রাসেলস ভাইপার ভাইরাল

রাসেলস ভাইপার বা চন্দ্রবোড়া নিয়ে আতঙ্ক এখন ভাইরাল পর্যায়ে পৌঁছেছে। এমনিতেই বাঙালির সর্পভীতি কিংবদন্তিতুল্য, তার ওপর রাসেলস ভাইপার বিষধর; কাজেই দুইয়ে দুইয়ে চার মিলে এখন চলছে এটি নিধনের মহোৎসব।

প্রথম প্রশ্ন হচ্ছে, সাপটি কি আসলেই দুনিয়ার সবচেয়ে বিষধর? যার কোনো অ্যান্টিভেনম নেই? না। ঘটনা মোটেই তা নয়। রাসেলস ভাইপারে কামড়ালে অবশ্যই দ্রুত চিকিৎসা নেবেন, ইনশা আল্লাহ দ্রুত সুস্থও হবেন। এর অ্যান্টিভেনম আছে এবং এটি দংশালে সঙ্গে সঙ্গে মৃত্যু ঘটে না।

সাপটি শত শত বছর ধরেই আমাদের অঞ্চলে ছিল। মাঝে বিলুপ্তপ্রায় হয়ে গিয়েছিল, এখন আবার ফিরে এসেছে।

কেন?

কারণ হচ্ছে আমরা বেজি, গুইসাপ, শিয়াল ইত্যাদি মেরে ফেলছি। এসব প্রাণী সাপ খেয়ে বেঁচে থাকে। যেহেতু ওরা বিদায় হয়েছে, তাই সাপখোপের সংখ্যা বেড়ে গেছে।

চিন্তা করেন, একদিকে সেসব প্রাণীকে মেরে ফেলা হচ্ছে, যারা সাপ খেয়ে পরিবেশ নিয়ন্ত্রণ করে, অন্যদিকে মাঠে ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধির ফলে প্রচুর পরিমাণ ইঁদুরের সাপ্লাই হচ্ছে। তাহলে সাপ বাড়বে না কেন?

এখন সাপের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় ইঁদুরের সংখ্যা কমে যাচ্ছে। এই ইঁদুর ফসলের ক্ষতি করে, সাপ সেই ইঁদুর খেয়ে কৃষকের উপকার করে। আবার কৃষককে নিজ এলাকায় পেলে তাঁকেও কামড়েও ফেলে। কৃষকেরা তাই ভুজঙ্গ হত্যায় মেতেছে। এখন সাপ কমে গেলে ইঁদুরের সংখ্যা হু হু করে বাড়বে। তখন শুরু হবে আমাদের খাদ্যসংকট।

তাই প্রাকৃতিক ভারসাম্যে হাত দিতে নেই।
তাহলে এখন উপায় কী?
উপায়টাও সহজ।

রুল অব থাম্ব হবে, প্রকৃতির ভারসাম্যে হস্তক্ষেপ করা যাবে না। উল্টো যে ক্ষতি হয়েছে, সেটাও পোষাতে হবে। মানে গুইসাপ, বেজি ও অন্য যেসব প্রাণী সাপ খেয়ে থাকে, এগুলো ইমপোর্ট করে হলেও সেসব এলাকায় ছাড়তে হবে এবং আইন করতে হবে যে এগুলোকে মারা যাবে না। যদি ওদের উৎপাত বেড়ে যায়, তখনই নির্দিষ্ট কর্তৃপক্ষ ওদের ব্যবস্থা নেবে। সাধারণ মানুষ কিছু করতে পারবে না।

দ্বিতীয়ত, কৃষকদের জন্য সুলভ মূল্যে গামবুটের ব্যবস্থা করতে হবে। কৃষকেরা গামবুট পরে ফসলি জমিতে যাচ্ছেন কি না, সেটা কৃষি অধিদপ্তর নিশ্চিত করবে।

আমি বুঝি না, বাঙালি নিজের জীবনের ঝুঁকি আছে জেনেও এসব পোশাক পরতে চায় না কেন? নিজের জীবনের চেয়ে বড় কী হতে পারে?

তৃতীয়ত, স্থানীয় জনসাধারণকে সাপের ব্যাপারে বেশি বেশি করে শিক্ষিত করতে হবে। কোন সাপ উপকারী, কোন সাপ অপকারী, কোনটি বিষধর, কোনটি বিষধর হলেও প্রয়োজনীয়, কোনটি নির্বিষ, নিরীহ কিন্তু ইঁদুর, পোকামাকড় ইত্যাদি খেয়ে আমাদের উপকার করে—এসব ব্যাপারে সচেতন করতে হবে। এমন নয় যে দুনিয়ার সব সাপ সম্পর্কে জ্ঞান নিতে হবে। যে যেই অঞ্চলের, সে যেন সেই অঞ্চলের সাপ সম্পর্কে জ্ঞান রাখে, সেটাই যথেষ্ট। থাকেন মাদারীপুরে আর আফ্রিকার ব্ল্যাক মাম্বা বা টেক্সাসের র‍্যাটল স্নেকের জ্ঞান দেওয়া হবে, তাহলে বিষয়টি অযথা হয়ে যাবে।

গ্রামের মানুষের জীবনের অংশ সাপ, অথচ আমাদের সেখানে লোকজনকে সচেতন করতে এ ব্যাপারে কোনো পদক্ষেপই নজরে আসে না। নাহলে কেন এই যুগেও লোকে সাপের কামড়ে প্রথমে ওঝা আর ঝাড়ফুঁক করায়? এতেই তো যা সর্বনাশ হওয়ার তা হয়ে যায়। এমন সময়ে হাসপাতালে যায়, যখন কিছুই করার থাকে না। লোকজনকে সচেতন করতে হবে স্কুলের মাধ্যমে, মসজিদের ইমামের মাধ্যমে জুমার খুতবায়। গ্রামেগঞ্জে ওয়াজ মাহফিল হয়, লোকে খুব আগ্রহের সঙ্গে শোনে, সেখানে তাঁরা বলবেন সাপের কামড়ে কি করতে হবে, কী করা যাবে না। গ্রাম্য পঞ্চায়েতের মিটিংয়ে এই নিয়ে সচেতন করতে হবে। সরকারি পর্যায়ে নানান উদ্যোগ তো থাকলই।

যে বাংলা সিনেমায় দেখাবে সাপের কামড়ে মুখ দিয়ে রক্ত চুষে বিষাক্ত রক্ত কুলি করে ফেলে রোগীকে বাঁচিয়ে তোলা হচ্ছে, এমন সিনেমা শুধু ব্যানই করা হবে না, উল্টো পরিচালক ও লেখককে আইনত দণ্ড করা হবে। ফাজলামির সীমা আছে। এসব দেখেই বেকুব মূর্খ জনতা সাপের কামড়ে চিকিৎসকের কাছে না গিয়ে ক্ষতস্থান চাটাচাটি করে নিজেরও ক্ষতি করে, রোগীকেও মেরে ফেলে।

চতুর্থত, সাপের বিষের প্রতিষেধক প্রতিটি গ্রামে থাকতেই হবে। সাপে কামড়ায় গ্রামে, অথচ অ্যান্টিভেনম নিতে যেতে হয় দূর সদরের হাসপাতালে, যেখানে যেতে যেতেই দিন ফুরিয়ে যায়। এ কেমন হাস্যকর, হতাশাজনক ব্যবস্থা? যেখানেই সাপ, সেখানেই অ্যান্টিভেনম থাকতে হবে। ফ্রিজের প্রয়োজন হলে যার বাড়িতে ফ্রিজ আছে, ওকে এই দায়িত্ব দেওয়া হবে। বিদ্যুৎ না থাকলে সৌরবিদ্যুতের ব্যবস্থা করতে হবে। মনিটর করা হবে ওষুধের ডেট এক্সপায়ার করেছে কি না।

আমাদের করের টাকায় কিছু নরাধম রাজার হালে একাধিক বিবি, অগণিত সন্তান নিয়ে সংসার করে বেড়ায়, আর আমার দেশের মানুষ ফালতু কারণে মারা যায়, এসব হজম হয় না।

  • দূর পরবাসে ভ্রমণকাহিনি, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]