছিল তাঁদের সমাদর কমে গেছে। রাষ্ট্রের প্রতিনিধিত্বকারী দূতাবাস প্রবাসীদের সঙ্গে এ ধরনের বৈষম্যমূলক আচরণ করতে পারে না। এ সবকিছুই যে দেশ থেকে আসা রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত, তা নয়। অনেক সময় দূতাবাসের কিছু কর্মকর্তা দেশের রাজনৈতিক প্রভাবশালীদের নেকনজরে থাকার জন্যও এমনটি করে থাকেন, যেমনটি জেনেভার হয়রানি–কাণ্ডে দেখা গেছে।
সোশ্যাল মিডিয়ার বদৌলতে এখন আর কোনো কিছুই শেষ পর্যন্ত গোপন থাকে না এবং প্রবাসী কমিউনিটিতে যা ঘটে তার চেয়ে দশ গুণ বেশি রটনা হয়। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রসারের ফলে এসব বিদেশিদের বুঝতে এখন অসুবিধা হয় না। টোকিওতে যাঁরা সামাজিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে সম্পৃক্ত তাঁদের অনেকের সঙ্গে স্থানীয় পুলিশ যোগাযোগ রাখে। লক্ষ করেছি, এমন সব বিষয়ে পুলিশ জানতে চায়, যা প্রবাসী কমিউনিটির ভেতরে সীমাবদ্ধ, তাদের জানার কথা নয়। অর্থাৎ প্রবাসীদের অধিকাংশ কর্মকাণ্ড সরাসরি বসবাসরত দেশের নীতিনির্ধারকদের কাছে চলে যাচ্ছে, যা বাংলাদেশের ইমেজ সংকটের কারণ হতে পারে। তাই পাঁচ তারকা হোটেলের শীতাতপনিয়ন্ত্রিত কক্ষে কিছু প্রশাসনিক কর্মকর্তা আর বিদেশি পর্যবেক্ষক নিয়ে ডায়াসপোরা নীতি প্রণয়ন নয়, প্রবাসী কমিউনিটির প্রতিনিধিদের দেশে ডেকে, রাজনৈতিক দলসমূহ এবং সংশ্লিষ্ট স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে নিয়ে সর্বজনীন সমঝোতার মাধ্যমে একটি অভিবাসন নীতিমালা দ্রুত প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের এখনই সময়।