শৈল্পিক খেলা হিংসাত্মক আঘাতে পরিণত হয়েছে!
টেনিস এমন একটি খেলা, যার শুরু ছিল সুন্দর পরিপাটি পোশাকে। সাদা জামা, সাদা প্যান্ট, গলায় টাই বেঁধে আর্টিস্টিকভাবে নানা দক্ষতার মাধ্যমে খেলতে হবে। অতীতের রাজা–বাদশারা এ খেলায় অংশগ্রহণ করেছেন। সাধারণ মানুষের টেনিস খেলা একসময় স্বপ্ন ছিল। যুগের পরিবর্তনে পরিবর্তন হয়েছে টেনিসেরও, এখন রাজা–বাদশাসহ তাঁদের ছেলেমেয়ে টেনিস খেলেন না, তবে সম্মানের চেয়ারে বসে টেনিস খেলা উপভোগ করেন। কথিত রয়েছে, এখনো চলমান টেনিস কোর্টে কথা বলা যাবে না। এটি অত্যন্ত উঁচ্চ মানের স্পোর্টস, যাকে বলে জেন্টেলম্যানের খেলা।
দেখেছেন নিশ্চয়ই উইম্বলডন খেলতে সাদা টি–শার্ট, হাফপ্যান্ট, সাদা জুতা ও মোজা পরতে হয়। এখন কিন্তু টেনিস বল আর আগের মতো হিট করা হয় না। এখন দুই পক্ষের মধ্যে রীতিমতো যুদ্ধ শুরু হয়, কে কাকে পরাজিত করবে খেলার দূরদর্শিতা, মেন্টাল টর্চার বা ফিজিক্যাল পারদর্শিতার মধ্য দিয়ে। টেনিসের সেই শৈল্পিক ভাবমূর্তি এখন হিংসাত্মক আঘাতে পরিণত হয়েছে। এটি যখন সম্ভব হয়েছে, তখন কেন সম্ভব হবে না শিক্ষার মধ্যে। এখনো যে জঘন্য মনোভাব রয়েছে প্রশিক্ষণে, তাকেও ভেঙেচুরে তছনছ করতে হবে। হঠাৎ কেন এসব কথা?
হঠাৎ হবে কেন!
আমি শিক্ষার ধরন, বরণ ও পরিবর্তনের পেছনে লেগেছি বেশ কয়েক বছর ধরে। হয়তো মনে করতে পারেন, পরিবর্তনের জন্য শুধু বাংলাদেশের গণমাধ্যম ব্যবহার করছি। না, আমি বিশ্বের নানা প্ল্যাটফর্ম এবং আমার কাজের মধ্য দিয়ে এর পরিবর্তনে উঠে পড়ে লেগেছি। অনেকে মনে করতে পারেন, কেন এত দেরি করে এ কাজে হাত দিয়েছি। কারণ হচ্ছে, মনে কি পড়ে মিখাইল গর্বাচেভের কথা। তিনি রাজনীতির শুরুতে ভেবেছিলেন সোশ্যালিজম ভেঙে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত করবেন, কিন্তু কাজটি করতে তাঁর জীবনের শেষ সময়টির দরকার হয়েছিল। আমার ক্ষেত্রেও যা আমি দেখেছি ছোটবেলায়, সেটার পরিবর্তন তখন করতে পারার মতো হিম্মত থাকলেও তার গ্রহণযোগ্যতা তখন ছিল না। এখনো যে হয়েছে সেটা শতভাগ নিশ্চিত নই, তবে আমি যেহেতু বিশ্বের নানা বিশ্ববিদ্যালয় ও খ্যাতনামা শিল্পকারখানায় নানা দায়িত্বে কাজ করেছি, ছেলেমেয়েকে দিয়ে টেনিস ও তার পুরোনো ট্রেডিশন পরিবর্তনে কাজ করছি; সে ক্ষেত্রে মনে করি, পুরোনো শিক্ষাপদ্ধতির পরিবর্তন করে তাকে সু ও সৃজনশীল করার এখনই উপযুক্ত সময়।
আসুন ফিরে যাই ছোটবেলার স্মৃতিচারণায়। স্কুল, কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ক্লাসের দিন কী হয়েছে। পরিচয় পর্ব দিয়ে ক্লাস শুরু। শিক্ষক সবাইকে জিজ্ঞেস করছেন—তোমার বাবা কী করেন? কেউ জবাব দিয়েছে, আমার বাবা ডাক্তার, কেউ বলেছে ইঞ্জিনিয়ার, কেউ বলেছে ডিসি, কেউ বলেছে সচিব, কেউ বলেছে মন্ত্রী। আর সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষক প্রত্যুত্তরে পুলকিত মনে বলেছেন—ও আচ্ছা! খুব ভালো, স্যারকে সালাম জানিও, আমার কথা বোলো ইত্যাদি ইত্যাদি। যাদের বাবা সাধারণ কাজ করেছেন, তাদের পরিচয়ে কী হয়েছে?
একই প্রশ্ন তোমার বাবা কী করেন? উত্তর হয়েছে কিছুটা ভিন্ন যেমন মাথা নিচু করে জবাব দেওয়া হয়েছে—আমার বাবা কৃষক বা জেলে এমন কিছু। শিক্ষক ভ্রু কুঁচকে জবাব দিয়েছেন—ও আচ্ছা! বসো বসো। জেলে নদীতে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করেন বা কৃষক মাঠে কাজ করে ফসল ফলান, সেটা সমাজের চোখে বড্ড বেমানান। যার ফলে সমাজের শুধু শিক্ষক নন, সব ধরনের এলিটদের ভ্রু কুঁচকে যায়। এ ছিল সেই প্রথম দিনের পরিচয় পর্বের ঘটনা এবং সেই থেকে শিক্ষকের মাথায় একটা জিনিস পরিপক্ব হয়ে যায়, সেটা হলো, কার বাবা চিকিৎসক, কার বাবা ইঞ্জিনিয়ার ও কার বাবা উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা।
এর পর থেকে প্রতি ক্লাস, কার্ড টার্ম বা ভাইভা, প্রেজেন্টেশন এমনকি সেমিস্টার-ফাইনালেও তাদের একটা এক্সট্রা প্রাধান্য দেওয়া শুরু হয়। দেখা গেছে, আমার মতো যারা গ্রাম থেকে উঠে এসেছে, তাদের মেধার জোর থাকলেও বাবার পরিচয়ের কারণে অনেকটা পিছিয়ে পড়তে হয়েছে। তবে এসব বাধা পেরিয়ে যারা জীবন গড়ে তুলেছে, তাদের সংখ্যা কিন্তু কম নয়।
কিন্তু যারা অবহেলা ও অবজ্ঞার অন্ধকারে ঢুকেছে, তাদের অনেকে চিরতরে হারিয়ে গেছে। যদি সমাজে এ কুসংস্কার না থাকত, তবে অনেক সম্ভাবনাময় মেধাসম্পন্ন প্রতিভার বিকাশ ঘটত এবং তাদের আলোয় আলোকিত হতে পারত তার পরিবার তথা দেশ ও জাতি। এমন বৈষম্যের কারণে বাংলাদেশ তথা বিশ্বের হাজারো নক্ষত্রের পতন হচ্ছে প্রতিনিয়ত আমাদের চোখের সামনে। এসব অনিয়ম ভেঙে দেওয়ার এখনই সময়।
আমি মনে করি, যেসব শিক্ষক এখন শিক্ষকতা করছেন, তাঁদের উচিত হবে যখন কেউ মাথা নিচু করে বলবে সে জেলে বা কৃষকের ছেলে, তখনই যেন কষে একটি থাপ্পড় লাগিয়ে দেন এবং বলেন—বোকা, মাথা নিচু করে কথা বলিস কেন? বাবা নদীতে মাছ ধরে, সে জন্য? আরে ব্যাটা, সবার সামনে দাঁড়িয়ে মাথা উঁচু করে, উচ্চ আওয়াজে বল, আমার বাবা মাথার ঘাম পায়ে ফেলে, নদীতে মাছ ধরে তাঁর সন্তানকে দেশের শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠে পড়তে পাঠিয়েছেন। আমি তেমন একজন আদর্শবান সফল বাবার সন্তান।
তাহলে দেখবেন, একদিন সেই জেলের ছেলেটি বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নয়, হয়েছে জগদ্বিখ্যাত অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর।
কৃষিখেত থেকে উঠে এসে আকাশছোঁয়ার দৃষ্টান্ত বাংলাদেশে একটা–দুটো নয়, হাজার হাজার আছে। তাই বলি কান খুলে শুনে রাখ, কাউকে ছোট করে দেখলেই সে ছোট হয়ে যায় না, বরং যে ছোট করে দেখে, সেই ছোট হয়ে যায়। দুর্নীতির টাকায় পকেট ভারী করে বড় কিছু ভাবার চেয়ে মনের ব্যাসার্ধ বড় করা এখন সময়ের দাবি। কারণ, কাউকে পেছনে রেখে কোনো জাতি এগিয়ে যেতে পারেনি, পারবে না। এগিয়ে যেতে হলে সবাইকে নিয়ে এগিয়ে যেতে হবে। তবে কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যে পদচিহ্ন অঙ্কিত হবে। সোনার বাংলা গড়ার আগে ভালো মন তৈরি করতে হবে এবং এই তৈরি শুরু থেকেই যেন শুরু হয়, সেটাই এখন কাম্য।