হৃদয়ছোঁয়া এক ভ্রমণ

আমার ছোট ভাই শাহীন মৃধা, লন্ডনপ্রবাসী। তিনি সম্প্রতি সপরিবার বাংলাদেশে বেড়াতে এসেছিলেন। ভ্রমণে আনন্দ যেমন থাকে, তেমনই বিষাদও থাকে। বিশেষ করে নিজ মাতৃভূমিতে ভ্রমণ সব সময় হৃদয়ে কোনো না কোনোভাবে দাগ কেটে যায়। এবারের ভ্রমণ শাহীনের বিবেকে একটু বেশিই নাড়া দিয়েছে, যদিও সে সব সময়ই বিবেকবান। দেশের বঞ্চিত ও সুবিধাবঞ্চিত মানুষের পাশে থেকে নানাভাবে তাদের জীবনের সুখ-দুঃখের অংশীদার হয়ে সে দূর প্রবাসে থেকেও কাজ করে যাচ্ছে।

এবারের ভ্রমণটি তার দেখা শ্রেষ্ঠ ভ্রমণগুলোর একটি ছিল। কারণ, সে ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থানের সময় ঢাকায় ছিল। ৫ আগস্ট গণভবনে গিয়েছিল। ১৯৭১-এর যুদ্ধের সময় শাহীন খুবই ছোট ছিল। আমার মনে পড়ে সেদিনের কথা, যেদিন পাকিস্তান বাহিনী আমাদের গ্রামের বাড়ি আক্রমণ করে। সবার হাতে অস্ত্র, শুধু নেই একজনের—সে ছিল পাকিস্তানি সেনাসদস্য। শাহীনকে বলতে শুনেছিলাম, ‘এই মিলিটারি, তোমার হাতে বন্দুক নেই কেন?’ সেদিন শাহীনের মনে কোনো ভয় ছিল না। কারণ সে এত ছোট যে ভয় কী জিনিস, তা তখনো সে শেখেনি।

৭১-এর সেই স্মৃতি নতুন করে মনে নিয়ে এবার শিক্ষার্থীদের সঙ্গে গণজাগরণের অংশীদার হয়ে নতুন বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার অনুভূতি অর্জন করতে পেরেছে সরাসরি কাছ থেকে। বিলেতে ফিরে এসে সে আমাকে তার এই মধুময় ভ্রমণের বর্ণনা টেলিফোন করে শোনায়। শাহীনের কথাগুলো আমার হৃদয় ছুঁয়ে গিয়েছিল। আমি তাকে বলেছিলাম, ‘লিখে পাঠাও, আমি এটা আমাদের পারিবারিক শেয়ার কর্নার থেকে শেয়ার করব অন্যদের জন্যেও।’ এবার আসুন জেনে নিই, সে কী লিখেছে—

‘প্রতিবারই দেশ থেকে ফিরে এসে কোনো না কোনো ঘটনা মনে থেকে যায় অনেক দিন। এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। বিশেষ করে যখন হাসিনার শেষ ভাষণ দেওয়ার ইচ্ছা পূরণ করতে দেওয়া হলো না, তার করুণ চেহারা, তার ভেতরে যে অসহায়ত্ব ফুটে উঠেছিল, তা ছিল দুর্দান্ত। লোভ–লালসা মানুষকে কখনো কখনো যে এতটা অসহায় করে তোলে, তা হাসিনাকে না দেখলে দেশবাসী বুঝত না। হাসিনার কথা তুললাম উদাহরণ হিসেবে। এখন আসি আসল কথায়।

‘সেদিন ছিল শুক্রবার। পল্লীবিদ্যুৎ বাজারের পাশ দিয়ে আসতেই মাছ বিক্রেতা বলল, “ভাই, বড় সাইজের পদ্মার ইলিশ আছে, নিয়ে যান।” আমি জিজ্ঞাসা করলাম, “কত বড় সাইজের?” সে বলল, “১ কেজি ২৩০ গ্রাম।” পরে দেখা গেল, আসলে মাত্র একটা মাছ, সেটি অতি যত্ন করে কেটে দিল। যা–ই হোক, পরিচিত মানুষ ভালোবেসে দিতে চেয়েছে বলে নিয়ে নিলাম। দাম পড়ল ২ হাজার ২০০ টাকার একটু বেশি। জুম্মার নামাজে যেতে হবে বলে শুধু একটা মাছ নিয়েই রিকশায় এলাম। পথে তার সঙ্গে কথার ফাঁকে জানতে পারলাম, লোকটা ১১ বছর ধরে ইলিশ মাছ কিনতে পারেনি। কী মনে হলো জানি না, রিকশা থেকে নামলাম এবং মাছটা রিকশাওয়ালা ভাইকে দিলাম। কিন্তু সে কিছুতেই নিতে রাজি হচ্ছিল না। মুহূর্তের মধ্যে ভাবলাম, ১১ বছর যে মানুষটা ইলিশ মাছ কিনতে পারেনি, তার জন্য পলিথিনে মোড়ানো ইলিশ মাছের টুকরাগুলো কীভাবে নিতে ইচ্ছা করছে না। সময়ের অভাবে একটু বিরক্ত হয়ে বললাম, “দেখ ভাই, আমি খুশি হয়েই তোমাকে দিলাম, তুমি বাসায় নিয়ে খাও।” শেষ পর্যন্ত তাকে রাজি করিয়ে মাছটি দিয়ে ঘরে ঢুকলাম গোসলের জন্য।

‘গায়ে অর্ধেক পানি ঢালার পর কলিংবেলের শব্দ ভেসে এল। কিছুটা বিরক্ত হয়ে গোসল সংক্ষেপ করে হেঁটে গিয়ে দেখি, লোকটি মাছ নিয়ে ফেরত এসেছে। আমি অবাক হয়ে বললাম, “আবার কী হলো?” সে যা বলল, তা শুনে সামান্য সময়ের জন্য ভাষা হারিয়ে ফেলেছিলাম। লোকটা বলতে শুরু করল, “আমার বউ বলেছে, মাছটা আপনি খাওয়ার জন্য কিনেছেন, সেটা নেওয়া ঠিক হয়নি। তুমি গিয়ে ওনাকে দিয়ে আসো এবং বলো যে আমার দুটো মেয়েকে যেন দুই পিস মাছ উনি দিয়ে দেন।” কথাগুলো শুনে তার উপর বিরক্ত না হয়ে কেমন যেন ভালো লাগা শুরু হলো। পরে তাকে আবার বুঝিয়ে মাছ দিয়ে ঘরে পাঠাই।

‘এখন আসি সার্বিক বিষয়ে—আমাদের দেশের রাজনীতিবিদেরা হাজারো কোটি টাকার মালিক হওয়ার পরও লোভ সামলাতে পারেন না। দুর্নীতিবাজ সরকারি চাকরিজীবী ও রাজনীতিবিদেরা যখন ধরা পড়েন, তখন দেখা যায়, তাঁদের স্ত্রীরাই অনেক সময় তাঁদের সব অপকর্মে উৎসাহিত করেছেন। হানিফ সংকেত একবার বলেছিলেন, “আমাদের দেশে নারীরা স্বামী পরকীয়া করলে যেভাবে জ্বলে ওঠে, তার ১০ ভাগের ১ ভাগ যদি ঘুষ খেলে জ্বলে উঠত, তাহলে দেশে দুর্নীতি থাকত না।”’

সেখানে একজন রিকশাওয়ালা ভাইয়ের স্ত্রী এবং তার বিবেচনাসহ নির্লোভ ভালোবাসা আমাকে নতুন করে ভাবতে শিখিয়েছে। স্বামী-স্ত্রী দুজনেই কতটা নির্লোভ, তা আমার মনে গভীর দাগ কেটে গেছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে অপকর্মে নারীদের দায় থাকলেও এর যে ব্যতিক্রম হয়, তা রিকশাওয়ালা ভাই ও তার স্ত্রীর কাজ দেখলে পরিষ্কার ধারণা পাওয়া যায়।

দেশ থেকে ফিরে আসার সময় আওয়ামী লীগের অপকর্মের বেদনা রিকশাওয়ালা ভাই এবং তার স্ত্রীর নির্লোভ মানসিকতা অনেকটাই কাটিয়ে উঠতে সাহায্য করেছে। পাশাপাশি নতুন করে স্বপ্ন দেখার ইচ্ছা জাগ্রত হয়েছে। বারবারই মনে হচ্ছে, দুর্নীতিবাজ রাজনীতিবিদ, সরকারি কর্মকর্তা–কর্মচারীদের পাশাপাশি হাজারো সৎ ও নির্লোভ মানুষ আমাদের চারপাশে রয়েছেন, তাঁদের নিয়ে সুন্দর বাংলাদেশ গড়া কোনো ব্যাপারই নয়।

শাহীনকে অনেক ধন্যবাদ তার ব্যক্তিগত দেশভ্রমণের অভিজ্ঞতা আমাদের সঙ্গে শেয়ার করার জন্য। তবে কেন যেন বারবার আমার মনে হচ্ছে, বাংলার সব মানুষের মধ্যে দেশপ্রেমের চেতনা ও মানবতার জাগরণ এসেছে, যা আমরা সঠিকভাবে কাজে লাগিয়ে সোনার বাংলা গড়তে পারব।

*লেখক: রহমান মৃধা, সুইডেন

**দূর পরবাসে ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]