দূরদেশে রমজান
রহমত, বরকত আর মাহফিরাতের বার্তা নিয়ে ধরণীতে আবির্ভূত হয় পবিত্র মাহে রমজান। মুসলিমবিশ্বে পবিত্র রমজানের পুরো মাসটিতেই উৎসব আর ধর্মীয় গাম্ভীর্যে সর্বদা ভরপুর থাকে। শেষ রাতে সাহ্রিতে ওঠা, জামাতে ফজরের নামাজ পড়ে একটু ঘুম; তারপর কর্মব্যস্ততায় নেমে পড়া। সারা দিনের ব্যস্ততাতেও রমজান মাসের আবহ থাকে সর্বত্র৷ এরপরে বিকেল থেকে চলে ইফতারির আয়োজন। আমি যখন ঢাকায় করপোরেটে চাকরি করেছি তখনকার অভিজ্ঞতা বলছি। অফিস কিছুটা আগে শেষ হয়। এবার সবার গন্তব্যে ফেরার পালা। ছোট-বড় রেস্তোরাঁ থেকে রাস্তার পাশের দোকান! কতশত ইফতারির বাহারি আয়োজন। আপাতত পছন্দমতো কিছু আইটেম নিয়ে ঘরে ফেরার পালা। ক্লান্ত-পরিশ্রান্ত দেহ আর রোজাদার মনে সে কি প্রশান্তি সর্বক্ষণ। ইফতারের আয়োজন শেষে রাতের নামাজের প্রস্তুতি। কি সুন্দর একটা রুটিনের মধ্যে দিয়ে যায় প্রত্যেকে!
আমার প্রবাস জীবনের প্রথম রমজান ছিল ২০১৭ সালে। দক্ষিণ কোরিয়ায় পড়াশোনার সময় সে সব রমজানের পবিত্র দিনগুলো কোনো দিক দিয়ে অতিবাহিত হয়ে গিয়েছে, তা খুব একটা টের পাইনি। কোরিয়ানরা এমনিতে ধর্মীয় কাজে খুব একটা আগ্রহী নয়। বরং রমজান নামক মাস আর রোজার সঙ্গে কোরিয়ানদের পরিচিত করিয়েছি সে সময় আমার মতো মুসলিম ছাত্ররাই। কোরিয়ার ল্যাবগুলোতে সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত কাজ করতে হতো। কাজের ফাঁকে নামাজ আর ইফতারের বিরতি ছাড়া রমজানে বিশেষ কিছুই ছিলো না সে সময়। তবে আমাদের ভার্সিটির মসজিদে প্রতি সপ্তাহের শেষে একটা ইফতারের আয়োজন থাকত। সেখানে বিশ-ত্রিশজনের মতো মুসলিম ছাত্র মিলে আমরা ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যে ত্রিশ পারা কুরআন খতম করতাম। এরপরে থাকতো দেশি-বিদেশি নানারকম ইফতারির আয়োজন। এটা আজও আমি মিস করি।
২০২৪ সালের রমজানে যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থানরত অবস্থায় প্রথমবারের মতো রমজান পালন করছি। এখানে এসে দেখেছি রমজান নামক জিনিসটির সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের কমবেশি সবাই পরিচিত। ‘ফাস্টিং’ নামক ধর্মীয় আচারটি ইহুদিদের মধ্যে প্রচলন থাকায় তারা ‘ফাস্টিং’–এর সঙ্গে এমনিতেই পরিচিত। তবে রমজানেরর সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের পরিচয় একটু বেশি হওয়ার কারণ হলো যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় ৩ দশমিক ৫ মিলিয়ন মুসলিম জনসংখ্যা। দেশটির কমবেশি বেশির ভাগ স্টেটের মুসলিম অধ্যূষিত শহরগুলোতে ইসলামিক সেন্টার রয়েছে। এসব ইসলামিক সেন্টার থেকে ইসলাম ধর্মীয় প্রচার ব্যাপকভাবে করা হয়ে থাকে।
রমজান মাসে এখানকার মুসলিমদের জন্য হালাল শপ ছাড়াও উপমহাদেশীয় শপগুলোতেও এ বিশেষ উপলক্ষকে সামনে রেখে সর্বত্রই বিশেষ আয়োজন চোখে পড়ে। সাধারণত আমেরিকার ছাত্রদের পড়াশোনা, ক্লাস, অ্যাসাইনমেন্ট আর ল্যাবওয়ার্কের মধ্য দিয়ে যেতে হয় বেশিরভাগ সময়। তাই রমজানে যথেষ্ট ব্যস্ত সময়ই কাটে এখানে গবেষণারত শিক্ষার্থীদের। তবে, এখানকার বাঙালি মুসলিম ছাত্ররা এত কিছুর মধ্যেও ইফতার পার্টির মতো আয়োজনগুলো ছোট ছোট পরিসরে আয়োজন করে থাকে। এতে বাঙালি মুসলিম সংস্কৃতিও ব্যাপকভাবে প্রচার পায়। মজার ব্যাপার হলো, আমেরিকানরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে এ অনুষ্ঠানগুলোতে অংশগ্রহণ করে থাকে। এসব আয়োজনে তাদের যে আন্তরিকতা, তা আসলে সরাসরি উপস্থিত না থেকে দেখে থাকলে বোঝা যায় না। এ ধরনের যেকোন আয়োজনে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও সহযোগিতা করে থাকে। কালচারাল ডাইভারসিটিতে ব্যাপকভাবে আগ্রহী মার্কিনিদের কাছে এ ধরনের আয়োজন তাই আলাদা আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে থাকে। রাতের নামাজের জন্য সবাই একনঙ্গে মসজিদে যাওয়ার কালচার যুক্তরাষ্ট্রে অধ্যয়নরত ছাত্রদের মধ্যে ব্যাপক প্রচলিত বলেই মনে হয়েছে আমার কাছে। শত ক্লান্তির মধ্যেও এ জিনিসগুলো মনকে দেয় অসাধারণ প্রশান্তি!
লেখা: মনোয়ার মাসুদ, গবেষণা শিক্ষার্থী, ইউনিভার্সিটি অব কেন্টাকি, কেন্টাকি, যুক্তরাষ্ট্র
*দূর পরবাসে ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল অ্যাড্রেস [email protected]