রয়্যাল আলবার্ট হল মাতাল সৌধের ‘শৃঙ্গার ও পার্থিব প্রণয়ের গান’

বিশ্ববিখ্যাত রয়্যাল আলবার্ট হল মাতিয়েছে ব্রিটেনে দক্ষিণ এশীয় শিল্পের শীর্ষস্থানীয় সাংস্কৃতিক সংস্থা সৌধের অভিনব প্রযোজনা ‘শৃঙ্গার ও পার্থিব প্রণয়ের গান: ঠুমরি থেকে ট্রুবাডোর’। ১৫ জানুয়ারি সোমবার হলের এলগার রুমে কানায় কানায় পূর্ণ দর্শকেরা পিনপতন নীরবতা নিয়ে উপভোগ করেন শরীরী প্রেম নিয়ে ও জগতের বিচিত্র সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের প্রাচীন সংগীত, কবিতা ও চিত্রকলা দিয়ে রচিত এক নতুন শিল্প-ভাষ্য।

পরিবেশনা শেষে দর্শকেরা নিজেদের উচ্ছ্বাসিত প্রতিক্রিয়াও জানিয়েছেন। গ্রীক সংগীত রচয়িতা এলিস বলেছেন, ‘আড়াই ঘণ্টার এক বিশুদ্ধ সম্মোহন ছিল পুরো প্রযোজনা।’ ব্রিটিশ–কেনিয়ান দর্শক সুরিন্দা বলেছেন, ‘আমার সারা শরীর ও মন কাঁপছে, এমনই অমোঘ এই সংগীত ও পুরো পরিবেশনার অভিঘাত।’

ব্রিটিশ সংগীতশিল্পী নিক পার্কিন বলেন, এমন সম্মোহনী পরিবেশনা অবশ্যই রয়্যাল আলবার্ট হলের বৃহত্তম মঞ্চে পরিবেশিত হওয়া উচিত। সাজদা ফ্যাস্টিভালের পরিচালক রাহুল লউদ বলেছেন, ‘এটি মুষ্টিমেয় কিছু বুদ্ধিবৃত্তিক শিল্প-প্রকল্পের একটি, যা একজন দর্শক খুব কমই প্রত্যক্ষ করার সুযোগ পান।’

টি এম আহমেদ কায়সারের পরিচালনা ও  গ্রন্থনায় মঞ্চস্থ এ নতুন শিল্প-প্রকল্পে খ্রিষ্টপূর্ব ৩০০ বছর আগে গ্রীক ভাষায় রচিত ইতিহাসের প্রথম সংগীত সিকিলোস এপিটাফের সঙ্গে উপনিষদের স্তোত্র, এর সঙ্গে পৃথিবীর আদি-কবি এনহেদুয়ানার (খ্রিষ্টপূর্ব ২,০০০) কবিতা, চতুর্থ শতকের সংস্কৃত কবি কালিদাস ও সপ্তম শতকের কবি আমারুর ইন্দ্রিয়-প্লাবী কবিতার উপস্থাপনা হলজুড়ে স্বর্গীয় অথচ সমানভাবে রক্ত-মাংসের এক পার্থিব ঘোর তৈরি করে। তা ছাড়া সপ্তদশ শতকের ভারতীয় ধ্রুপদী সংগীত রচয়িতা সদারঙ্গের জনপ্রিয় ভিমপালশ্রী বান্দিশের সঙ্গে ১২ শতকে দক্ষিণ ফ্রান্সের অক্সিটান ভাষায় র‍্যাবো ভাকারেস ও বার্নার্ট বেন্টাডন রচিত ট্রুবাডোরের সমবায়ী অথচ শ্বাসরুদ্ধকর পরিবেশনা অনেক দিন মনে থাকবে বলেও মন্তব্য করেছেন একাধিক দর্শক।  

পঞ্চম শতকে প্রাক-ইসলামি যুগের কবি ইমরুল কায়েসের কবিতার সঙ্গে মোহ-জাগানিয়া মধ্যযুগের আরবি সংগীত, দুই হাজার বছরের প্রাচীন চীনা বাদ্যযন্ত্র গুজেঙের সঙ্গে মধ্যযুগের মোঙ্গলিয়ান লোকসংগীত, চীনা টাঙ রাজ্যকালের কবি দু কুইনাঙের কবিতা, এগারো শতকে ইতালির সিসিলি সম্রাট ফ্রেডেরিকোর শরীরী প্রণয়ের পঙ্‌ক্তিমালা, এগারো শতকের কাশ্মীরি কবি বিলহানা ও ষোল শতকে ভারতের অন্ধ কবি সুরদাস রচিত ভজন ছাড়াও মধ্যযুগের বাঙালি কবি চণ্ডীদাস, বাসুদেব ঘোষের সম্মোহনী শ্রীকৃষ্ণ-কীর্তন, মধ্যযুগ পরবর্তী কাম-প্রপঞ্চপ্রবণ ঠুমরি, হোলি, নিধুবাবুর টপ্পা, লালনের গানের অভিন্ন এবং অভূতপূর্ব  উপস্থাপনা আবার এসব বিচিত্র সংগীত ও কবিতার সমন্বয়ে সম্ভোগ ও ইন্দ্রিয়-সুখের নতুন নতুন অর্থ নির্মাণের উদ্যোগও এ প্রযোজনায় এক দার্শনিক গভীরতা যোগ করেছে।

সৌধের এই নতুন শিল্প-উদ্যোগে সংগীত পরিবেশন করেছেন দুই হাজার বছরেরও প্রাচীন চীনা বাদ্যযন্ত্র গুজেঙ বাদক ইজিয়া তু, গ্রিক-লেবানিজ কণ্ঠশিল্পী লারা ইদি, নিয়াপলিটান ট্রুবাডোর শিল্পী রসেলা বন্ডি, ভারত থেকে আসা হিন্দুস্তানি ধ্রুপদি শিল্পী ও ওস্তাদ রাশিদ খানের সংগীতশিষ্যা কোয়েল ভট্টাচার্য ও পণ্ডিত শুভঙ্কর ব্যানার্জির সংগীত শিষ্য কুন্তল দাস, ব্রিটিশ-বাংলাদেশি সংগীতশিল্পী গৌরি চৌধুরী, ফারজানা সিফাত, অমিত দে ও সৌমেন নন্দী। অপূর্ব কবিতা পাঠ করেছেন কবি ও কথাশিল্পী শ্রী গাঙুলী এবং আবৃত্তিকার তানজিনা নূর-ই সিদ্দীক। কিবোর্ডে সঙ্গত করেন সুনীল যাধব।

এই শিল্প-উদ্যোগের পরিচালক টি এম আহমেদ কায়সার বলেন, অনুষ্ঠানের তিন সপ্তাহ আগে থেকেই পরপর দুবারই সব টিকেট বিক্রি হয়ে যাওয়া আমাদের কাছে ছিল খুব আনন্দের ঘটনা! অনুষ্ঠানের পর থেকে আমরা এখনো দর্শকদের উদার প্রতিক্রিয়া পেয়ে যাচ্ছি। তিনি বলেন, সিলভিতা প্লাথের সৃষ্টকর্ম নিয়ে আমাদের পরবর্তী উদ্যোগও আশা করি এ বছরের শেষে আবার রয়াল আলবার্ট হলসহ দেশের আরও কিছু স্বনামধন্য ভেন্যুতে মঞ্চস্থ হবে!