‘প্রত্যয়’ স্কিম শুভংকরের ফাঁকি!
সর্বজনীন পেনশন স্কিমের যাত্রা শুরু হয়েছিল দেশে পেনশন সুবিধাহীন ব্যক্তিদের সামাজিক সুরক্ষায় পেনশনের আওতাভুক্ত করার জন্য। রাজনৈতিক কিছু বিরোধিতা ছাড়া বিভিন্ন পক্ষ সাধুবাদ জানিয়েছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরাও বিষয়টিকে ইতিবাচক হিসেবে লেখালেখি ও টকশো করেছেন। তাহলে ‘প্রত্যয়’ স্কিমে অন্তর্ভুক্ত করলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা কেন বিরোধিতা করছেন? কারণ, ‘প্রত্যয়’ স্কিমে শুভংকরের ফাঁকি রয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা প্রত্যয় স্কিমকে তুলনা করছেন তাঁদের বর্তমানে প্রাপ্ত পেনশন সুবিধার সঙ্গে। বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, বর্তমানে প্রাপ্ত সুবিধা থেকে প্রত্যয় স্কিমে প্রাপ্ত সুবিধা অনেক কম। হিসাবটা সহজ। বর্তমান পেনশন পদ্ধতিতে একজন অধ্যাপক অবসরের সময় এককালীন পেতেন প্রায় ৮১ লাখ টাকা। সাধারণত অবসরের পর প্রাপ্ত টাকা পেনশভোগীরা সঞ্চয়পত্র ও অন্যান্য খাতে বিনিয়োগ করেন। এই ৮১ লাখ টাকা তিনি যদি সঞ্চয়পত্রসহ অন্যান্য খাতে বিনিয়োগ করেন, তাহলে মাসিক আনুমানিক আয় আসবে ৭৫ হাজার টাকার কমবেশি। বর্তমান পেনশন পদ্ধতিতে একজন অধ্যাপক প্রতি মাসে পেনশন পান প্রায় ৪৫ হাজার ৭৯০ টাকা।
নতুন প্রত্যয় স্কিম পদ্ধতিতে বেতন থেকে মাসে যে ৫ হাজার টাকা কাটবে সেই ৫ হাজার টাকা কিস্তিতে জীবন বীমা করপোরেশনের সঙ্গে জীবন বিমা করলে পেনশন হিসেবে ৫৭ বছর বয়স থেকে আজীবন পাওয়া যাবে ৩২ হাজার ৫০০ টাকা। এ রকম বিমার টাকা চাইলে অর্ধেক সমর্পণ করে এককালীন উত্তোলন করে নেওয়া যাবে। সে ক্ষেত্রে এককালীন পাওয়া যাবে ১৬ লাখ ৫০ হাজার টাকা, এ টাকাও পুনর্বিনিয়োগ করে আনুমানিক মাসিক ১৬ হাজার টাকা আয় করা যাবে এবং বাকি অর্ধেক আজীবন পেনশন আসবে মাসিক ১৬ হাজার ২৫০ টাকা। মানে, ১৬ লাখ ৫০ হাজার টাকা এককালীন ও ৩২ হাজার ২৫০ টাকা মাসিক।
এ হিসেবে বর্তমান পদ্ধতিতে একজন পেনশনারের অবসরকালে বিমা ও গ্র্যাচুইটি থেকে এককালীন মোট নগদ আয় ৯৭ লাখ ৫০ হাজার টাকা এবং বিনিয়োগ, বিমা ও পেনশন থেকে মোট সম্ভাব্য মাসিক আয় ১ লাখ ৫৯ হাজার টাকা। কিন্তু প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী নতুন পদ্ধতিতে একজন পেনশনার পাবেন শুধু ১ লাখ ২৪ হাজার ৬৬০ টাকা, কোনো এককালীন টাকা নেই। স্পষ্টভাবেই প্রত্যয় স্কিম অনুযায়ী একজন পেনশনারের ক্ষতি হবে এককালীন ৯৭ লাখ ৫০ হাজার টাকা, যা পেনশনারের স্থায়ী সম্পদ হতো এবং মাসিক পেনশনে ও পুনর্বিনিয়োগ সুযোগ ও আয় কমে যাবে প্রায় ৩৪ হাজার টাকা। যদি একজন পেনশনার বা তাঁর নমিনি ১৫ বছরও পেনশন পান, সে ক্ষেত্রেও মাসিক পেনশন বাবদ মোট কম পাবেন ৬১ লাখ টাকা। বার্ষিক ৫ শতাংশ হারে ইনক্রিমেন্ট, নতুন পে-স্কেলে বেতন বৃদ্ধি ও ১৫ বছরের বেশি বেঁচে থাকা বিবেচনায় নিলে এ ক্ষতির পরিমাণ আরও অনেক বাড়বে। সার্বিকভাবে একজন পেনশনারের তুলনামূলক ক্ষতি হবে প্রায় ১ কোটি ৬০ লাখ টাকা (২০১৫ সালের পে-স্কেল অনুযায়ী)। আগামী ৩০ বছরের নতুন পে-স্কেলে বেতন বৃদ্ধি (৩ গুণ হলে), পেনশনের ইনক্রিমেন্ট ও বর্তমান আয়ুষ্কাল বিবেচনায় নিলে এ ক্ষতি দাঁড়াবে প্রায় ৫ কোটি টাকা।
প্রত্যয় স্কিম বর্তমান শিক্ষকদের জন্য প্রযোজ্য নয়, কেবল নতুন নিয়োগপ্রাপ্তদের জন্য প্রযোজ্য। কিন্তু এককালীন সুবিধাবিহীন, ইনক্রিমেন্টবিহীন কম সুবিধাসম্পন্ন এ প্রত্যয় স্কিম নতুনদের এ পেশায় আকর্ষিত করবে না। তা ছাড়া স্বাধীনতার পর সরকারি চাকরিতে সুযোগ-সুবিধা কমানো হয়েছে, এমন ঘটনাও বিরল। এককালীন গ্র্যাচুইটিসহ অন্যান্য সুবিধা বহাল রেখে করলে যেকোনো স্কিমই গ্রহণযোগ্য হতো। ২০১৫ সালের পে-স্কেলের পর থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতা পেশার তুলনায় অন্য অনেক পেশাকে কৌশলে অধিক সুযোগ-সুবিধাসম্পন্ন করা হয়েছে, যার প্রভাব পরেছে সার্বিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাব্যবস্থায়। বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক জ্ঞান আহরণের আগ্রহ কমে গেছে শিক্ষার্থীদের মধ্যে। কারণ, একাডেমিক জ্ঞান তাঁদের চাকরির পরীক্ষায় কাজে লাগছে না, বরং মাধ্যমিক-উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ের জ্ঞান অধিক কার্যকর। যে দু-একজন পড়াশোনা করেন, তাঁরা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতা পেশায় আগ্রহ থেকে করেন। প্রত্যয় স্কিম কৌশলগত শেষ পেরেক, যার মাধ্যমে শিক্ষকতা ও শিক্ষা খাত পড়বে মেধাহীনতার দুষ্টচক্রে।
প্রতিবেশী দেশ ভারতে প্রত্যয় স্কিমের মতো পেনশন পলিসি বিদ্যমান বলে সরকারের পক্ষ থেকে উল্লেখ করা হয়েছে; কিন্তু ভারতে একজন বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাপকের বেতন বাংলাদেশের একজন অধ্যাপকের বেতনের ৫ গুণ, সেটা উল্লেখ করা হয়নি। বর্তমান সরকারের একটি নীতিগত সিদ্ধান্ত হচ্ছে, জেলায় জেলায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা, কিন্তু এ নীতি কেবল বিশ্ববিদ্যালয়ের অবকাঠামো তৈরি করায় সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় সংখ্যাগত বৃদ্ধি এবং শিক্ষকতা পেশায় আকর্ষণ, তথা শিক্ষার গুণগত মান বৃদ্ধিতে রয়েছে নীতির বৈপরীত্য। অর্থ মন্ত্রণালয় ও পেনশন কর্তৃপক্ষ নতুন স্কিমের মাধ্যমে শিক্ষকদের উপকার করতে চাচ্ছে; কিন্তু যে ‘উপকার’ গ্রহীতা নিতে চাচ্ছেন না, সেই উপকার না করলে হয় না? শিক্ষক ও শিক্ষা খাতের উপকার চাইলে প্রতিবেশী দেশের সমমানের বেতন বাড়িয়ে, সুপারগ্রেড নিশ্চিত করে ও বর্তমান পেনশনের সমমানের কোনো পেনশন পলিসি চালু করুন।
লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, হিসাববিজ্ঞান ও তথ্যপদ্ধতি বিভাগ, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয় ও পিএইচডি গবেষক, ইউনিভার্সিটি অব মিজৌরি, যুক্তরাষ্ট্র।