পৌষ সংক্রান্তিতে চা–বাগানে টুসু গান, চর্চার অভাবে হারিয়ে যাচ্ছে
চর্চার অভাবে হারিয়ে যাচ্ছে টুসু গান। মূলত এ গানটি গাওয়া হয় বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলের চা–বাগানগুলোয়। এ গান গাওয়া হয় বছরের একটি নির্দিষ্ট সময়ে, সেটা হচ্ছে পৌষ সংক্রান্তির দিন। গত রোববার ছিল পৌষ সংক্রান্তি। দেশের বিভিন্ন চা–বাগানগুলোতে এ গান গাওয়া হয় সেদিন। সাধারণত বালিকা ও তরুণীরা দল বেঁধে বাড়ি বাড়ি গিয়ে এ গান গেয়ে থাকেন। সংখ্যায় তরুণীরা বেশি থাকলেও তাঁদের গানে ঢোল, হারমোনিয়াম, মন্দিরা, মৃদঙ্গসহ বিভিন্ন ধরনের বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে তরুণেরাও সাহায্য করে থাকেন।
গানের উল্লেখযোগ্য দিক হচ্ছে তাৎক্ষণিক তরুণীরা গান রচনা করে পরিবেশন করেন। সামনের মানুষজন, প্রকৃতি, আবহাওয়া, সুখ–দুঃখ, মান–অভিমান, বিরহ, আনন্দ নিয়ে তাঁরা গান রচনা করে গেয়ে থাকেন। গান গাওয়ার সময় সামনে যাঁরা থাকেন বা বাড়ির মালিক, তাঁর ছেলেমেয়ে, স্ত্রী বা গৃহস্থকে নিয়ে তাৎক্ষণিক গান রচনা করে পরিবেশন করেন। এতে তাঁরা ওই ব্যক্তির প্রশংসা বা বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য তুলে ধরেন, যা মানুষ খুব উপভোগ করেন। সমকালীন রাজনীতি, বিবাহিত নারীর সুখ–দুঃখ, পণপ্রথা, সাক্ষরতা সম্বন্ধে সচেতনতা, বধূ নির্যাতন বিষয়েও তাঁরা গান রচনা করে গেয়ে থাকেন।
প্রায় প্রতিটি চা–বাগানেই টুসু গানের একাধিক দল রয়েছে। তাদের মধ্যে রয়েছে প্রতিযোগিতা। ভোরে ওঠে স্নান সেরে টুসু দেবীর পূজা করে টুসুকে একটি রংবেরঙের কাগজ ও ফুল দিয়ে সাজানো ছোট কুরসিতে বসিয়ে মাথায় নিয়ে গ্রামে বা চা–বাগানের বিভিন্ন বাড়ি বাড়ি গিয়ে নাচ, গান করে থাকেন। এ সময় তাঁরা রংবেরঙের বিভিন্ন পোশাক পরে থাকেন। তরুণদের মধ্যে কেউ কেউ মাথায় পাগড়ি বেঁধে নাচেন। বিভিন্ন বাড়িতে গান পরিবেশনের পর গৃহস্থ তাঁদের ফলমূল, পিঠাপুলি দিয়ে আপ্যায়ন করেন।
বিভিন্ন চা–বাগানে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আগের মতো, বিশেষ করে আজ থেকে ২০-২১ বছর আগে টুসু গানের যে প্রচলন ও ব্যাপকতা ছিল, এখন তা আর নেই। চর্চার অভাবে হারিয়ে যাচ্ছে চা–বাগানের জনপ্রিয় টুসু গান।
টুসু উৎসব একটি লোকোৎসব। এ উৎসব শুরু হয় অগ্রহায়ণ মাসের শেষ দিনে এবং শেষ হয় পৌষ মাসের শেষ দিন, অর্থাৎ সংক্রান্তির দিন। টুসু একজন লৌকিক দেবী, যাকে কুমারী হিসেবে কল্পনা করা হয় এবং কুমারী মেয়েরাই এই পূজা ও ব্রত করে থাকেন। এটি একটি কৃষিভিত্তিক উৎসব। ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, ঝাড়খন্ড, ওডিশার বিভিন্ন স্থানে ও বাংলাদেশের সিলেটের বিভিন্ন চা–বাগানে এ উৎসব পালন করা হয়। টুসু গান এ উৎসবের বিশেষ অঙ্গ ও মূল আকর্ষণ। টুসু গানের রয়েছে বহুমাত্রিকতা।
সমাজজীবনের বিভিন্ন ঘাত–প্রতিঘাত, আনন্দ–বেদনা হয়ে উঠেছে টুসু গানের মূল বিষয়বস্তু। এখানে সবাই গায়ক–গায়িকা। এতে সবাই অংশগ্রহণ করে থাকে।
টুসু গান একসময় অন্যায়ের, প্রতিবাদের হাতিয়ার হয়ে উঠেছিল। ১৯১২ সালে বাংলা ভাষার ওপর হিন্দির আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টার প্রতিবাদে মানভূম অঞ্চলে ভাষা আন্দোলনের সূচনা হয়। টুসু সত্যাগ্রহ ভারতের বাংলা ভাষা আন্দোলনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। মানভূমের বাংলা ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে হিন্দি ভাষা চাপিয়ে দেওয়ার প্রতিবাদে বৃহৎ মানভূম অঞ্চলের জনগণ নিজেদের সাংস্কৃতিক আভিজাত্যকেই প্রতিবাদের হাতিয়ার করে রাস্তায় নামেন। তাঁরা প্রতিবাদী ভঙ্গিতে টুসু গান গেয়ে আন্দোলন শুরু করেন। মানভূমের এই ভাষা আন্দোলন পৃথিবীর ইতিহাসে ঘটে যাওয়া দীর্ঘতম ভাষা আন্দোলন।
বিভিন্ন তথ্য–উপাত্ত থেকে জানা গেছে, টুসু উৎসব অগ্রহায়ণ সংক্রান্তি থেকে পৌষ সংক্রান্তি পর্যন্ত এক মাস ধরে পালিত হয়। ধানের খেত থেকে এক গোছা নতুন আমন ধান মাথায় করে এনে খামারে পিঁড়িতে রেখে দেওয়া হয়। অগ্রহায়ণ মাসের সংক্রান্তির সন্ধ্যাবেলায় গ্রামের কুমারী মেয়েরা একটি পাত্রে চালের গুঁড়া লাগিয়ে তাতে তুষ রাখেন। এরপর তুষের ওপর ধান, কাড়ুলি বাছুরের গোবরের মণ্ড, দূর্বা ঘাস, আকন্দ, বাসক ফুল, কাচ ফুল, গাঁদাফুলের মালা প্রভৃতি রেখে পাত্রটির গায়ে হলুদ রঙের টিপ লাগিয়ে পিঁড়ি বা কুলঙ্গির ওপর রেখে স্থাপন করা হয়। পাত্রের এই পুরো ব্যবস্থা প্রতিদিন সন্ধ্যার পরে টুসু দেবী হিসেবে পূজিত হন। পৌষ মাসের প্রতি সন্ধ্যাবেলায় কুমারী মেয়েরা দলবদ্ধ হয়ে টুসু দেবীর কাছে তাঁদের ব্যক্তিগত ও সামাজিক অভিজ্ঞতা সুর করে নিবেদন করেন ও দেবীর উদ্দেশে চিড়া, গুড়, বাতাসা, মুড়ি, ছোলা ইত্যাদি ভোগ নিবেদন করেন।
দূর পরবাসে লেখা, গল্প, ভ্রমণ অভিজ্ঞতা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। মেইল অ্যাড্রেস [email protected]