বাংলাদেশের সামনে তৃতীয় ঐতিহাসিক সুযোগ
২০২৪–এর ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থান বাংলাদেশের জনগণের সামনে ঐতিহাসিক এক সুযোগ এনে দিয়েছে। গত অর্ধশত বছরে এটি বাংলাদেশের জন্য তৃতীয় ঐতিহাসিক সুযোগ। এর আগের দুটি সুযোগ বিনষ্ট হয়েছে আমাদের নেতৃত্বের সংকীর্ণতা ও অদূরদর্শিতায়।
‘বিয়োগ চিহ্ন হলো একটি অসমাপ্ত যোগ চিহ্ন’—আগের দুটি বিয়োগ মিলিত হয়ে তৃতীয়বারে হয়তো একটি যোগফল মিলবে। আমাদের ইতিহাসের হারানো সেই দুটি সুযোগের দিকে দৃষ্টিপাত করা যাক, যাতে বর্তমানের জন্য কিছুটা শিক্ষা নেওয়া যায় (তবে ইতিহাসের শিক্ষা হলো—ইতিহাস থেকে কেউ শিক্ষা নেয় না)।
প্রথম ঐতিহাসিক সুযোগটি আসে নিঃসন্দেহে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর, যখন বাংলাদেশের জনগণ দেশ শক্রমুক্ত করে অপার সম্ভাবনার এক নবদিগন্ত সৃষ্টি করে। স্বাধীনতাযুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছিল আওয়ামী লীগ; তাই তাদের সবচেয়ে বেশি দায়িত্ব ছিল নব স্বাধীনতাপ্রাপ্ত দেশের জাতীয় ভিত্তি স্থাপন করা। তবে তারা দলীয় গণ্ডির বাইরে যেতে পারেনি বলে জাতীয় আকাঙ্ক্ষার বিনির্মাণ হয়নি। বাহাত্তরের জানুয়ারিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেশে ফেরেন। তাঁর কাছে গণমানুষের ছিল আকাশচুম্বী প্রত্যাশা। এ জাতির দুর্ভাগ্য, সে প্রত্যাশা পূরণ হয়নি, যার প্রধান কারণ ছিল—
১. জাতীয় সরকারের পরিবর্তে বঙ্গবন্ধু গঠন করেন আওয়ামী লীগ–দলীয় সরকার। এতে জাতীয় ঐকমত্য গড়ে নতুন দেশের দিকনির্দেশনা দেওয়ার ঐতিহাসিক দায়িত্ব ও সুযোগ বিনষ্ট হয়েছে।
২. পাকিস্তান আমলে অনুষ্ঠিত ও সে সময়কার আইনের অধীন নির্বাচনে নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের দ্বারা ১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বরে গণতান্ত্রিক এক সংবিধান প্রণয়ন করা হলো। তবে কোনো গণভোটের মাধ্যমে তার বৈধতা নেওয়া হয়নি।
৩. স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সংসদীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ১৯৭৩ সালের ৭ মার্চ, যা অবাধ ও নিরপেক্ষ হয়নি।
৪. সংবিধানের মূল ভিত্তি ‘গণতন্ত্র’ অপসারিত হলো একদলীয় ‘বাকশাল’ প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে, ১৯৭৫ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি।
ট্র্যাজেডির এখানেই শেষ নয়। এরপরের ইতিহাস আরও অনেক কটি ট্র্যাজেডির। এসবের পরও এল বাংলাদেশের আরেক সুযোগ—দ্বিতীয় ঐতিহাসিক সুযোগ। দ্বিতীয় ঐতিহাসিক সুযোগটি রাজনীতিবিদরা কীভাবে নষ্ট করল? ফিরে দেখা যাক।
আরেক ছাত্র-গণঅভ্যুত্থান সৃষ্টি করে বাংলাদেশের দ্বিতীয় ঐতিহাসিক সুযোগটি, ৯ ডিসেম্বর ১৯৯০ সালে নয় বছরের দীর্ঘ আন্দোলনে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের পতন হয়। ফলে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার দায়িত্ব নেয়। তার মাত্র ১৫ দিন আগে ১৯৯০ সালের ১৯ নভেম্বর বিএনপির নেতৃত্বে সাত দল, আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে আট দল এবং বামপন্থীদের নেতৃত্বে পাঁচ দল ঢাকায় আলাদা আলাদা তিনটি সমাবেশের মাধ্যমে একটি সমন্বিত রাজনৈতিক রূপরেখা ঘোষণা করে, যা ‘তিন জোটের রূপরেখা’ নামে পরিচিত। জাতীয় সব রাজনৈতিক দল মিলে তৈরি করেছিল সেই রূপরেখা, তাই এটি জাতীয় সনদে পরিণত হয়েছে—বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের এ এক ঐতিহাসিক দলিল।
‘তিন জোটের রূপরেখা’-র প্রধান দিক ছিল—
‘...স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ধারায় দেশে পূর্ণ গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা...’
‘...তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ হবেন, অর্থাৎ তিনি প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে কোনো রাজনৈতিক দলের অনুসারী বা দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত হবেন না...’
নূর হোসেন ও নয় বছরের আন্দোলনে আরও শহীদের রক্তে ভেজা ‘তিন জোটের রূপরেখা’-র প্রায় পুরোটাই বিসর্জন দিয়েছে প্রধান দুটি দল—বিএনপি ও আওয়ামী লীগ। এই বিসর্জনপ্রক্রিয়া শুরু করে বিএনপি, পরে আওয়ামী লীগ এ কাজটি সমাপ্ত করে।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে প্রথম নির্বাচনে জয়ী হয়ে বিএনপি ক্ষমতায় আসে ১৯৯১ সালে। প্রধানমন্ত্রী হলেন খালেদা জিয়া। মেয়াদ শেষ হওয়ার পর ১৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৯৬ সালে নির্বাচন দিলেন দলীয় সরকারের অধীনে। বিসর্জন দেওয়া হলো ‘তিন জোটের রূপরেখা’র তত্ত্বাবধায়ক সরকার। শুরু হলো তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আওয়ামী লীগ ও অন্যান্য দলের তীব্র আন্দোলন। বাংলাদেশে রাজনৈতিক সংঘাত, প্রাণহানি ও সম্পদহানির এক বিষাদময় অধ্যায়ের সূচনা হলো। অবশেষে বিএনপি বাধ্য হলো তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে। তার আগে সংসদে পাস করিয়ে নেয় ১৩তম সংশোধনী, যার মাধ্যমে সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সংযোজিত হলো।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে দ্বিতীয় নির্বাচনে জয়ী হয়ে আওয়ামী লীগ ২১ বছর পর ক্ষমতায় আসে জুন ১৯৯৬ সালে। ৫ বছরের শাসন শেষ করে জুলাই ২০০১ সালে তারা যথারীতি তৃতীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করে।
বিএনপির নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট নির্বাচনে জয়ী হয়ে ক্ষমতা নেয় অক্টোবর ২০০১ সালে। ৫ বছরের শাসন শেষ করে ২০০৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে বিএনপি নতুন খেলায় মেতে উঠল। পছন্দমতো ব্যক্তিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হিসেবে পেতে তারা অসাংবিধানিকভাবে প্রধান বিচারপতির অবসরের বয়স বৃদ্ধি করে। আওয়ামী লীগ ও অন্য দলগুলো তা মানতে অস্বীকার করে শুরু করে আন্দোলন।
আবার শুরু হলো দুই দলের লড়াই—সারা দেশ, দেশের মানুষ জিম্মি হয়ে গেল তাদের কাছে; শুরু হলো সংঘাতের রাজনীতি—ক্ষমতার লড়াইয়ে প্রাণ হারাল অগণিত ছাত্র-জনতা, দেশের বহু সম্পদ বিনষ্ট হলো, ক্ষতিগ্রস্ত হলো দেশের অর্থনীতি।
ফলে দেশে এল ‘ওয়ান–ইলেভেন’, যাতে ১১ জানুয়ারি ২০০৭ সালে সেনা–সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতা গ্রহণ করে। এই সরকার ২৯ ডিসেম্বর ২০০৮ সালে নির্বাচন দেয়, যাতে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট বিজয়ী হয়ে ৬ জানুয়ারি ২০০৯ সালে আবার ক্ষমতায় আসে। শুরু হয় বাংলাদেশের রাজনীতির আরেক অধ্যায়, যার অধিকাংশই তমসাচ্ছন্ন।
দ্বিতীয় দফায় দেশ শাসনে এসে শেখ হাসিনা ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করতে শুরু করলেন। তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা নিয়ে বিএনপির সেই অতীত রাজনীতি তিনি ভোলেননি। এবার তাই যেন তাঁর প্রতিশোধ নেওয়ার পালা। ২০১১ সালের ৩০ জুন সংসদে পঞ্চদশ সংশোধনী পাস করে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান সংবিধান থেকে বিলুপ্ত করেন। এ যেন মাথা কেটে মাথাব্যথার চিকিৎসা করা হলো। আওয়ামী লীগ ও তার জোটের বাইরের সব দল পঞ্চদশ সংশোধনীর বিরোধিতা করে প্রতিবাদে নেমে পড়ে। বাংলাদেশের রাজনীতির অশনিসংকেত বেজে ওঠে। বাংলাদেশ আবার ফিরে যায় সংঘাতের রাজনীতিতে, মিটিং-মিছিল-হরতাল-অবরোধ-জ্বালাও-পোড়াও-প্রাণহানি-সম্পদহানি—এ চক্রে আবার নিপতিত হয় দেশ ও দেশের মানুষ। জনমত উপেক্ষা করে আরও বেশি ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করলেন শেখ হাসিনা, তিনি ক্রমে একক ক্ষমতার কেন্দ্রে পরিণত হন। দেশের প্রায় সব প্রতিষ্ঠান, যেমন বিচার বিভাগ, শিক্ষা বিভাগ, প্রশাসন—চরম দলীয়করণে তাদের স্বাধীন সত্তা হারাতে শুরু করে। দল ও সরকারের বিভাজন রেখা মুছে যায়। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় সব ক্ষেত্রে চলে চরম দুর্নীতি। বাক্স্বাধীনতা হয় সংকুচিত, দমন-নিপীড়ন হয় সরকারের টিকে থাকার অপকৌশল।
বাংলাদেশের ইতিহাসে এ দেশের জনগণ কোনো অন্যায়কে মেনে নেয়নি, তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদে হয়েছে সোচ্চার। ২০২৪ সালও ইতিহাসের সেই ধারায় শামিল হয়েছে। ছাত্রদের কিছু দাবির আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে দেশের পথে–প্রান্তরে, জনস্রোত এসে মিশেছে সহস্র ধারায়—যেমন বাংলাদেশের শত নদী এসে মিশেছে বঙ্গোপসাগরে। উত্তাল সাগরের ঢেউ ঠেকাতে পারে সাধ্য কার? ছাত্র-জনতার সেই ঢেউয়ে তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়ল শেখ হাসিনার দুঃশাসন।
স্বাধীনতা লাভের পর প্রধান তিন রাজনৈতিক দল দেশ শাসন করেছে—আওয়ামী লীগ ২৪ বছর, বিএনপি ১৫ বছর, জাতীয় পার্টি ৯ বছর। কিন্তু তারা দেশে স্থায়ী গণতন্ত্র ও শান্তিপূর্ণ ক্ষমতাবদলের কোনো টেকসই ও গ্রহণযোগ্য প্রক্রিয়া প্রতিষ্ঠিত করেনি। তিনটি দলেরই রাজনৈতিক চিন্তাচেতনা ও সংস্কৃতি খুবই কাছাকাছি। সামন্তপ্রথার মতো তিন পরিবার চালিয়েছে তিনটি দল—এরা মূলত এক ব্যক্তিকেন্দ্রিক দল। আওয়ামী লীগে প্রথমে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব, পরে শেখ হাসিনা; বিএনপিতে জিয়াউর রহমান ও খালেদা জিয়া; জাতীয় পার্টিতে এরশাদ, রওশন এরশাদ ও জি এম কাদের। এসব দলে গণতন্ত্রের চেয়ে পার্টির প্রধানের চিন্তাভাবনা দলের চিন্তাভাবনা, তাঁর সিদ্ধান্তই দলের সিদ্ধান্ত। স্বৈরাচারের বীজ এসব পার্টি ধারণ করে থাকে তাদের চিন্তায়, সংস্কৃতিতে, রাজনীতিতে গণতন্ত্র নেই। দলে গণতন্ত্র ছাড়া দেশে কীভাবে তাঁরা গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করবেন? এটি খুবই স্বাভাবিক যে এ তিনটি পার্টি যখন ক্ষমতায় ছিল, তাদের অধীন অনুষ্ঠিত কোনো নির্বাচনই অবাধ ও নিরপেক্ষ হয়নি। বাংলাদেশের ইতিহাসে অনুষ্ঠিত মাত্র চারটি নির্বাচন অবাধ ও নিরপেক্ষ হয়েছে বলে ধরা হয়, যার সব কটি অনুষ্ঠিত হয়েছে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে। প্রধান তিন রাজনৈতিক দলের শাসনপ্রক্রিয়ায়ও মিল রয়েছে। তাদের দেশ শাসনের হাতিয়ার হলো এক চতুষ্টয় শক্তি: রাজনীতিবিদ, আমলা, ব্যবসায়ী ও সামরিক বাহিনী। এ জোট দিয়ে তাঁরা দেশ শাসন করে এসেছেন, জনগণের মতামত এখানে গৌণ। ক্ষমতায় টিকে থাকতে এ চতুষ্টয় সদস্যকে দিতে হয় হালুয়া-রুটির ভাগ, তবে তাতে বঞ্চিত হয় জনগণ। তাঁদের শাসনে জনগণ যেন সার্কাসের দর্শক, আর পার্লামেন্ট যেন রাবার স্ট্যাম্প। দেশ ও জনগণকে বড় দুটি দল উপহার দিয়েছিল দুটি রাজনৈতিক জাদুবাস্তবতা: হাওয়া ভবন ও আয়নাঘর। তারা দেশের জাতীয় নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে জিয়াউর রহমানকে প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে দাঁড় করালেন, অথচ তাঁরা প্রতিদ্বন্দ্বিতার অনেক ওপরে, কারণ দুজনেই দুটি জাতীয় ট্র্যাজেডির করুণ শিকার হয়ে প্রয়াত। আমাদের জাতির গৌরবময় ইতিহাসে এ দুজন মহান নেতা মর্যাদার আসনে আসীন আছেন, থাকবেন।
২০২৪–এর ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থান–পরবর্তী নতুন ব্যবস্থায় এসব ব্যর্থ দল—আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টি জনগণের কাছে কী প্রত্যাশা নিয়ে যাবে? তারা কি আত্মসমালোচনা করেছে বা করবে? জনগণের কাছে ক্ষমা চেয়েছে? নতুন দিনের নতুন চিন্তা আনতে পেরেছে? আইস্টাইন বলেছেন: ‘We cannot solve our problems with the same kind of thinking we used when we created them.’ এ দলগুলো শুধু তাদের চিন্তা-চেতনা ও মানসিকতার পরিবর্তন করেই যে সমস্যাগুলো তারা তৈরি করেছিল হয়তো তার সমাধান খুঁজে পাবে।
আগের দুটি সুযোগের মতো বাংলাদেশের তৃতীয় ঐতিহাসিক সুযোগ হারানো যাবে না। নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূস বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তাঁর রয়েছে সুনাম ও যোগ্যতা, আর রয়েছে আন্তর্জাতিক পরিচিতি ও গ্রহণযোগ্যতা। তাঁর নেতৃত্বে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি চিন্তাভাবনা নিয়ে সামনে এগিয়ে যেতে হবে। ড. মুহাম্মদ ইউনূস হবেন আমাদের সেই রাষ্ট্রনায়ক, যাঁর কথা বলেছেন জেমস ফ্রিমেন ক্লার্ক: ‘A politician thinks of the next election; a stateman thinks of the next generation.’
আমাদের তিনটি মৌলিক বিষয়ে জাতীয় ঐকমত্য তৈরি করতে হবে—
১. ১৯৭১-এর স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা
২. ১৯৯০–এর তিন জোটের রূপরেখা
৩. ২০২৪–এর ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষা
এ তিনটিই হবে আমাদের নতুন দিগন্তে যাত্রাপথের আলোকবর্তিকা—জাতির মূলনীতি হিসেবে যা সংবিধানে অপরিবর্তনীয় অধ্যায় হিসেবে অন্তর্ভুক্ত থাকবে।
গত অর্ধশতাব্দীকালের শাসনকালে প্রধান তিনটি দল, বিশেষ করে আওয়ামী লীগ অনেক রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংবিধানিক জঞ্জাল তৈরি করে রেখে গেছে। তা পরিষ্কার করে নতুন রাস্তা তৈরি করা অনেক দুরূহ কাজ। এ ব্যাপারে আমরা অন্য দেশের প্রচেষ্টা, সাফল্য-ব্যর্থতা থেকে পাঠ নিতে পারি। দক্ষিণ আফ্রিকায় ডিসেম্বর ১৯৭৫ সালে নেলসন ম্যান্ডেলা গঠন করেছিলেন The Truth and Reconciliation Commission (TRC), যার নেতৃত্বে ছিলেন আর্চবিশপ ডেসমন্ড টুটু। তাঁরা দুজনেই ছিলেন ন্যায়ের পক্ষে নিরলস যাত্রী। বাংলাদেশেও এ রকম এক কমিশন গঠন করা যেতে পারে, যার প্রধান কাজ হবে সর্বশেষ শাসনামলে যেসব অন্যায়–অবিচার, হত্যা–নির্যাতন–দুর্নীতি হয়েছে, তা খুঁজে বের করে দোষীদের আইনের আওতায় আনা, আর ভবিষ্যতে এর যাতে পুনরাবৃত্তি না হয় তার প্রতিবিধান বের করা। আরও প্রয়োজন একটি ‘সাংবিধানিক কমিশন’ গঠন করা, যা সংবিধান সংস্কারের সুপারিশ করবে, যাতে ভবিষ্যতে গণতন্ত্রের আড়ালে কোনো স্বৈরাচার জন্ম নিতে না পারে। আমাদের বর্তমান সংবিধানে স্বৈরাচারের জন্মের বীজ রয়েছে, যা ইতিমধ্যেই প্রমাণিত হয়েছে। এসব সংস্কার করে গণভোটের মাধ্যমে মতামত নিয়ে তা বাস্তবায়ন করতে হবে পরবর্তী নির্বাচনের আগেই, অন্যথায় বিজয়ী রাজনৈতিক দল বা জোট তাদের অনুকূলে সব পরিবর্তন করতে কুণ্ঠিত হবে না; অতীতে তা আমরা বারবার দেখেছি।
মিটিং-মিছিল-হরতাল-অবরোধ-জ্বালাও-পোড়াও-প্রাণহানি-সম্পদহানি-অভ্যুত্থান-নির্বাচন এই এক চক্রেই গত অর্ধশতাব্দীকাল দেশ ও জনগণ বাঁধা পড়ে আছে। জীবনের, সম্পদের, সময়ের, শক্তির কী নির্মম অপচয়! এ সর্বনাশা চক্র থেকে চিরতরে বের হয়ে আসার এক ঐতিহাসিক সুযোগ করে দিয়েছে ২০২৪-এর ছাত্র-গণঅভ্যুত্থান। বাংলাদেশের জনগণ দলমত, ধর্মবর্ণ–নির্বিশেষে এ ঐতিহাসিক সুযোগের সদ্ব্যবহার করে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাবেন দেশকে—নব যুগের উষালগ্নে দাঁড়িয়ে আমাদের গভীর এক প্রত্যাশা।
লেখক: চৌধুরী সালাহউদ্দীন মাহমুদ, কবি, প্রাবন্ধিক ও সম্পাদক, অগ্রবীজ (সাহিত্য পত্রিকা), ডালাস, যুক্তরাষ্ট্র