অভিজ্ঞতার গভীরতাই কার্যকলাপের প্রভাব-পূর্ণতা

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

বাংলাদেশের পরিকাঠামো নাড়ালে যে জিনিসগুলো প্রথমে বেরিয়ে আসবে, তার মধ্যে ভেজাল, দুর্নীতি, ভণ্ডামি, অন্যের জমি দখল, গুজব এবং নকল উল্লেখযোগ্য। ছোটবেলা পড়েছিলাম ‘পারিবে না এ কথাটি বলিও না আর একবারে না পারিলে দেখ শত বার।’ বাংলাদেশ স্বাধীন করা থেকে শুরু করে আজ অবধি নকলের ওপর প্র্যাকটিস করতে করতে শেষে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের পিএইচডি গবেষণার নকলে পরিণত হয়েছে, এমন একটি খবরও আমি জেনেছি গত কয়েক বছর আগে। সেক্ষেত্রে নকলে সারা দেশের পারফরমেন্স বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় খুবই উন্নত, সে বিষয় আমরা নিশ্চিত। প্রতিনিয়ত নতুন কিছু আবিষ্কার করা কঠিন এবং ব্যয়বহুল। সেক্ষেত্রে নকল করা এবং শর্টকাট ওয়েতে সমস্যার সমাধান করা বা উদ্দেশ্য সফল করা দোষের কী? এমন ধরনের মন-মানসিকতা দেশের সবার মধ্যে বিরাজ করছে।

জাপান, চীন এরাও কিন্তু নকল করতে করতেই বিশ্বের শ্রেষ্ঠ উৎপাদনকারী দেশে পরিণত হয়েছে। তাদের উৎপাদিত পণ্য গোটা বিশ্বে কম খরচে বিক্রি হচ্ছে। কারণ, তারা বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন করতে সফল হয়েছে। তাদের নকলে ভেজাল, দুর্নীতি, ভণ্ডামি নেই এবং তারা জাস্ট ইন টাইম ডেলিভারিতে বিশ্বস্ততার পরিচয় দিয়ে আসছে।

ভালো কিছু অর্জন করতে খারাপ কিছু বর্জন করতে শিখতে হয়। এই সহজ শিক্ষাটি আমাদের প্রশিক্ষণে নেই; যার কারণে আমরা জাপান বা চীনাদের মতো বহির্বিশ্বে ব্যবসায় গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করতে পারছি না।

কথায় বলে ‘building trust building growth.’ কিন্তু আমরা বারবার কথা দিয়ে কথা রাখতে ব্যর্থ হচ্ছি আর হাজার অজুহাত বের করছি। দেখেছেন কি বানরকে ফাঁদের ভেতর খাবার দিয়ে কীভাবে ধরে? বানর তার হাতটি দিব্যি ফাঁদের ভেতরে ঢুকিয়ে প্রথম খাবারটি ধরে পরে খাবারসহ হাত বের করতে গিয়েই ধরা খায়। খাবারটি ছেড়ে দিলেই কিন্তু হাতটি বের করে সহজেই ছাড়া পেতে পারে কিন্তু কেন বানর এই সহজ কাজটি করতে ব্যর্থ? লোভ, নাকি যতো সহজ আমরা মানুষ জাতি বিষয়টি ভাবছি ততো সহজ নয় তাদের জন্য। কারণ, তারা তো মানুষ নয়, তারা বানর। কোনো কিছু অর্জন করতে কিছু বর্জন করতে হয়। বানর বর্জন করতে শেখেনি কিন্তু আমরা মানুষ জাতি পরিবর্তনে অভ্যস্ত। তাই অবশ্যই যা আমাদের জন্য ভালো নয়, তা বর্জন করতে পারি। আমরা আমাদের কাজ বা আচরণে যদি শুধু দেশের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকতে চাই তবে দেশের সর্বাঙ্গীন উন্নতি হবে না। উন্নতি হবে ব্যক্তি মালিকানার মাত্র।

একটি উদাহরণ দিই। প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন, তাঁর অফিস, তাঁর চলাফেরার নিরাপত্তা, এমনকি তিনি যখন কোথাও বেড়াতে যান, সব ধরনের সুযোগ–সুবিধা তাঁকে দেওয়া হয়। এ ধরনের সুযোগ সুবিধা উচ্চপর্যায়ের চাকরিজীবীরা এবং বড়লোকেরাও পেয়ে থাকেন। এখন বাংলাদেশের মোট লোকসংখ্যার মধ্যে এ ধরনের ভিআইপিদের সংখ্যা কত? বাকিদের জীবনযাত্রার মান কেমন, কীভাবে তাঁদের বসবাসব্যবস্থা ইত্যাদি? যেহেতু সাধারণ মানুষের সংখ্যা বেশি, সেক্ষেত্রে তাঁদের পরিবর্তনের জন্য এগিয়ে আসতে হবে প্রথমে। শুধু যদি যার যার জায়গা থেকে কমপ্লেন করা হয়, পরিবর্তন হবে না কোনো দিনও।

আমি আরও একটি উদাহরণ দিই। সুইডেন, আমেরিকা এবং জার্মানিতে আমাকে কিছু লোক অনুরোধ করেছেন, বাংলাদেশের সঙ্গে তাঁরা ব্যবসা করতে চান। আমি বাংলাদেশের কয়েকটি জায়গাতে যোগাযোগ করেছি। তারা শুরুতেই যথেষ্ট আগ্রহ দেখিয়েছে। যখনই শর্তে উপনীত হয়েছে ডেলিভারি, টাইম এবং কোয়ালিটির ওপর, এর একটিও বাংলাদেশে মেনটেইন করতে সক্ষম হয়নি। এমনকি আমি নিজে অগ্রিম টাকা দিয়েছি অথচ আমার মাল নির্দিষ্ট সময়ে পাইনি। আরও সমস্যা বাংলাদেশে, তা হলো ধরাধরি ছাড়া কোনো কাজই হয় না।

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

হাসপাতালে একটি রোগী ভর্তি করতে হলে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় অবধি দৌড়াতে হবে। আছে কি বা হচ্ছে কি এমনটি চীন বা জাপানে? আমাদের স্বভাব না পরিবর্তন করা পর্যন্ত বাংলাদেশকে সোনার বাংলা করা যাবে না। দেশে নকলের চেয়ে ভয়ংকর সমস্যা ঘুষ, দুর্নীতি, ভণ্ডামি এবং অসততা।

সুশিক্ষার অধঃপতনের ফলে মনুষ্যত্বের অবক্ষয়, যার কারণে সমস্যার সমাধান করা কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। অনেকে বলবে সুশিক্ষা আদৌ কখনো ছিল কি দেশে? হয়তো না, তবে পরিবেশগত বা সৃজনশীল শিক্ষা কিছুটা ছিল, যা এখন বিলীন হবার পথে। কথায় বলে সমস্যা যখন জানা যায়, তখন সমস্যার সমাধান খুঁজতে হয়। এখন দীর্ঘদিন ধরে যে সমস্ত খারাপ কাজ আমরা অর্জন করেছি, তাকে বর্জন করতে হবে, সমাধান হবেই। এতক্ষণ নানা সমস্যার কথাই বললাম এবং এও বললাম ভালো কিছু অর্জন করতে খারাপ কিছু বর্জন করতে হবে। কিন্তু যদি একটি বদভ্যাস যা গড়ে উঠেছে, ধীরে ধীরে মনের অজান্তে তাকে সরানো কঠিন, তার জন্য দরকার ধারাবাহিক পরিবর্তন। প্রযুক্তির যুগে দ্রুত পরিবর্তিত হওয়া কিছুটা সম্ভব। কারণ, বিশ্বের কোথায়, কী, কখন, কীভাবে হচ্ছে সেগুলো দ্রুততার সঙ্গে আমরা জানতে, শিক্ষতে ও বুঝতে পারছি। অতএব যদি আমরা সত্যিই মনে-প্রাণে এবং ধ্যানে বিশ্বাস করি যে ভালো আমরা হবো, তবে সেটা সম্ভব।

কিছুদিন আগে সুইডেনের একটি জন্মদিনের অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেছিলাম। ভদ্রমহিলা ৭০ বছর পার করলেন। ভদ্রমহিলার নাম এভা। এভার তিন মেয়ে এক ছেলে। স্বামীর নাম জোহানেস এবং তার জন্মস্থান জার্মানির বার্লিনে। জোহানেস এবং এভার পরিচয় ঘটে ১৯৭৬ সালে ইন্ডিয়া ভ্রমণে এবং পরে দুজন ভালোবেসে বিয়ে করেন ১৯৭৭ সালে স্টকহোমের অদুরে টুম্বা নামে একটি গ্রামে। এভা এবং জোহানেস একসঙ্গে বসবাস করছে ৪৭ বছর ধরে। এভা এবং জোহানেস দুই জনই চিত্রশিল্পী। তাঁদের লাইফ স্টাইল ভিন্ন, অন্যান্য সুইডিশ পরিবারের থেকে। তাঁরা শহর ছেড়ে গ্রামে অতি সাধারণভাবে জীবনযাপনে অভ্যস্ত। তাঁদের চার ছেলেমেয়ে সুইডিশ প্রাইমারি স্কুল শেষ করেই বিয়ে করেছে। সুইডেনে ক্লাস নাইন পাস করতেই হবে, তারপর জোর জুলুমের কিছু নেই, ক্লাস নাইন পাস করার পর তারা কাজ করতে পারে, লেখাপড়া চালিয়ে যেতে পারে। তবে আঠারো বছরের আগে নিজ দায়িত্বে বিয়ে করার নিয়ম নেই কিন্তু বাবা-মার অনুমতিতে ছেলে-মেয়ের একসঙ্গে মেলামেশা করার সুযোগ রয়েছে। এমতাবস্থায় যদি সন্তানের জন্ম হয়, তাতেও কোনও বাধা নেই। এভার বড় মেয়ে থাকে সুইজারল্যান্ডে, মেজো মেয়ে ফ্রান্সে এবং ছোট মেয়ে স্টকহোমে। এভার জন্ম দিনে ছোট মেয়ে রাধিকা তার চার ছেলেমেয়ে নিয়ে এসেছে। রাধিকার বয়স ৩৭ বছর হলেও দেখে কোনোভাবেই সেটা মনে হবে না। যদিও তার বড় ছেলের বয়স ১৯ বছর। মাসহ তিন ছেলে এক মেয়েকে দেখে মনে হলো, তারা পাঁচ ভাইবোন। রাধিকার ছোট ছেলের বয়স যখন চার বছর তখন সে হাইস্কুল এবং কলেজ শেষ করে রীতিমতো ডাক্তারি পাস করে গত চার বছর ধরে ফুল টাইম চিকিৎসা সেবায় নিয়োজিত। আমি রাধিকার সঙ্গে নানা বিষয়ের ওপর কথা বলে অনেক তথ্য জানতে পারলাম। রাধিকার যে জিনিসটা আমার বেশি ভালো লেগেছে, সেটা হলো তার কাজে শতভাগ মনোযোগী হবার সুযোগ। রাধিকা বলল, তাকে ছুটি নেওয়া লাগে না বাচ্চা অসুস্থ হলে, কারণ, সবাই এখন স্বয়ংসম্পূর্ণ। মনের আনন্দে কাজ করা, কোথাও যাওয়া বা কিছু করা কোনও চাপ সৃষ্টি করে না তাকে। রাধিকা যখন যেটা করার সময়, সেটা তখন করতে পেরেছে, যার ফলে জীবনের চাওয়া পাওয়া সম্পূর্ণ ভিন্ন অন্যান্যদের থেকে। এটা আমাকে বেশ ভাবিয়েছে মূলত সে কারণেই আমার এ লেখা।

ইউরোপের নতুন ট্রেন্ড দেখে মনে হচ্ছে, নতুন প্রজন্ম জীবনকে শুরু থেকেই উপভোগ করতে চেষ্টা করছে। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাকে তেমন গুরুত্ব দিচ্ছে না, বরং লেখাপড়া ছাড়াও যে নানা ধরনের সুযোগ-সুবিধা রয়েছে জীবনে প্রতিষ্ঠিত হতে সেগুলোর প্রতি বেশি নজর দিচ্ছে। অনেকে দেখা যাচ্ছে, কলেজ শেষ করে কয়েক বছর যে কোনও কাজে যোগ দিয়ে অর্থ উপার্জনে সময় দিচ্ছে, পরে বিশ্ব ভ্রমণ করছে। শেষে বিয়ে করে নতুন করে মন চাইলে পড়াশোনা করতে বিশ্ববিদ্যালয়ে যাচ্ছে। কে কী ভাবছে, সেদিকে গুরুত্ব না দিয়ে বরং নিজে কী চায়, সেটার ওপর গুরুত্ব বেশি দিচ্ছে, যা সত্যিই কিছুটা ভিন্ন আমাদের সমাজের থেকে।

আমাদের দেশে চাকরিতে বয়সসীমা একটি বিষয় যা অনেককে ভীষণ চিন্তার মধ্যে ফেলে, তারপর সামাজিক জীবনের দায়ভার রাষ্ট্র নিতে পারছে না। এই দায়িত্ব নেবার মতো সামর্থ্য রাষ্ট্রের নেই, সেটাও একটি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু। সব মিলে ইচ্ছে থাকলেও অনেক কিছু করা সম্ভব নয়। তারপরও আমি এতটুকু বলতে চাই, সেটা হলো তাড়াহুড়া করে জীবনের বারোটা না বাজিয়ে বরং যখন যেটা করার কথা সেটা করার মনমানসিকতা গড়ে তুলুন। ছোটবেলার সখ বড় হয়ে বা অর্থনৈতিক সামর্থ্য হলে শত চেষ্টা করলেও পূরণ করা সম্ভব নয়, এটা মনে রাখা দরকার। যেমন, কৈশোর বা যৌবনের প্রেম বৃদ্ধকালে করলে, শত চেষ্টা করলেও তৃপ্তিটা কৈশোর বা যৌবনের মতো হবে না। সে ক্ষেত্রে সঠিক প্রেমের সময় সঠিক প্রেম করুন। সর্বোপরি প্রযুক্তির যুগে শিক্ষার জন্য বদ্ধ ঘরে বন্দি হওয়ার কোনোও কারণ নেই। স্কুলে যা শিক্ষা দেওয়া হয় তার সবকিছুই প্রযুক্তির যুগে ইচ্ছে করলে স্কুলের বাইরে থেকেও জানা সম্ভব। তার জন্য শুধু দরকার মোটিভেশন এবং ডেডিকেশন। নিজেকে জানতে অন্যের কাছে প্রশ্ন না করে নিজেকে বরং নিজেই প্রশ্ন করতে শিখুন, দেখবেন আপনার শিক্ষা সু এবং সৃজনশীল হবে। কারণ, বই পড়ে কেউ কি ফুটবল খেলা শিখতে পারে? না। তাছাড়া পুঁথিগত শিক্ষা, খেলাধুলা, স্বাস্থ্য গঠন বা গ্রেড অর্জন করা আর একটি চরিত্র গঠন করা কিন্তু এক নয়।

সংযম, সাহস, সৌজন্য, বিচক্ষণতা, ন্যায্যতা, বন্ধুত্ব, উদারতা, ভদ্রতা, সহায়তা, সততা, নম্রতা, দয়া, বাধ্যতা, শৃঙ্খলা, ধৈর্য, অধ্যবসায়, আত্মনিয়ন্ত্রণ, কৌশলতা, প্রজ্ঞা, এই জিনিসগুলো কে শেখায়? মা, বাবা, শিক্ষক, সমাজ এবং পরিবেশ। তবে এর প্রকাশ কিন্তু ঘটে আপনার নিজের মধ্যে। শুধু তোতা পাখির মতো সব মুখস্ত থাকলে হবে না, এর বাস্তবায়ন করতে হবে। প্রশিক্ষণ ছাড়া শিক্ষাগ্রহণ করা মানে কাজে ব্যর্থ হওয়া। আর আপনার অভিজ্ঞতার গভীরতাই আপনার কার্যকলাপের প্রভাব-পূর্ণতা।

**দূর পরবাসে ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল অ্যাড্রেস [email protected]