ব্রাগানসা ও অতৃপ্ত হৃদয়ের অসম্পূর্ণ ভালোবাসার গল্প-৫

অলংকরণ: আরাফাত করিম

দিনের শেষে সূর্য অস্ত যায়। পাখিরা ফিরে যায় নীড়ে। গ্রামের মেঠো পথ ধরে ক্লান্ত রাখাল তার পশুদের নিয়ে ফিরে আসে নিজ ঘরে। গরু কিংবা মহিষের খুরের আঘাতে মাটির সঙ্গে মিশে থাকা ধূলিকণা উড়তে শুরু করে। এ সবই নির্দিষ্ট রুটিনমাফিক হচ্ছে। তবে পলিনার সঙ্গে আমার সম্পর্ক এখন আর কোনো ফ্রেমের মধ্যে নেই। অনেকে প্রশ্ন করতে পারেন, পলিনার সঙ্গে কি এখন আমার কোনো ধরনের যোগাযোগ নেই?

পলিনার সঙ্গে আমার এখনো নিয়মিত যোগাযোগ হয়। ফেসবুক, টুইটার, হোয়াটসঅ্যাপ, ভিকে, টেলিগ্রাম, ইনস্টাগ্রামসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের কল্যাণে একজন মানুষ আজ কয়েক হাজার মাইল দূরের কোনো স্থানে অবস্থান করলেও সে একেবারে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় না। ভার্চ্যুয়ালভাবে হলেও তার সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখা যায়।

পলিনাকে সামনাসামনি আর কোনো দিন দেখতে পাব? আবার কি একসঙ্গে হাঁটতে পারব? তার জন্য কি আবার কোনো দিন তার বিল্ডিংয়ের দরজা খোলার সুযোগ আসবে, যাতে সে তার বাসার ভেতরে প্রবেশ করতে পারে? এ প্রশ্নগুলোর উত্তর ভবিষ্যতের জন্য তোলা রইল।

পলিনার অন্তরে হয়তোবা আমার জন্য কোনো স্থান নেই। যদি তার অন্তরে আমার জন্য কোনো স্থান থেকেও থাকে, সেটাও বোঝার কোনো উপায় নেই। ওই যে কথায় আছে না? ভগবান নাকি নারীর মন বোঝেন না।

ব্রাগানসা ছেড়ে স্লোভেনিয়াতে ফেরত এসেছি ঠিকই, তবে পলিনাকে আমি বাঁচিয়ে রেখেছি আমার অন্তরে। পলিনার স্মৃতিকে সঙ্গী করে স্লোভেনিয়ায় বসবাস করছি। ‘এডওয়ার্ড সিজারহ্যান্ডস’ সিনেমায় দেখেছিলাম এডওয়ার্ড সমাজ ও সভ্যতা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে একা এক ক্যাসেলে বসবাস করলেও কিমকে তিনি কখনো ভুলতে পারেননি।

অলংকরণ: আরাফাত করিম

এ কারণে বছরে একটি নির্দিষ্ট সময়ে তাঁর শহরে তুষারপাত দেখা যায় এবং কিমের প্রতি ভালোবাসাস্বরূপ এডওয়ার্ড প্রতিবছর এ সময় এ বরফ বৃষ্টি তৈরি করেন। এডওয়ার্ডের সঙ্গে কিমের পরে আর কোনো দিন দেখা হয়নি ঠিকই, তবে তাঁর স্মৃতিকে পুঁজি করে এডওয়ার্ড জীবনের বাকি বছরগুলো একা ওই ক্যাসেলে কাটিয়ে দেন। কিম বার্ধক্যে উপনীত হন, তা সত্ত্বেও তাঁর প্রতি এডওয়ার্ডের ভালোবাসা একই রকম থেকে যায়। এডওয়ার্ডের কারণে কিম ক্রিস্টমাসের আগের রাতে জীবনে প্রথমবারের জন্য বরফের বৃষ্টি উপভোগ করেছিলেন।

আমিও একইভাবে পৃথিবীর যে প্রান্তে থাকি না কেন, পলিনাকে জীবনের শেষ দিন আমার মধ্যে রাখতে চাই। রাতে ঘুমানোর পর পলিনাকে প্রতিদিন আমি আমার স্বপ্নে দেখতে চাই। তার সেই হাসিমুখের ছবি বারবার আমার চোখের সামনে ভেসে ওঠে। তাঁর সুরেলা কণ্ঠের কথাগুলো সব সময় আমার কানে বাজে। আমার অন্তরে পলিনার যে ছবি তৈরি হয়েছে, সেটির দিকে তাকিয়ে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তার জন্য কাঁদতে চাই।

নিজের বুকের রক্ত দিয়ে হলেও পলিনার কাছে প্রমাণ করতে চাই যে আমি তাকে সত্যিকার অর্থে ভালোবাসি। আমার পক্ষে যে অন্য কোনো মেয়েকে আর এভাবে ভালোবাসা সম্ভব নয়।

ছোটবেলা থেকে রক্ষণশীল পারিবারিক কাঠামোর মধ্য দিয়ে বেড়ে উঠেছি। ঘরের বাইরে যে আরও একটি ভিন্ন জগৎ রয়েছে, সেটি বুঝতে আমাকে আজকের দিন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়েছে, আজও গোটা দুনিয়াকে জানার চেষ্টা করছি। স্কুল কিংবা কলেজ লাইফে মেয়েদের সঙ্গে মেলামেশার সুযোগ আসেনি সেভাবে। এমনকি আমি যে স্কুল থেকে এসএসসি পাস করেছি কিংবা যে কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা দিয়েছি, তার কোনোটিতে মেয়েরা পড়াশোনা করে না। কেবল ছেলেরা পড়াশোনার সুযোগ পায়।

বাংলাদেশের সমাজব্যবস্থা অত্যন্ত রক্ষণশীল, সহশিক্ষা বা কো-এডুকেশনের মতো বিষয় এখনো এ দেশের সাধারণ মানুষ পুরোপুরি গ্রহণ করেনি।

ঈশ্বর যেখানে নারীর মন বুঝতে পারেন না, সেখানে আমি কীভাবে পলিনা বা অন্য কোনো মেয়ের মনকে অনুধাবন করতে পারব? জর্জিয়ান সে তরুণী হয়তোবা সেদিন আমার সম্পর্কে সঠিক মন্তব্যটি করেছিল। আমি সত্যি জানি না মেয়েরা কী চায় কিংবা তাদের সঙ্গে কীভাবে যোগাযোগ স্থাপন করতে হয়। এ কারণে ২৫ বছর বয়সে আমি আজও সিঙ্গেল।

ক্লাস সিক্সে থাকতে ‘রব নে বানা দে জোড়ি’ নামক একটি সিনেমা দেখেছিলাম। এ সিনেমায় শাহরুখ খানের বিপরীতে অভিনয় করেছিলেন আনুশকা শর্মা, এ সিনেমার মধ্য দিয়ে আনুশকা শর্মা বলিউড অঙ্গনে পা রাখেন। যদি এ সিনেমার আলোকে বলার চেষ্টা করি, মেয়েরা বোধ হয় সত্যিকারের ভালোবাসা দেখতে পায় না। প্রথমত, আমি দেখতে খুব একটা আকর্ষণীয় নই, জামাকাপড় কিংবা ফ্যাশনের দিক থেকেও আমি তেমন একটা সচেতন নই। আমি ভীষণ বোরিং স্বভাবের একজন মানুষ এবং সবকিছুকে আমি সিরিয়াসভাবে নেওয়ার চেষ্টা করি।

অর্থনৈতিকভাবেও আমি খুব একটা সচ্ছল হতে পারিনি এখনো। মেয়েদের মন পড়ার সক্ষমতা আমার নেই এবং একই সঙ্গে তাদের হাসানোর ক্ষমতাও আমার মাঝে অনুপস্থিত। আমার কথায় জড়তা রয়েছে। আমি বিশ্বাস করি, আমার মাঝে সত্যিকারের একটি হৃদয় রয়েছে, যে হৃদয় দিয়ে আমি পলিনাকে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত ভালোবাসব, তাকে আমার জীবনের সর্বস্ব দিয়ে সব দুঃখ, কষ্ট আর হতাশা থেকে রক্ষা করব এবং নিজ পরিশ্রম গুণে তার জীবনের সব স্বপ্ন পূরণের জন্য কাজ করে যাব।

তবে কেউই মানুষের মধ্যকার অন্তরটিকে মূল্যায়ন করে না। এ কারণে অনেক সময় বলা হয়, সত্যিকারের হৃদয়ের মানুষ কখনো রিলেশনশিপের স্বাদ পায় না।

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

আবার যদি বিপরীত দিক থেকে যদি বলি, একবার আমি আমার এক বন্ধুর থেকে শুনেছিলাম যে একজন মেয়ে নাকি তার জীবনে এমন একজন ছেলেকে খোঁজে যে কি না তাকে সত্যিকার অর্থে অন্তর দিয়ে ভালোবাসবে, তার খেয়াল রাখবে এবং তার প্রতি সব সময় সৎ থাকবে। আমি পলিনাকে আমার হৃদয়ের পুরোটা দিয়ে ভালোবাসতে চাই, সব সময় তার খেয়াল রাখতে চাই এবং দরকার হলে তার সুখ ও সাফল্যের জন্য আমি নিজের সর্বোচ্চটুকু বিসর্জন দিতেও প্রস্তুত আছি। আমি এমন কিছু কখনো করব না, যেটা পলিনার অন্তরে ব্যথার সৃষ্টি করে।

পলিনা যে রূপে থাকুক না কেন, সব সময় এমনকি ৩০ বছর পরেও তাকে একইভাবে ভালোবাসতে চাই পলিনা আমার কাছে আটলান্টিক মহাসাগরের জলরাশির মতো, যার প্রতি আমার ভালো লাগা বা ভালোবাসার কোনোটি কোনো দিনও ফুরোবে না। মৃত্যুর পরও আমি আমার কালো চোখ দিয়ে কবরে শুয়ে তাকে দেখতে চাই। স্ত্রী মমতাজের প্রতি ভালোবাসার নিদর্শন হিসেবে সম্রাট শাহজাহান যেমনিভাবে তাজমহল নির্মাণ করেছিলেন, ঠিক একইভাবে আমার যদি সামর্থ্য থাকত তাহলে পলিনার জন্যও আমি আরেকটি তাজমহল তৈরি করতাম। এত কিছুর পরও কেন পলিনা আমার কোনো দিনও হবে না? এ প্রশ্নের কি কোনো উত্তর আছে?

ভাগ্য কোনো দিন আমার সহায় হয়নি। ক্রিকেটের দক্ষিণ আফ্রিকা আর ফুটবলের নেদারল্যান্ডসের মতো আমার ভাগ্য একই সুতোয় গাঁথা। আমার জীবনে প্রাপ্তি বলে কিছুই নেই। জীবনে যা চেয়েছি, সবকিছুই একেবারে কপালের চামড়া ঘেঁষে ধরা দিয়েছে কিন্তু একেবারে অন্তিম মুহূর্তে আমার হাত ফসকে একেবারে দূরে সরে গেছে। রাতের আঁধারকে দূরীভূত করে ধরিত্রীর বুকে প্রভাত নেমে আসে, সূর্য ওঠার সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয় নতুন এক দিনের। প্রকৃতিতে পরিবর্তন আসে, পালাক্রমে হাজির হয় ছয় ছয়টি ঋতু। তবে আমার জীবন একই থেকে যায়। বরং প্রতিনিয়ত আমার সঙ্গে নতুন করে যুক্ত হয় অপ্রাপ্তি আর হাহাকারের একেকটি ইতিহাস।  

সব গল্পের সুখী সমাপ্তি হয় না। একজন মানুষ তার জীবনে যা চায়, সবকিছুকে পাওয়া তার পক্ষে সম্ভব হয় না। কিছু কিছু মানুষ আছে যাদের কাছে জন্মই হচ্ছে আজন্ম পাপ। হতাশা ও বেদনা এদের নিত্যদিনের সঙ্গী। ভাগ্যবিধাতা তাদের নিয়ে ছিনিমিনি করতে ভালোবাসেন। মাঝেমধ্যে মনে হয় সৃষ্টিকর্তা বলে কি সত্যি কেউ আছেন? আচ্ছা, যদি সৃষ্টিকর্তা বলে কেউ থেকে থাকেন, তাহলে এত অনাচার ও অবিচারকে তিনি কেনও প্রশ্রয় দেন?

চারদিকে কেন এত বৈষম্য? যেমন একজন শিশু শারীরিক প্রতিবন্ধী হয়ে জন্ম নিল, জীবনে চলার পথে তাকে অনেক কষ্ট সহ্য করতে হবে। হয়তো পরিণত অবস্থায় তার মনেও স্বপ্ন জাগবে যে সে একদিন দেশের হয়ে লড়াই করবে কিন্তু শারীরিক প্রতিবন্ধকতার কারণে তার সে স্বপ্ন অধরা থেকে যাবে। আবার ফুটবলে নেদারল্যান্ডস কিংবা ক্রিকেটে দক্ষিণ আফ্রিকার মতো দলকে সেরা পারফরম্যান্সের পরও ভাগ্যবিধাতার কারণে শেষ মুহূর্তে ‘চোকার’ অপবাদ মাথায় নিয়ে আত্মসমর্পণ করতে হয়।

সারা দিন হাড়ভাঙা খাটুনির পরও একজন মানুষকে অন্তিম পর্যায়ে এসে যখন নিরাশ হতে হয়, তখন তার চেয়ে বেদনার কী হতে পারে? আবার অনেকের সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও উপযুক্ত পরিবেশের অভাবে স্বপ্ন থেকে থাকে সরে আসতে হয়। দিন শেষে একটাই সান্ত্বনা, এটাই নিয়তি। নিয়তি যত রূঢ় হোক না কেন, মনের বিরুদ্ধে গিয়ে হলেও সেটাকে মনে নিতে হয়। যদিও বুকের ভেতরে চাপা আর্তনাদ আজীবনের জন্য রেশ বয়ে নিয়ে যায়।

অলংকরণ: আরাফাত করিম

হিটলারের অনুগত নাৎসি বাহিনী পুরো ইউরোপকে তাদের কবজায় আনতে পারলেও রাশিয়া ছিল সব সময় তাদের কাছে অধরা। স্তালিনগ্রাদের যুদ্ধের মধ্য দিয়ে পুরো বিশ্ব হিটলারের সেনাবাহিনীর অসহায়ত্ব দেখেছে। হিটলারের পতন ঘটেছে রুশদের হাত ধরে।

জার্মানি আজও রাশিয়াকে ভয় পায়। জার্মানির বর্তমান চ্যান্সেলর ওলাফ শলৎস মিডিয়ার সামনে সরাসরি বলেছন, ‘ইউক্রেন ইস্যুতে জার্মানি এমন কোনো সিদ্ধান্ত নেবে না, যেটা সরাসরিভাবে রাশিয়ার সঙ্গে নতুন করে তার সংঘাতে সম্ভাবনাকে প্রশস্ত করে।’ তিনি আরও বলেন, ‘প্রথম ও দ্বিতীয়—দুই বিশ্বযুদ্ধে রাশিয়ার বিপক্ষে যুদ্ধের ফল জার্মানিকে আজও ভোগাচ্ছে।’

রোনাল্ড রিগানের চতুরতার কাছে মিখাইল গর্বাচেভ পরাজিত হয়েছেন। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে ১৫টি নতুন রাষ্ট্রের জন্ম হয়েছে। পূর্ব ইউরোপের দেশগুলোও কমিউনিজম থেকে গণতন্ত্র ও মুক্তবাজার অর্থনীতির পথে পা বাড়িয়েছে। ওয়ার শ প্যাক্টকেও রহিত হয়ে গেছে। নব্বইয়ের দশকের শেষভাগে সবাই ভেবেছিল যে রাশিয়া আর কোনো দিন মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারবে না। রাশিয়াকে কেউই তখন আর প্রাসঙ্গিক মনে করেনি।

কিন্তু এ রাশিয়া আজ চীনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ পশ্চিমা দেশগুলোকে চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছে। আজকের থেকে ২০ বছর আগেও কি কেউ ভেবেছিল যে একদিন রাশিয়া আবার এভাবে ঘুরে দাঁড়াবে এবং বিশ্বরাজনীতিতে পুনরায় প্রভাব বিস্তার করতে শুরু করবে?

ইউক্রেনে যখন রাশিয়ার সেনাবাহিনী আগ্রাসন শুরু করে, তখন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ এনে রাশিয়ার ওপর স্যাংশন আরোপ করেন। পশ্চিমের মিডিয়াগুলো ফলাও করে প্রচার করতে থাকে, রাশিয়ার অর্থনীতি শিগগিরই ভেঙে পড়বে এবং ফলস্বরূপ দেশটিতে তীব্র আন্দোলন শুরু হবে। পুতিন ক্ষমতা ছেড়ে দিতে বাধ্য হবেন।

ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর প্রায় এক বছর কেটে গেছে। স্যাংশনের মাধ্যমকে কি রাশিয়াকে আদৌ কোনোভাবে দুর্বল করা সম্ভব হয়েছে? কিংবা যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য বা পশ্চিমা দেশগুলো কি পুতিনকে ক্ষমতাচ্যুত করে রাশিয়ায় সরকার পরিবর্তন করতে পেরেছে?

রাশিয়া তাই সবার কাছে আক্ষেপের আরেক প্রতিশব্দ। আমিও এমন একজনের কাছে পরাজিত হতে চলেছি যে কিনা রুশ ভাষায় কথা বলে। আর যা-ই হোক আমার নাম কোনো দিন ইতিহাসের পাতায় লেখা থাকবে না। পলিনাও হয়তো একদিন আমার কথা ভুলে যাবে, তবে তাকে না পাওয়ার বেদনায় আমি সারা জীবন কেঁদে বেড়াব। মার্ভেলের সুপারহিরো সিনেমা ডক্টর সিনেমার সেই বিখ্যাত ডায়ালগের মতো করে আমিও পলিনাকে বলতে চাই:

‘পলিনা, আই লাভ ইউ ইন এভরি ইউনিভার্স।’
রাশিয়া ও বেলারুশ—দুটি দেশ সব সময়ের জন্য আমার জীবনে ট্র্যাজেডি হয়ে থাকবে। আর ক্রিস্টোফার নোলানের সিনেমার মতো পলিনা চিরকাল আমার কাছে প্যারাডক্স হয়ে থাকবে।

তবে একটা বিষয় অবশ্যই স্বীকার করতে হবে, পলিনা আমার জীবনে আলোকবর্তিকা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিল। পলিনা পাশে ছিল বলে জীবনটাকে আমার নতুন করে সাজানোর স্বপ্ন দেখেছি, সব বিপর্যয়কে পাশ কাটিয়ে ঘুরে দাঁড়ানোর লক্ষ্যে পরিশ্রম করে যাচ্ছি। আচরণের দিক থেকে সে প্রচণ্ড রকমের অমায়িক, আমার মতো একজন মানুষকে সে সহ্য করেছে। বিভিন্ন সময় তাকে আমি অপ্রত্যাশিত মেসেজ পাঠিয়েছি, সবকিছুকে সে সহ্য করেছে। এগুলোই–বা কম কিসের?

কোয়ান্টাম ফিজিকস প্যারালাল ইউনিভার্সের ধারণাকে অস্বীকার করে না। তাই আমি বিশ্বাস করতে চাই, এ ইউনিভার্সে হয়নি ঠিকই; তবে অন্য কোনো ইউনিভার্সে হয়তোবা রাকিব তার পলিনাকে খুঁজে পাবে এবং এই দুজনের ভালোবাসা পূর্ণতা পাবে। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত এ কথাটি ভেবে সান্ত্বনা খুঁজতে হবে। পলিনা না পাওয়ার বেদনা নিয়ে একদিন আমাকে এ দুনিয়া ছেড়ে চলে যেতে হবে।

নিউটনের তৃতীয় সূত্র অনুযায়ী প্রত্যেক ক্রিয়ার বিপরীতে একটি সমান ও বিপরীতমুখী প্রতিক্রিয়া থাকে। গণিতে যে রকম প্লাস আছে, ঠিক তেমনি মাইনাসও আছে। গুণের বিপরীতে রয়েছে ভাগ। আলোর বিপরীতে রয়েছে অন্ধকার। ইলেকট্রনের বিপরীতে রয়েছে পজিট্রন। ম্যাটারের বিপরীতে রয়েছে অ্যান্টিম্যাটার। ভালোবাসার রং লাল, আবার আমাদের রক্তের রং লাল। ভালোবাসা মানুষের জীবনকে সুন্দর ও বর্ণিল করে তোলে। যে ঘরে ভালোবাসা নেই, সে ঘরের চেয়ে ভয়াবহ কারাগার এ পৃথিবীতে আর একটিও নেই। আবার রক্তপাত ও হানাহানি একটি সমাজকে নৈরাজ্য ও বিশৃঙ্খলায় পর্যুদস্ত করে মানুষ স্বাভাবিকভাবে নিশ্বাস নেওয়ার ইচ্ছা ও আগ্রহ দুই–ই হারিয়ে ফেলে।

এমনটিও হতে পারে যে কোনো একদিন আমি পলিনার হাতে হাত রেখে ভূমধ্যসাগরের তীর ধরে একসঙ্গে হাঁটছি। একটি সিগাল ওপর থেকে আমাদের দেখে বলছে, এবার ভাগ্যবিধাতা রাকিবের দিকে মুখ তুলে তাকিয়েছে। আমি হব সেদিন এ পৃথিবীতে সবচেয়ে সুখী মানুষ। নিচের সাগর ও ওপরের আকাশ দুই–ই আমাদের ভালোবাসার লাল রঙে।

আমাদের প্রতিটি চুম্বনে প্রশান্ত হবে আশপাশের বাতাস। তটের কিনারে জমে থাকা এবড়োখেবড়ো পাথরগুলো নরম বালুকণায় পরিণত হবে। সূর্যের সোনালি রশ্মি সেদিন আমাদের অভ্যর্থনা জানাবে। পাখিরা গান করবে, প্রজাপতি এসে বসবে আমাদের হাতের ওপর। আমাদের ভালোবাসা থেকে পরাগরেণু সংগ্রহ করে সেটাকে ছড়িয়ে দেবে ফুল থেকে ফুলে।

এভাবে প্রতিটি ফুলের গায়ে লেখা থাকবে আমাদের ভালোবাসার কথা। প্রেমিক-প্রেমিকারা ফুলের গায়ে থাকা আমাদের ভালোবাসার গল্প পড়ে অনুপ্রেরণা খোঁজার চেষ্টা করবে। প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম এভাবে বেঁচে থাকবে রাকিব আর পলিনা আর আমাদের ভালোবাসার সাফল্যগাথা গল্প। সত্যি সত্যি সেদিন আমাদের সবার সামনে সমাগত হবে? নাকি আমার স্বপ্নের মধ্যে সেদিন সীমাবদ্ধ থাকবে? শেষ

লেখক: রাকিব হাসান রাফি, শিক্ষার্থী, ইউনিভার্সিটি অব নোভা গোরিছা, স্লোভেনিয়া।