স্বপ্নের সকাল

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

আজকের সকালটা সত্যিই চমৎকার। সারা রাত অঝোরে বৃষ্টি ঝরেছিল কিন্তু সকাল হতেই ঝকঝকে রোদ। বৃষ্টির পর আকাশ একটু বেশি নীল। ঘাসেরা আরও সজীব। গাছের পাতারা আগের চেয়েও একটু বেশি সবুজ। অ্যাটিকের জানালা গলে ভোরের একটুকরো রোদ লুটিয়ে পরেছে মালিহার বিছানায়। আজ ওর গ্র্যাজুয়েশন—একটা বিশেষ দিন, গত রাতেই জগদ্বিখ্যাত ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ে ল স্কুলে তার অ্যাকসেপ্টেন্সের ই–মেইল এসেছে।

একই সঙ্গে আনন্দ আর বেদনার। সে যদি মাকে জড়িয়ে ধরে, আনন্দটা শেয়ার করতে পারত, ‘মাগো তোমার মেয়ে বিশ্বের অন্যতম বিশ্ববিদ্যালয়ে ল পড়তে যাচ্ছে’ ভাবতে ভাবতে সে ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে। গত চার বছরে, একটি মুহূর্ত নষ্ট করেনি, অক্লান্ত পরিশ্রম করেছে।

স্টোনিব্রুক ইউনিভার্সিটি থেকে সাইকোলজিতে জিপিএ–৪ পেয়ে স্নাতক হয়েছে। সব দিক দিয়ে নিজেকে যোগ্য প্রমাণ করে হয়েছে ভ্যালেডিক্টোরিয়ান। ভ্যালেডিক্টোরিয়ান হলো সাফল্যের একটি একাডেমিক শিরোনাম যা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডাসহ বেশ কিছু দেশে সবচেয়ে চৌকস ছাত্রকে স্নাতক অনুষ্ঠানে সমাপনী বা বিদায়ী ভাষণ দিতে দেয়।

অলংকরণ: আরাফাত করিম

এটি একটি বিরল সম্মান। ভাবতেই ওর মনটা আনন্দে ভরে ওঠে, সঙ্গে সঙ্গে মায়ের কথা ভেবে মনটা আবার বিষণ্ন হয়। আজ এই আনন্দ উৎসবে মা থাকবেন না।
যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটিগুলোর অন্যতম দুটি দিন হলো গ্র্যাজুয়েশন এবং মুভ ইন ডে—যেদিন প্রথমবারের মতো সন্তানেরা তাদের মা-বাবার সঙ্গ ছেড়ে ডরমিটরিতে থাকতে শুরু করে করে। ডরমিটরির জন্য বিছানা, বালিশ, ছোট রিফ্রেরেজিটার আর প্রয়োজনীয় আসবাবপত্র—এ সব কিনে গাড়িবোঝাই করে অভিভাবকেরা সন্তানকে ডরমে পৌঁছে দেন।

বিদায়ের সময় অবতারণা হয় এক হৃদয়বিদারক দৃশ্যের। আর গ্র্যাজুয়েশন হলো বিশাল এক আনন্দের দিন। ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাসকে চারিদিকে ব্যানার, পতাকা, আর ইউনিভার্সিটি মাসকাট দিয়ে অপরূপ সাজে সাজানো হয়। ছাত্র-শিক্ষকেরা গাউন আর গ্র্যাজুয়েশন ক্যাপ মাথায়, ইউনিভার্সিটির মাঠে অথবা স্টেডিয়ামে সমবেত হয়ে প্যারেডে অংশ নেয়। প্রতিটি ছাত্র তাদের মা–বাবা আর নিকট আত্মীয়দের সেই অনুষ্ঠানে আসার জন্য টিকিট পায়।

অনুষ্ঠানে একজন প্রধান বক্তা থাকেন, যিনি তাঁর কর্মক্ষেত্রে উজ্জ্বল। তিনি ছাত্রদের উদ্দেশ্য উপদেশমূলক ভাষণ দেন। মালিহা ডরমে থেকে পড়াশোনা করতে পারেনি, সে কমিউটার স্টুডেন্ট হিসাবে শহর থেকেই যাতায়াত করেছে, কারণ ডরমের খরচ চালানোর মতো অর্থ তার বাবার ছিল না। পরীক্ষার সময় বান্ধবীদের সঙ্গে তাদের রুমে বেআইনিভাবে ডাবলিং করেছে। প্রতিদিন ট্রেনে বাসে যাতায়াত করতে অনেক সময় ব্যয় করতে হয়েছে। খুব কষ্ট হয়েছে তবুও সে হাল ছাড়েনি। প্রতিটি সাবজেক্টে ভাল ফল করেছে। সে ঠিক করেছে আজ গ্র্যাজুয়েশন অনুষ্ঠানে ভ্যালেডিক্টোরিয়ানের ভাষণে সে তার মনে কথা সে সবাইকে জানাবে, জানাবে তার দাবি, ভাবতে ভাবতে তার চেয়াল শক্ত হয়ে আসে।

দেওয়াল ঘড়িতে সকাল ছয়টা। সামারে নিউইয়র্কে সকাল ছয়টা মানে অনেক আলো। আজ ঘুম ভেঙ্গেছে আরও অনেক আগে তখনো দিনের আলো ধীরে ধীরে রাতের অন্ধকারকে সরিয়ে দিচ্ছে। সেই দিনও এমনি সকাল হচ্ছিল যে দিনের কথা সে কখনোই ভুলবে না, ভুলতে পারবে না।

আমেরিকায় তখন তারা নবাগত। অল্প ভাড়ায় একটা চিলেকোঠায় ভাড়া থাকত। তার মা একটা বেকারিতে সেলস গার্লের কাজ করতেন। খুব ভোরে কাজে যেতে হতো, তাই তিনি সকালেই উঠতেন। সেদিনও তিনি সবে উঠেছেন—এমন সময় দরজায় প্রচণ্ড জোড়ে দুম দুম শব্দ হতে লাগল, কড়া যেন দরজা ভেঙ্গে ফেলার মতো শব্দ করছে। সবাই ভয় পেয়ে গেল। বাবা দরজা না খুলে ইংরেজিতে বললেন ‘হু ইজ দিস?’ উত্তর এলে ‘দি ইজ আইস (ICE-- U.S. Immigration and Customs Enforcement's), ওপেন দা ডোর, উই আর লুকিং ফর মিস শায়লা’—আমার মায়ের নাম। বাবা দরজা খুলে দিলেন।

হাতে পিস্তল উঁচিয়ে একজন মহিলা আর একজন পুরুষ ঘরে ঢুকে তাদের ব্যাচ দেখাল। বাবাকে হাত উঁচু করে দেওয়ালের দিকে মুখ করে থাকতে বললো, আর বললো, ‘মিস শায়লা রহমান কাম হিয়ার উইথ হ্যান্ডস আপ’ আমি ভয়ে বাবাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকলাম। মা এগিয়ে এলো, তারা বললো মায়ের নামে ডেপুটেশন অর্ডার আছে, মা তা ভঙ্গ করে যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করছে, সুতরাং তাকে গ্রেপ্তার করে নিউ জার্সির ডিটেনশন সেন্টারে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।

অলংকরণ: আরাফাত করিম

মাকে হাতে হাতকড়া পরিয়ে সবার সামনে দিয়ে নিয়ে চলে গেল। ঘটনার আকস্মিকতায় বাবা আর মালিহা হতবিহ্বল হয়ে পড়ল। তারা মায়ের চলে যাওয়ার পথের দিকে তাকিয়ে কাঁদতে থাকল। আজও সেই দিনের সেই দৃশ্য তাকে তাড়া করে বেড়ায়। হাতে পিস্তল উঁচিয়ে ঘরে ঢোকার সেই দৃশ্য সে ভুলতে পারে না। সেই দৃশ্যটি নানাভাবে তার স্বপ্নে আসে।

বাবা একজন ল ইয়ারের কাছে গেলেন। কিন্তু কোন কাজ হলো না। দুই দিন পরই তার মাকে প্লেনে উঠিয়ে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেওয়া হলো—সে আজ প্রায় ৯ বছর আগের ঘটনা। তারও আগে তার মা–বাবা যুক্তরাষ্ট্রে আসে তখন মালিহার বয়স ছয় কি সাত বছর। দেশে মা–বাবা রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত ছিল। তারা এদেশে এসেই রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনা করে। তার বাবার এপ্লিকেশন মঞ্জুর হলেও মায়ের নামে ডেপুটেশন আদেশ জারি হয়। যদিও আরও হাজারো হাজার ইমিগ্রেন্টের মতো তার মা সেই আদেশ এড়িয়ে এখানে অবস্থান করতে থাকেন।

মালিহা আর তার বাবা যখন স্টেডিয়ামে পৌঁছাল তখন অনুষ্ঠান শুরু হতে অল্প সময় বাকি। আজকে গ্র্যাজুয়েশনে প্রধান বক্তা স্থানীয় সিনেটর চাক সুমার। ভ্যালেডিক্টোরিয়ান হিসাবে সব ছাত্রর পক্ষ থেকে বিদায়ী ভাষণ দিবে মালিহা। সিনেটর আর ইউনিভার্সিটি প্রেসিডেন্টের মাঝের আসনে বসেছে সে। মঞ্চে একে একে অনেক বক্তা শিক্ষামূলক বক্তৃতা দিলে।

বিপুল করতালির মধ্যে মালিহাকে ভ্যালেডিক্টোরিয়ানের ভাষণ দিতে নাম ঘোষণা করা হলো—

‘আজ আমাদের একটা আনন্দের দিন। আমি যুক্তরাষ্ট্রের ছায়ায় বসবাসকারী ১১ মিলিয়ন অ-নথিভুক্ত অভিবাসীদের মধ্যে একজন। আমি আজ আপনার সামনে দাঁড়ানোর এবং এই অপ্রত্যাশিত বাস্তবতাগুলো প্রকাশ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি, কারণ, এটিই হতে পারে আপনাদের সবার কাছে সত্য জানানোর একমাত্র সুযোগ যে অ-নথিভুক্ত অভিবাসীরাও মানুষ, স্বপ্ন, আকাঙ্ক্ষা, আশা নিয়ে তারা যুক্তরাষ্ট্রের সমাজ এবং জীবনধারার একটি অংশ হয়ে উঠেছে, আসুন ঘৃণা ও কুসংস্কারের ওপর প্রাচীর নির্মাণ না করে যুক্তরাষ্ট্রকে আবার মহান করতে সাহায্য করি.. ’ এর পর কাঁদো কাঁদোভাবে তার মাকে ধরে নিয়ে যাওয়ার স্মৃতিচারণা করে বলে সেই দৃশ্য এখনো আমাকে শৈশব থেকে তাড়া করে ফিরছে।

আমার মতো আর কারও যেন এই রকম অবস্থা না হয়, তার জোর দাবি জানাচ্ছি। আজ এই অনুষ্ঠানে আমরা যারা গ্র্যাজুয়েট হয়েছি, সবারই মা হয়তো উপস্থিত আছেন, কিন্তু আমার ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম, আমাকে মায়ের আদর দিয়ে বড় করেছেন আমার বাবা, আমার মেয়েলি প্রয়োজনেও মিটিয়েছেন তিনি—বাবা গ্যালারিতে একটু উঠে দাঁড়াও আমি তোমাকে অভিবাদন জানাতে চাই...’ মালিহার বাবা স্টেডিয়ামের গ্যালারিতে দাঁড়িয়ে হাত উঠালেন—সমবেত জনতা হাত নাড়িয়ে ধ্বনি দিয়ে তাঁকে অভিবাদন জানাল।

অনুষ্ঠান শেষে সিনেটার সুমার মালিহাকে কাছে ডেকে তার চমৎকার আর সুন্দর বক্তৃতার জন্য ধন্যবাদ দিয়ে বললেন, ‘আমি তোমার মায়ের জন্য ঢাকার আমেরিকান দূতাবাসে চিঠি পাঠাব, আশা করি তারা তোমার মাকে তোমার সঙ্গে মিলিত হতে সাহায্য করবে।’ কয়েক দিন পর সিনেটরের সেই চিঠির একটি কপি ডাকে মালিহার কাছে এলো।

মাসখানেক পর আজ ঢাকা দূতাবাসে মালিহার মায়ের ইন্টারভিউ। ঢাকার সময় বেলা দুইটা অর্থাৎ নিউইয়র্ক সময় রাত তিনটায়...নির্ঘুম রাতে দুরুদুরু বুকে মালিহা তার মায়ের টেলিফোনের অপেক্ষা করতে লাগল। সত্যি কি তার মাকে বিশেষভাবে ভিসা দেবে? এই বুঝি সুখবরের বার্তা নিয়ে টেলিফোন এল। অধীর আগ্রহে সে অপেক্ষা করতে থাকে...কখন টেলিফোন আসে।

  • লেখক: আবদুল্লাহ জাহিদ, ব্যবস্থাপক, কুইন্স লাইব্রেরি, হলিস, নিউইয়র্ক, আমেরিকা