প্রথম দেখা

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

আব্রাহাম, আজও জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখি চারদিক সাদা তুষারে ছেয়ে আছে।

তুষারপাত হয়েছে রাতে। ভোরের রোদে চিকচিক করছে চারপাশ। ফ্যাকাশে আপেলগাছে পাখির আনাগোনা নেই। শীতের প্রকোপ বেড়ে গেছে। পাখিরাও আশ্রয় নিয়েছে কোথাও। ভেতরটা ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। ভাবছি তোমার কথা। যোগাযোগ নেই অনেক দিন, মোবাইল নম্বরটাও হারিয়ে ফেলেছি, তাই মেইল লিখছি তোমায়। অনেক দিন থেকেই একটা প্রশ্ন ঘোরপাক খাচ্ছে। সেই প্রশ্নই করব তোমায়। তবে প্রশ্নে যাওয়ার আগে কিছু বলব, কিছু ব্যাখ্যা দেব, তাই মেইল শেষ না হওয়া অবধি ধৈর্য ধরতে হবে, ধৈর্য ধরে মেইলের শেষবিন্দু পর্যন্ত যেতে হবে।

তোমার হয়তো মনে নেই, কখন কবে সোনিয়া আমাদের সঙ্গে ক্লাস শুরু করেছিল।

আমার মনে আছে। আমাদের সাহিত্য ক্লাসের দ্বিতীয় সপ্তাহ। সে ক্লাসে এসেই চারপাশটা দেখে নেয়। ওর সাগর নীল চোখ দুটি আমিই প্রথম দেখেছিলাম। আমার প্রথম দেখা। প্রথম দিন ক্লাসে সে হয়তো নার্ভাস ছিল। আমার চোখ দুটো ওকেই দেখছিল, কোনো কিছুতেই মনোযোগ দিতে পারছিলাম না, শুধু সোনিয়াকে ছাড়া। তুমি এসব খেয়াল করোনি, করার কথা নয়।

আমি শুরু থেকেই বলতে চাই।

কারণ, এর সঙ্গে তোমার–আমার দীর্ঘদিনের বন্ধুত্ব, সোনিয়ার প্রতি দুর্বলতা–ভালোবাসা পেল্লবতায় জড়িত। ছোটবেলা থেকেই তুমি আমি একই প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গিয়েছি, বড় হয়েছি। যদিও আমাদের ভিন্নতা ছিল, তবে বন্ধুত্ব ছিল অভিন্ন। তোমার কি মনে আছে, আমাদের প্রথম পার্টির কথা? এলভিরা পার্টির আয়োজন করেছিল ওর বাসায়। ক্লাসের অনেকেই গিয়েছিল। একই সঙ্গে গিয়েছিলাম আমরা। আমরা গোল হয়ে বসে লটারি খেলছিলাম। আমাদের মধ্যে ছিল একটি কাগজের বাক্স। বাক্সের ভেতর ছিল ছোট ছোট চিরকুট। একেকজন একেকটা চিরকুট তুলছিল আর সে অনুযায়ী অভিনয় করছিল। তোমার চিরকুটে উঠেছিল উপস্থিত যে কোনো মেয়েকে তুমি চুমু খেতে পারো। খুব মজার ছিল খেলাটা। তুমিও মজা পাচ্ছিলে। মেয়েরা সবাই এসেছিল সেজেগুজে আকর্ষণীয় হয়ে। ওরাও হাসছিল। তুমি এগিয়ে গেলে লুইসার দিকে। লুইসা কপট নেত্রে তাকিয়ে ছিল, তবে বাধা দেয়নি। আমার চিরকুটে ছিল, কে বেশি সুন্দরী, তা বলা। মনে হয়েছিল, এর থেকে কঠিন কিছু আর নেই। আমি তাকিয়ে ছিলাম নীল চোখের সোনিয়ার দিকে, তবে কিছু বলিনি। মনে আছে আব্রাহাম, সেই দিনগুলোর কথা? আমার দৃষ্টি অনুসরণ করে তুমি সেদিন সোনিয়াকেও দেখেছিলে।

এরপর লুইসার সঙ্গে তোমার সম্পর্ক হলো। লুইসা থেকে এলভিরা। এলভিরা থেকে জেনি। তুমি যেন এক পাহাড় থেকে আরেক পাহাড়ে লাফিয়ে বেড়াচ্ছিলে। আমি আটকে ছিলাম সোনিয়াতেই। লুইসার সঙ্গে সম্পর্ক ভাঙার পর ওর অঙ্গ নিয়ে তুমি খুব বাজে মন্তব্য করেছিলে। ওই মন্তব্যে আমি সতর্ক হলাম। তুমি খেলাধুলা আর পার্টি নিয়ে মেতে উঠলে আর আমি সময় দিলাম পড়াশোনায়। কারণ, ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার ইচ্ছা ছিল আমার। তোমার সঙ্গে যোগাযোগ কিছুটা ছিন্ন হলো। এরপর তোমার সঙ্গে আবার দেখা হলো, যখন আমরা একই কলেজে এসে ভর্তি হলাম। স্কুল থেকে কলেজে এলেও তোমার ভেতর খুব একটা পরিবর্তন হয়নি। আগের মতোই তুমি নারী পরিবেষ্টিত ও খেলাধুলায় চৌকস। এলভিরার সঙ্গে তোমার সম্পর্কটা আবার জোড়া লেগেছে আর গড়িয়েছে বিছানা অবধি। এসবের ধারেকাছে আমি যেতে পারিনি, এমনকি সোনিয়ার কাছেও। তবে সোনিয়ার বিষয়টা তুমি জানতে, আমার পছন্দের কথা জানিয়েছিলাম।

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

তোমার কি মনে পড়ে অক্টোবর মাসের কথা?

ম্যাডাম বোর্ডে অঙ্ক করাচ্ছিলেন। অঙ্কটা ঠিক হয়েছে কি না, সবার মতামত জানতে চেয়েছিলেন ম্যাডাম। ক্লাসের ভেতর একমাত্র সোনিয়া অঙ্কে ভুল আছে বলে হাত তুলে ও ম্যাডামের আহ্বানে বোর্ডে গিয়ে সংশোধন করে। ক্লাস থেকে বের হয়ে আমার দুই কাঁধে হাত রেখে বলেছিলে, ‘মেয়েটা খুব সুন্দরী, ওকেই তো তুমি পছন্দ করো? পছন্দের কথা জানিয়েছ?’ সোনিয়াকে তখনো মনের কথা বলিনি, অনেক দ্বিধার মধ্যেও বলা হয়নি, তবে বলব। এর মধ্যে স্টুডেন্ট এক্সচেঞ্জ প্রোগ্রামে সুযোগ পেয়ে আমি অস্ট্রেলিয়ায় মেলর্বোন বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে যাই। এক্সচেঞ্জ প্রোগাম ছিল এক বছরের।

ফিরে আসার পর তোমার সঙ্গে যোগাযোগ হলো।

আমন্ত্রণ জানালে বাসায়, বললে সারপ্রাইজ অপেক্ষা করছে। বেডরুমে যেতে বললে। দেখি, সোনিয়া তোমার বিছানায়। জীবনে অনেক চমক পেয়েছি; কিন্তু এমন চমকের সম্মুখীন হয়নি। যে চমক হতাশার জন্ম দেয়। যে চমক ক্রোধের জন্ম দেয়। যে চমক নিঃস্ব করে দেয়। সোনিয়া কী করছে তোমার বিছানায়? শরীরের সব রক্ত জমা হলো মাথায়। কিছু একটা করতে ইচ্ছা হলো। কিন্তু না, বেরিয়ে এলাম তোমার ঘর থেকে।

তোমার মনে আছে আব্রাহাম?

পড়ার ফাঁকে ফঁকে আমরা সামার জব করতাম। আমার ইঞ্জিনিয়রিং তখনো শেষ হয়নি। টার্মিনের ফি জোগাতে কবরস্থানে কাজ পেলাম। আমাদের কাজ ছিল বিশাল কবরস্থানের ঘাস পরিষ্কার করা। কবরের পাশের ফুলগুলো সাজিয়ে রাখা। ফুল গাছে জল দেওয়া। ঝিমঝাম নির্জন পরিবেশে কাজ করতে ভালোই লাগত। শহর থেকে দূরে পাইনবনের ভেতর কবরস্থান। নাম লেখা পাথরের ফলকের পাশে কতশত মানুষ শুয়ে আছে, পরিবেশটাই আলাদা। আমার মতো অনেকেই পালা করে কাজ করত। ওখানেই দেখা হলো সরার ও তার ছোট বোন লির সঙ্গে। দুজনেই দুটি কলেজে পড়ত। কথায় কথায় সরা জানাল, লির সঙ্গে তোমার ভালোবাসার কথা। শুনে চমকে গেলেও বিশ্বাস হয়নি। তাহলে সোনিয়া? সরা আরও অনেক কিছু বললেও বুঝেছে, আমি ওকে বিশ্বাস করিনি। কারণ আমি ওভাবে তোমাকে দেখতে চাইনি।

দিন তিনেক পর সরা এসে জানাল, তুমি লির সঙ্গে দেখা করতে এসেছ।

আমিও দূর থেকে দেখলাম, কবরস্থানের এক পাশে যন্ত্রপাতি রাখা টিনের ছাউনি দেওয়া গুদামঘরে লিকে ভেতরে নিয়ে গেলে। চোখ দুটো বিশ্বাস করেনি। কিন্তু সত্য বড় কঠিন। সত্য বড় নির্দয়।

আব্রাহাম,

আমি আমার মেইলের শেষ প্রান্তে এসে গেছি। তুমি জেনেশুনে সোনিয়াকে আমার থেকে নিয়ে গেছ। বন্ধু হয়েও তুমি এটা করেছ। আমাকে কষ্ট দিয়েছ রাতের পর রাত, দিনের পর দিন। এখন দিচ্ছ সোনিয়াকে। এখন তোমায় প্রশ্ন করা যায়, ‘আমি কি সোনিয়াকে লির কথা জানাব?’

সুইডিশ লেখক মাগনুস লিনগ্রেনের গল্পের ছায়া অবলম্বনে লেখা

‘দূর পরবাস’-এ জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]