কোরিয়ায় দেখা আমার ৬টি গ্রীষ্ম

দক্ষিণ কোরিয়ায় যখন আমি মাস্টার্স করছি; তার পাশাপাশি সময় বের করে ছোট ছোট কিছু কোর্স করার চেষ্টা করতাম। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল লিডারশিপ একাডেমির কোর্সটা। প্রতি সপ্তাহের ক্লাসেই নতুন নতুন চমক অপেক্ষা করত আমাদের জন্য। কোর্সের প্রধান ছিলেন একজন জাতীয় অধ্যাপক। কোর্সটি সম্পূর্ণ ফ্রি ছিল সে দেশে পড়তে যাওয়া বিদেশি ছাত্রছাত্রীদের জন্য। মূলত উদ্দেশ্য ছিল তাদের অসাধারণ উন্নয়নের ইতিহাস দুনিয়াকে জানানো। কিংবা উদাহরণ হিসেবে উপহার দেওয়াও বলা যায়। কোর্সটা সাজানো হয়েছিল দেশটির ফাস্ট ডেভেলপমেন্ট বা অতি দ্রুত হওয়া উন্নয়ন নিয়ে (বিশ্বে যার চিত্র দুর্লভ) এবং তাদের ক্যারিশমেটিক লিডার কীভাবে বিভিন্ন উন্নত দেশের উন্নয়নের পদ্ধতি দেখে এসে অনুকরণ করে একেক পা করে একেজন করে পুরো দেশের মানুষকে নিয়ে দেশটিকে অন্যতম উন্নত দেশ হিসেবে বিশ্বমানচিত্রে নিজেদের তুলে ধরেছিল, তার ইতিহাস, পদ্ধতি, সফলতা ও ব্যর্থতা আদলে এক শক্তিধর নেতা বা লিডারশিপ পাঠ।

সেই একাডেমিতেই প্রথম শুনেছি, পাহাড়ি এই দেশটা কেমন গাছশূন্য ছিল। পাথরের পাহাড়ের ষাট-সত্তরের দশকের ছবি প্রজেক্টরে ভাসতেই সবাই ধাক্কার মতন খেলাম। কারণ, বর্তমানে আমরা চারপাশে যত পাহাড় দেখি, তা ঘন সবুজ বনের পাহাড়। কীভাবে দক্ষিণ আমেরিকার এক দেশ থেকে অনুকরণ করে পাথরের পাহাড়ে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট গাছ লাগানো শুরু করলেন, আমরা সে গল্প শুনি মুগ্ধ হয়ে। আমার নিজের দেশের মাটি কত ভালো পেয়েছি আমরা ভেবে নিজেদের সৌভাগ্যবান ভাবছিলাম। পরক্ষণেই বাস্তবে ফিরে আসি, বিধাতা প্রদত্ত কী পেলাম, তা–ই শেষ কথা নয়; আমরা তা–ই ভোগ করি, যা আমরা নিজে অর্জন করি।

দেশটার উন্নয়নের স্বপ্ন দেখে তখনকার নারীরা তাঁদের শেষ সম্বল সোনার অলংকারগুলোও ডেভেলপমেন্ট ফান্ডে দিয়ে দিয়েছিলেন। ছেলে, মেয়ে ও সব বয়সের, সব স্তরের মানুষ রাস্তা মেরামতের কাজে অংশ নিয়েছিলেন। এমন নজির অন্য দেশে আছে কি না, তা আমার জানা নেই।

তাদের তৎকালীন প্রেসিডেন্টের উদ্দেশ্য ছিল পরিষ্কার, জনগণ যখন নিজেরা রাস্তা বা দেশ তৈরি করবে, তখন তা নষ্ট হতে দেবে না। যার প্রমাণ আমি অনেককাল পরে কোরিয়ার পথে দেখে এসেছি, কীভাবে তারা সন্তানের মতো নীরবে দেশটা আগলে রেখেছে। ছুটির দিনে একদিন দেখা মিলেছিল একজন শিল্পপতি বয়স্ক ভদ্রলোকের, যিনি ভলান্টিয়ার হয়ে রাস্তায় আবর্জনা পরিষ্কার করছেন আপনমনে। ভালোবাসা, শ্রদ্ধা, সম্মান দেখানোর ব্যাপারগুলো ঢোল না পিটিয়ে কাজে প্রকাশের অসাধারণ সুন্দর রূপটা বইয়ের বাইরে এ জাতিকে প্রকাশ করতে দেখছিলাম।
 
কোরিয়ায় গ্রীষ্মকালীন তাপমাত্রা ২৩ থেকে ৪১ ডিগ্রি সেলসিয়াস (১০৫.৮ ফারেনহাইট) পর্যন্ত। গরম পড়তে পড়তে হইহই করে সবার গ্রীষ্ম উদ্‌যাপনের পরিকল্পনা শুরু হয়ে যায় প্রকৃতির সঙ্গে। প্রতিটি বাড়ির সামনে রঙিন ফুলের বাগানে সেজে ওঠে। সরকার থেকে শীতে গাছের শিকড় ঢেকে বিশেষ কায়দায় বাঁচানো হয় রাস্তা আর পার্কের গাছগুলো। সেই গাছও নতুন করে সেজে ওঠে আপন রঙে।

কী সুন্দর শৈশবের দেখা মেলে দেশটির পথেঘাটে। বাচ্চাদের শীতের প্রকোপ থেকে বাঁচতে অন্দরমুখী থাকার পর সামার এলে যেন পূর্ণশক্তিতে ডানা মেলে। রঙিন রঙিন স্কুটি করে শহরের নিচের লেকপাড় ধরে ছুটে চলে। কেউবা চকচকে রোদের সঙ্গে খেলে বেড়ায়, তো কেউ হাজারো ফুলের মাঝে প্রজাপতি হয়ে উড়ে বেড়ায়। অসামান্য এ জীবনকে নিয়ে প্রকৃতিকে সঙ্গে করে নানান আয়োজনে উদ্‌যাপন।

আমি সেখানে বসে তাদের জীবন উদ্‌যাপন থেকে আমার প্রিয় জন্মভূমিতে ফিরতাম। গ্রীষ্মের দাবদাহে দগ্ধ মাঠে এক কৃষকের সঙ্গে দেখা হয়ে যেত তখন। রোজায় অফিস থেকে ফেরার পথে রোজ রিকশাওয়ালা মামার কাছে যানতে চাইতাম গরমে রোজার দিনের খোঁজ খবর, আফসোস কণ্ঠে ঘামে ভেজা কাপড়ের ষাটোর্ধ্ব মানুষটার রোজা না রাখতে পারার গল্পগুলো মনে পড়ে যেত।

আচ্ছা, প্রকৃতির সান্নিধ্য আমরা ছেড়ে দিয়েছি কেন? এত গাছ কেটে দালানের পর দালান করে শহুরে হতে হয়েছে কেন? প্রকৃতি আর আধুনিকতা যায় না একসঙ্গে বলে? কোরিয়া এসে সব প্রশ্নের জবাব একসঙ্গে পেয়েছিলাম, একই সঙ্গে বিশ্বসেরা প্রযুক্তি আর চোখ জুড়ানো শীতল প্রকৃতি হাত ধরাধরি করে চলছে দেখে।

এক দিনের পরিকল্পনায় কোনো দেশ যেমন তৈরি হয় না, তেমনই টাইট পেক অট্টালিকার শহরে ভবন উপড়ে ফেলে গাছও লাগানো হয় না। সব উন্নত দেশেই গাছ কাটার ওপর আইন আছে। গাছ বাঁচিয়ে নিজেরা বাঁচতে জানে।

আমি তবু দূরদেশে বসে স্বপ্ন দেখি, আমার ছোটবেলার ছোট সবুজে ঘেরা সে শহরে ফিরি। দালানে দালানে সে শহরে আজ ভরদুপুর।

*লেখক: তাহনিয়া কাদের, জর্জিয়া, যুক্তরাষ্ট্র