মুগ্ধর জীবন অথবা জীবনের মুগ্ধতা
বাংলা একাডেমি ‘আধুনিক বাংলা অভিধান বলছে মুগ্ধ একটি বিশেষণ, যার মানে মোহগ্রস্ত, বশীভূত (মন্ত্রমুগ্ধ), বিহ্বল, বিভোর (গুণমুগ্ধ), মূঢ়। জানি না মুগ্ধর মা–বাবা বা আত্মীয়স্বজন যাঁরা এমন নামকরণ করেছিলেন, তাঁরা কি আসলেই জানতেন একদিন এই ছেলে বড় হয়ে পুরো দেশের মানুষের পাশাপাশি সারা বিশ্বে ছড়িয়ে থাকা বাংলাদেশিদের একই সুতোয় বাঁধবে। সবাইকে তার গুণে মুগ্ধ করবে। আমরা সবাই তার আচরণ ও কাজকর্ম মোহগ্রস্ত হয়ে দেখব। মুগ্ধ আমাদের সামনে থেকে সরে গেলেও আমরা বিভোর হয়ে থাকব তার স্মৃতিচারণায়।
আমাদের দেশে বিভিন্ন সময়ে ছেলেসন্তানের নাম বিখ্যাত ব্যক্তিদের নামের সঙ্গে মিলিয়ে রাখা হয়। যেমন সাদ্দাম। আমি নিশ্চিৎ, এখনকার প্রজন্মের একটা বিশাল অংশের ছেলেসন্তানের নাম রাখা হবে মুগ্ধ। ভবিষ্যতে কেউ যদি আমাকে তার সন্তানের নামকরণ করতে বলে, ছেলেমেয়ে–নির্বিশেষে আমি তার নাম দেব মুগ্ধ। আমাদের দেশে একটা প্রবাদ বহুল প্রচলিত—বৃক্ষ তোমার নাম কী, ফলে পরিচয়। আমাদের মুগ্ধ নামে এবং ফলে দুভাবেই নিজেকে পরিচিতি দিয়ে গেছে। এখন আমরা মুগ্ধ নাম শুনলেই বুঝতে পারি কার কথা বলা হচ্ছে।
আশুরা ইসলামে একটি স্মরণীয় দিন। এদিন কারবালার প্রান্তরে ইমাম হোসাইন ইবনে আলী (রা.) মৃত্যুবরণ করেন। ‘কারবালা’ ফোরাত নদীর তীরে অবস্থিত একটি প্রান্তর। কারবালার ঘটনা ইসলামের ইতিহাসে অন্যতম বিয়োগান্ত ঘটনা। কুফার সুপ্রাচীন নদী ফোরাতের কূলে কারবালার প্রান্তরে যখন হোসাইন (রা.)-এর কাফেলা অবস্থান করছিল, তখন তাদের পানির একমাত্র উৎস ছিল নদীটি। এই নদী থেকে পানি সংগ্রহ করতে গেলে দুগ্ধপোষ্য শিশু আলী আসগর এক ফোঁটা পানির জন্য সিমারের বাহিনীর তীরের আঘাতে শহীদ হন। সেদিন ফোরাতকূলে যে ‘পানি পানি’ বলে মাতম উঠেছিল, তা অবর্ণনীয়।
কোটা সংস্কার আন্দোলনের একটা পর্যায়ে ছাত্ররা ১৭ জুলাই রাতে ১৮ জুলাইয়ের জন্য ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচির ঘোষণা করে। তখন ঢাকা শহরের পাশাপাশি পুরো দেশ যেন কারবালার প্রান্তরে রূপ নেয়। এদিন নিরস্ত্র ছাত্রদেরকে প্রতিহত করতে সরকারি পেটোয়া বাহিনী এবং পুলিশের পাশাপাশি মাঠে নামানো হয় বিজিবি। তখন সারা দেশ রণক্ষেত্র হয়ে ওঠে। প্রশিক্ষিত বাহিনীর বিপরীতে ছাত্রদের একমাত্র সম্বল ছিল নিজেদের প্রাণ। তাই তারা বুকে বুক বেঁধে প্রতিরোধের প্রাচীর গড়ে তুলেছিল। তখন মুগ্ধ স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে আন্দোলনকারীদের জন্য নিয়ে আসে পানি।
মুগ্ধ পানির কেস হাতে চিৎকার করছে আর বলছে, পানি লাগবে পানি। কাঁদানে গ্যাসের কারণে তার চোখ খুলে রাখতে সমস্যা হচ্ছে। গেঞ্জির হাতা দিয়ে চোখ মুছে সেটাকে খোলা রাখার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। মাত্র কয়েক সেকেন্ডের একটা ভিডিও। সামাজিক মাধ্যম না থাকাতে ভিডিওটা আমি দেখেছি অনেক পরে। যখন দেখছি, তখন জানলাম এই ছেলের নাম মুগ্ধ এবং সে এই ভিডিও ধারনের পনেরো মিনিট পর গুলিবিদ্ধ হন। এরপর মারা যান। এই ভিডিও দেখে কাঁদেনি এমন মানুষ বিরল। আমি যতবার দেখি, ততবার কাঁদি। এখন যখন লিখছি তখনো দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসছে।
আমি অত্যন্ত দুর্বল চিত্তের মানুষ। কোনো ভয়াবহ ঘটনা প্রত্যক্ষ করতে সাহস পাই না—হোক সেটা বাস্তবে বা সিনেমায়। কিন্তু এই ভিডিওটা আমি বহুবার দেখলাম, বহুবার কাঁদলাম; তবুও মনে হচ্ছে মনের গভীরে এক সমুদ্র অশ্রু জমে আছে। ভিডিওটা দেখার আরও একটা কারণ মুগ্ধর অফুরান প্রাণশক্তি। কী উদ্যম নিয়ে ছেলেটা চিৎকার করে যাচ্ছে। মুখের অভিব্যক্তিতে কী দৃঢ়তা। পরনের টি–শার্টটা পানিতে ভিজে গেছে। পায়ে ঘরে পরা স্যান্ডেল প্রমাণ দিচ্ছে মুগ্ধ কোনো পরিকল্পনা ছাড়াই রাস্তায় তার ভাইবোনদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল নিজের অন্তরের তাগিদে।
মুগ্ধ শহীদ হওয়ার পর ১৩ আগস্ট সিএনএন একটা প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে, যার শিরোনাম, ‘বিক্ষোভকারীদের হাতে পানির বোতল তুলে দিচ্ছিলেন এই ছাত্র, কয়েক মিনিট পরই তিনি মারা যান’।
সেখানে বলা হয়েছে, মুগ্ধর পুরো নাম মীর মাহফুজুর রহমান। তাঁর যমজ ভাই স্নিগ্ধ—মীর মাহবুবুর রহমান। রাজধানী ঢাকায় দুপুরের উত্তাপে বিশ্রাম নেওয়ার সময় একটি বুলেট তাঁর কপালে বিদ্ধ হয়েছিল। বন্ধু ও বিক্ষোভকারীরা তাঁকে হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিলেন। ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে যায়। স্নিগ্ধ জানান, ‘আমি শুধু তাঁকে জড়িয়ে ধরেছিলাম, আর আমি কেঁদেছিলাম।’
মুগ্ধ গণিতে স্নাতক ছিলেন। এরপর ব্যবসায় প্রশাসনে স্নাতকোত্তর (এমবিএ) শ্রেণিতে পড়ছিলেন, আর তাঁর যমজ স্নিগ্ধ আইনে স্নাতক। এই দুই যমজ ইতালিতে যাওয়ার পরিকল্পনা করেছিলেন। মোটরবাইকে ইউরোপ ঘুরে বেড়ানোর ইচ্ছা ছিল তাঁদের। ভ্রমণের জন্য টাকা জমাতেন তাঁরা। দুই ভাই অনলাইন ফ্রিল্যান্সার হাব ফাইভআরে সোশ্যাল মিডিয়া বিপণনের কাজ করতেন। স্নিগ্ধ বলেন, ‘সে শুধু আমার ভাই ছিল না, আমার সবচেয়ে ভালো বন্ধু ছিল। আমার শরীরের একটি অঙ্গ ছিল। আমরা একসঙ্গে সবকিছু করতাম।’
তাঁদের বড় ভাই দীপ্ত, যাঁর পুরো নাম মীর মাহমুদুর রহমান। দুই ভাই মুগ্ধের বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচয়পত্রটি রেখে দিয়েছেন। গুলিবিদ্ধ হওয়ার সময় এটি তাঁর গলায় ছিল। মুগ্ধের বিচ্ছুরিত রক্ত সেই অন্ধকার সময়ে দিনের প্রতীক হিসেবে পরিচয়পত্রটিতে শুকিয়ে গিয়েছিল। পরিচয়পত্রের ফিতাটি তাঁর ভাইয়েরা রেখে দিয়েছেন। এখন, প্রতিবাদ আন্দোলনে মুগ্ধ যে প্রভাব ফেলেছেন, তার থেকে সান্ত্বনা খোঁজার চেষ্টা করছেন দুই ভাই দীপ্ত ও স্নিগ্ধ। স্নিগ্ধ বলেন, ‘তার (মুগ্ধ) কারণে মানুষ প্রতিবাদ করার শক্তি পেয়েছে। সে সব সময় বলত, “আমি আমার মা–বাবাকে একদিন গর্বিত করব।”’
এরপর আমরা আমাদের কথায়, কাজে, পড়ায়, লেখায় যতবারই মুগ্ধ শব্দটা ব্যবহার করব, ততবারই আমাদের সামনে ভেসে উঠবে মুগ্ধর মুখটা। আমরা ততবারই মুগ্ধ হব মুগ্ধর আত্মত্যাগের কথা স্মরণ করে। আরও কত তাজা প্রাণ যে অকালে শহীদ হয়েছে, তাদের সবার পরিচয় জানা যায়নি। আসলে যারা শহীদ হন, তারা তো নিজেদের জীবন পরের তরে বিলিয়ে দেওয়ার জন্যই মৃত্যুর সামনে বুক পেতে দেন।
হে জেন-জি প্রজন্ম, আমরা তোমাদের কাজকর্মে মুগ্ধ। তোমাদের প্রতিবাদ আমাদের একজীবনের সবচেয়ে বড় মুগ্ধতা হয়ে থাকবে।
*দূর পরবাসে ছবি, লেখা ও ভিডিও পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]