মধ্যবিত্ত বাবা

অলংকরণ: শিখা

মধ্যবিত্তরা চাইলেই খামখেয়ালি জীবন যাপন করতে পারেন না। তাঁদের নানা হিসাব–নিকাশ করে জীবন যাপন করতে হয়। প্রতি পদে পদে জীবনের সঙ্গে আপস করে চলতে হয়। তাঁদের অঢেল উপার্জন থাকে না। ফলে একটা কিছু কিনতে গেলে দশবার চিন্তা না করে উপায় থাকে না। মধ্যবিত্ত পরিবারের প্রধান উপার্জন, ব্যয় ও সঞ্চয় আবর্তিত হতে থাকে পরিবারের প্রধান কর্তাব্যক্তি বাবাকে কেন্দ্র করে।

মধ্যবিত্ত পরিবারের বাবা নিজের সব সাধ–আহ্লাদ বিসর্জন দিয়ে সন্তানের শখ পূরণ করেন। দেখা যায়, ঘরের ছেলেটি একটা ফুটবল কেনার আবদার করেছে। কিন্তু বাবার হিসাবের সংসারে বাড়তি কোনো টাকা নেই একটা ফুটবল কিনে পুত্রের শখ পূরণ করার মতো। এর অর্থ এই নয় যে বাবা কিনতে চান না। তিনিও ঠিকই চান, তাঁর ছেলে রঙিন একটা ফুটবল নিয়ে মহানন্দে মাঠে খেলছে আর এক পাশে দাঁড়িয়ে তিনি ছেলের আনন্দ পাওয়ার আনন্দ উপভোগ করছেন। কিন্তু ইচ্ছা থাকলেই তিনি ইচ্ছা পূরণ করতে পারেন না। এ না পারার কষ্ট বুকে নিয়েই মধ্যবিত্ত পরিবারের বাবা জীবনকে টেনে নিয়ে যান। ভেতরে ভেতরে প্রস্তুতি নিতে থাকেন, কীভাবে একটা রঙিন ফুটবল কেনা যায় ছেলের জন্য। তাঁর এ নীরব প্রস্তুতির কথা পরিবারের কেউই জানেন না। মধ্যবিত্ত পরিবারের বাবা সবকিছু সামলান বড়ই নীরবে, নিজে ক্ষয়ে ক্ষয়ে।

মধ্যবিত্ত পরিবারের বাবাদের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জটা আসে ঈদ এলে। ঈদে পরিবারের সবাই নতুন জামাকাপড়ের আশা করে বসে থাকেন। স্ত্রী আশা করেন, ছেলে আশা করে, মেয়ে আশা করে। বাবা, মা জীবিত থাকলে তাঁরাও আশা করেন। কিন্তু যে মানুষটি কিছুই আশা করেন না, তিনি হলেন মধ্যবিত্ত পরিবারের বাবা। তাঁর সব চিন্তা থাকে, কীভাবে পরিবারের সবার মুখে হাসি ফোটাবেন। কীভাবে সবাইকে খুশি করবেন। আর এই খুশি করতে গিয়ে তিনি নিজের খুশিকে জলাঞ্জলি দিয়ে দেন। যখন পরিবারের সদস্যরা নতুন জামাকাপড় পরে ঈদের আনন্দে ব্যস্ত হয়ে পড়েন, তখন একজন মধ্যবিত্ত বাবা যে আগের বছরের পাঞ্জাবিটা ধুয়ে ইস্তিরি করে নিয়েছেন ঈদের নামাজে যাওয়ার জন্য, তা কারোরই নজরে পড়ে না। সবার আনন্দের মধ্যে একজন মধ্যবিত্ত বাবা ম্লান হয়ে যান।

মধ্যবিত্ত পরিবারের বাবা আরও বড় চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হন, যখন পরিবারের কন্যাসন্তানটি বিয়ের উপযুক্ত হতে থাকে। ইচ্ছা থাকুক আর না থাকুক, তাঁকে যৌতুক দেওয়ার প্রস্তুতি গ্রহণ করতে হয়। সীমিত উপার্জনে যেখানে সংসার চলে অনেক কষ্টে, সেখানে মেয়ের বিয়ের জন্য যৌতুকের টাকা জমানো তাঁর জন্য অগ্নিপরীক্ষা হয়ে দাঁড়ায়। নীরবে–নিভৃতে তিনি সে অগ্নিপরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নিতে থাকেন। পরিবারের অন্য সদস্যরা টেরই পান না, কী অনলপ্রবাহ বয়ে যায় তাঁর হৃদয়জুড়ে। তিনি এর কাছে হাত পাতেন, ওর কাছে হাত পাতেন। কতবার কতজনের কাছে নিগৃহীত হন, তা একমাত্র তিনিই জানেন। পরিবারের সদস্যরা কেবল আশা করে বসে থাকেন, তিনি যেহেতু সংসারের কর্তা, নিশ্চয় তিনি একটা ব্যবস্থা করবেন। কিন্তু এই একটা ব্যবস্থা যে কী কঠিন, কী দুরূহ, তা একমাত্র একজন মধ্যবিত্ত বাবাই জানেন।

মধ্যবিত্ত বাবার সংগ্রামটা অন্য আট–দশজন বাবার চেয়ে আলাদা। জীবনের কঠিন বাস্তবতা পদে পদে তাঁর পায়ে শিকল পরিয়ে দেয়। ছকে বেঁধে দেয় তাঁর সব আশা–আকাঙ্ক্ষা। জীবনের কাছে হেরে যেতে যেতে তিনি জেতার চেষ্টা করেন। কখনো পারেন, কখনো পারেন না। পরাজয়ের গ্লানি মেনে নিয়ে জীবনকে তিনি টেনে নিয়ে যান। কিন্তু তাঁর এই টেনে নিয়ে যাওয়া যে কত যন্ত্রণাদগ্ধ, তা একমাত্র তিনিই জানেন, পরিবারের সদস্যদের তিনি তা জানতেও দেন না। এক সুদীর্ঘ ত্যাগী মানুষের প্রতিকৃতি হলেন একজন মধ্যবিত্ত বাবা।

অনেক সময় দেখা যায়, পকেটে বাজার খরচ বাদ দিয়ে ২০০ টাকা আছে। একজন মধ্যবিত্ত বাবার মাথায় তখন কাজ করতে থাকে, তিনি এই ২০০ টাকা বাজারে যাতায়াতের জন্য রিকশায় খরচ না করে কীভাবে ছেলেটির জন্য একটা নতুন জামা কিনবেন। কিংবা কীভাবে মেয়েটির জন্য এক সেট নতুন সালোয়ার–কামিজ কিনবেন।

আর এই চিন্তা থেকে বাজারের ব্যাগটা হাতে নিয়ে তিনি রওনা হন হেঁটে। নিজেকে এই বলে সান্ত্বনা দেন, আরে এটুকুই তো পথ। কতক্ষণই–বা লাগবে! কখনো রোদে পুড়ে, কখনো বৃষ্টিতে ভিজে তিনি ঠিকই রিকশাভাড়ার টাকাটা বাঁচিয়ে ফেলেন ছেলেমেয়েটার শখ মেটাতে। তারা হয়তো বাবার এই ত্যাগের কথা কোনো দিনই জানতে পারে না।

একজন মধ্যবিত্ত বাবা বাজারে গেলেই হুটহাট করে বাজার করে ফেলতে পারেন না। একটা মাছ কেনার আগে, এক কেজি মাংস কেনার আগে তাঁকে পাঁচটা দোকান ঘুরতে হয়। দাম জিজ্ঞেস করতে হয়। দরাদরি করতে হয়। তারপর হিসাব করতে হয়, কোন দোকান থেকে কিনলে তিনি ৫০টা টাকা কমে কিনতে পারবেন। আর যে ৫০ টাকা তিনি বাঁচাতে পারলেন, তিনি তা খরচ করেন বাড়ি ফেরার পথে গলির মোড় থেকে কিছু ছোলা–পেঁয়াজু কিনে পরিবারের সবাই মিলে বিকেলের নাশতা করার জন্য। এভাবেই কত ছোট ছোট বিষয়ে সব সময় একজন মধ্যবিত্ত বাবার চিন্তা আবর্তিত হতে থাকে পরিবারের সদস্যদের একটু হাসি-আনন্দের কথা চিন্তা করে।

নিজে ঠিকমতো না খেয়ে একজন মধ্যবিত্ত বাবা সন্তানকে খাওয়ান। নিজে ছোট টুকরাটা খেয়ে বড় টুকরাটা রেখে দেন পড়ুয়া ছেলেটির জন্য। স্ত্রীকে বলেন, ‘ছেলেটার জন্য রেখে দাও, ওর যে খাটাখাটুনি যাচ্ছে।’ কখনো আমের টুকরাটা না খেয়ে শুধু বড়া খেয়ে টুকরাটা রেখে দেন মেয়েটার জন্য। স্ত্রীকে বলেন, ‘মেয়েটাকে দিয়ো, রোদে পুড়ে স্কুল থেকে ক্লান্ত হয়ে আসবে।’

এভাবে একজন মধ্যবিত্ত বাবা সীমিত সামর্থ্য দিয়ে সন্তানদের প্রতি তাঁর স্নেহ–ভালোবাসার জানান দেন অতি নীরবে। বিনিময়ে সন্তানের খুশি ছাড়া তাঁর আর কিছুই চাওয়ার থাকে না। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে একজন মধ্যবিত্ত বাবা খুব কমই এর প্রতিদান পান। তাঁর ত্যাগের কথা, তাঁর সংগ্রামের কথা প্রায়ই অজানা থেকে যায় পরিবারের সদস্যদের কাছে, সন্তানের কাছে। যে কারণে হামেশা এর কোনো মূল্যায়নই হয় না। কঠিন সামাজিক বাস্তবতা হলো সন্তান বড় হওয়ার পর খুব কমই বাবার এসব ছোট ছোট ত্যাগের কথা মনে রাখেন। যে কারণে কোনো মূল্যায়নও হয় না। সন্তানের বর্তমান আচরণ আর ফেলে আসা অতীতের দিকে তাকিয়ে একজন মধ্যবিত্ত বাবার তখন কিছু দীর্ঘশ্বাস গোপন করা ছাড়া আর কিছুই করার থাকে না। কেবলই কিছু দীর্ঘশ্বাস!

লেখক: লন্ডনপ্রবাসী কবি