১৯৫৯ থেকে ১৯৭৯ সাল পর্যন্ত আমরা নারায়ণগঞ্জের মসজিদ খানপুরে হামিদ মিয়ার বাড়িতে ভাড়া ছিলাম। মসজিদ খানপুরকে সবাই মজিদ খানপুর নামেই চেনে। স্বাধীনতার পূর্ব পর্যন্ত নারায়ণগঞ্জের পূর্ব, পশ্চিম, উত্তর, দক্ষিণ যেকোনো প্রান্ত থেকেই যেকোনো রিকশাচালককে মজিদ খানপুর হামিদ মিয়ার বাড়ি যাব বললেই হতো। তিনি ছিলেন নিঃসন্তান। তখন তিনি নারায়ণগঞ্জ বার একাডেমি স্কুলের ম্যানেজিং কমিটির সদস্য ছিলেন। মৃত্যুর আগে তিনি তাঁর সব সম্পত্তি ওয়াক্ফ করে দেন। স্বাধীনতার পর তাঁর নাম স্তিমিত হয়ে এলে ‘লেউচ্ছার গ্যারেজ’ নামটি শহরে খ্যাত হয়। গ্যারেজটি আমাদের বাসার কাছেই ছিল। রাত পর্যন্ত রিকশার টুংটাং শব্দ পেতাম। ভাড়ার টাকা সময়ানুযায়ী দিতে না পারলে গ্যারেজের মালিক রিকশাচালকের ওপর খড়ম চালান দিতেন। দরিদ্র, অসহায় রিকশাচালকের আহাজারির শব্দ ভেসে আসত জানালায়। গ্যারেজের মালিকের দ্বিতীয় পুত্র আকবর ছিল প্রাইমারি স্কুলে আমার সহপাঠী। শৈশব ও কৈশোরে সে ছিল সাহসী, দস্যি ও দুরন্ত এক বালক।
দূর পরবাস-এ জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]
১৯৭৯ সালে খানপুর থেকে নতুন চাষাঢ়া জামতলায় আমাদের বাসা স্থানান্তরিত হয় মেজ ও সেজ ভাইয়ের বিয়ের কারণে। চাষাঢ়াস্থ সাত্তার খান পীর সাহেব ছিলেন এই চারতলা বিল্ডিংয়ের মালিক। আমাদের সহপাঠী বন্ধু ইদ্রিস ও কুতুবউদ্দিনের পীর তিনি। আমি তাঁর স্নেহে সিক্ত ছিলাম সব সময়। তিনি প্রায়ই আমাকে ডেকে পাঠাতেন। তাঁর দরবারে গেলে বলতেন, বসো, চা খাও। হয়তো এক ঘণ্টা বসে থাকার পর বলতেন, আচ্ছা যাও। আমাকে ডেকেছিলেন? না, এমনি। কেন তিনি আমাকে ডেকে এনে বসিয়ে রেখেছিলেন? সেটা আজও আমার কাছে রহস্যময়! তোলারাম কলেজের অধ্যক্ষ শামসুল হুদা স্যারকেও দেখেছি তাঁর দরবারে যাতায়াত করতেন। কলেজের হাজার হাজার ছাত্রছাত্রী তাঁর সামনে এসে বিনয় প্রকাশ করে। বিস্মিত হয়ে দেখি স্যার পীরের দরবারে এসে নতজানু হন। দোতলার দুটি ইউনিট আমরা একত্রে ভাড়া নিই। তাঁর বড় পুত্র সাব্বির ভাই ছিলেন বাড়ির তদারকিতে।
সাব্বির ভাই ও পীর সাহেব আমাদের অবাধ স্বাধীনতা দিয়েছিলেন। ভাবটা এমন যে আমরাই বিল্ডিংটির মালিক। ‘স্বাধীনতা তুমি রোদেলা দুপুরে মধ্যপুকুরে গ্রাম্য মেয়ের অবাধ সাঁতার।’ ছাদে পানির রিজার্ভারে বা ট্যাংকে পানি না থাকলে আমরাই মোটরের সুইচ অন করে দিতাম। কেয়ারটেকার বারেকের অপেক্ষায় থাকিনি। মিটার রুমটি ছিল সিঁড়ির নিচে। ওই স্থানেই বারেক ঘুমাত। বারেক অনুপস্থিত থাকলে নানার উপহার দেওয়া মায়ের লাঠিটি সুইচে চাপ দিয়ে গ্রিলের এপাশ থেকেই মোটর চালু করে দিয়েছি। আন্ডারগ্রাউন্ডে ট্যাংকে পানি নেই, মোটর অন করে দিলাম। ছাদে ট্যাংক ভরে উপচে ছাদ বেয়ে পানির জলরাশি রান্নাঘরের জানালায় শব্দ করে নেমে এলে দৌড়ে লাঠির চাপ দিয়ে মোটর বন্ধ করেছি। খানপুরে থাকাকালীন পৌরসভার ট্যাপের পানি খেয়েছি। জামতলায় আসার পর থেকে আমরা টিউবওয়েলের পানি খাওয়া শুরু করি। এখন তো পৌরসভার ট্যাপের পানি খাওয়ার কথা চিন্তাই করা যায় না।
২৫ বছর ধরে বিদেশে আবার ওই পৌরসভার ট্যাপের পানিই খাচ্ছি নির্ভয়ে। বৃষ্টি হলে ছাদে গিয়ে ভিজেছি। শবে বরাতের রাতে জোছনার আলোয় স্নাত হয়ে আমি ও হাসনাত বিল্ডিংয়ের ছাদে নামাজ পড়েছি। মেজ ও সেজ ভাইয়ের বিয়ের বউভাত এবং ছোট বোনের বিয়ের অনুষ্ঠান এই বাড়ির ছাদেই করা হয়েছিল। রান্না করা খাবারের বড় বড় পাতিলগুলো (ডেগ বলা হতো) ছালার বস্তার ওপর রেখে চারজনে ধরাধরি করে সিঁড়ি দিয়ে টেনে ছাদে নেওয়া হয়েছিল। বিয়ের অনুষ্ঠানের এলাহি কাণ্ড ছিল সেসব। সে এক স্মৃতিজাগানিয়া গল্প।
জামতলার বাসায় আসার পর সানোয়ার ভাইয়ের অনুজ বাবুলের সঙ্গে বন্ধুত্ব হয় আমার। স্নাতক পরীক্ষার পর এক পড়ন্ত বিকেলে বাবুল এসে ইত্তেফাক পত্রিকার পেপার কাটিং দিয়ে বলল, চল টিকাটুলী যাই ফটোগ্রাফি শিখি। আমিও তো চাই, কী করে শিখব? ক্যামেরা নেই, টাকা নেই। ‘ঢাল নাই তলোয়ার নাই নিধিরাম সর্দার।’ এলিফ্যান্ট রোডে বেগার্টে গেলে ভালো হয়। বুঝস না, দূরে গেলে খরচ আরও বাড়বে। অগত্যা পাঁচ শ টাকা কোর্স ফি দিয়ে ক্লাস শুরু করি হারুন সাহেবের বাসায়। তিনি ঢাকা কলেজে চাকরি করতেন। প্রতি ক্লাসে যাওয়ার জন্য মাত্র পাঁচ টাকা পকেটে নিয়ে নারায়ণগঞ্জ থেকে ঢাকা যাতায়াত করি। প্রগতির তৈরী সুপরিয়র কোচে ঢাকা যাওয়ার বাসভাড়া ছিল তখন দেড় টাকা। ক্লাস শেষে সন্ধ্যায় তৃষিত হৃদয়ে দুজনে চা-সিগারেট ভাগাভাগি করি। ডার্ক রুমের ক্লাস শেষে ঘর্মাক্ত শরীরে বাসে জানালার পাশে বসে বাতাসে শরীর জুড়াই। মনে মনে ছবি তুলি। ইয়াসিকা ইলেকট্রো তারটিফাইভ জিএক্স ক্যামেরা পাওয়ার পর বাবুলকে নিয়ে সোনারগাঁ গিয়ে ছবি তুলি। চেগুর দোকানের বেকার জীবনে সব বন্ধুকে নিয়ে চর হাউসে ফটোসেশন করি। হাসনাত, মামুন, নজরুলকে নিয়ে কমুদিনী ও মাসদাইর শ্মশানে ছবি তুলি। ‘সেই যে আমার নানা রঙের দিনগুলি।’
বাবুলের হাঁটুতে সমস্যা ছিল। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধুর আমন্ত্রণে বিদেশি বিশেষজ্ঞ ডাক্তার গাস্ট ঢাকায় এসেছিলেন মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসার জন্য। সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে তিনি বাবুলের হাঁটুতে অস্ত্রোপচার করেছিলেন। হাঁটুব্যথায় প্রতিবছর হাঁটুতে ইনজেকশন নিতে হতো বাবুলকে। যেকোনো চিকিৎসকই এ–জাতীয় ইনজেকশন পুশ করতে পারতেন। একদিন বাবুল এসে বলল, তোর সঙ্গে চিকিৎসক মাহবুবুর রহমানের (প্রয়াত) পরিচয় আছে। আমাকে নিয়ে চল, ইনজেকশন নিতে হবে। এরপর পঁচাশির কোনো এক সময়ে জানলাম, আমাদের শহরের এক ডাক্তার ইনজেকশন দেওয়ার পরপরই বাবুল চলে যায় না–ফেরার দেশে। বাবুল আজ তারা হয়ে আছে আকাশে।
স্বপ্নে ও স্মৃতিতে বাবুল ফিরে আসছিল বারবার। এ জন্য ঢাকা থেকে বাবুলের ছবিটা সংগ্রহ করি। না–ফেরার দেশে আকবর, বাবুল, মামুন, জাহাঙ্গীর, বাবু, মাসুদ, পিয়া, রতন, বদরুল, সেলিম, ইদ্রিস আকাশের তারা হয়ে ভালো থাকুক।