সুন্দরবনের নীরবতায় ফিনল্যান্ডের অনুভূতি
সম্প্রতি প্রকাশিত হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের পৃথিবীব্যাপী চলা ৮৫ বছরের এক গবেষণার ফলাফল বলছে, খাদ্যাভ্যাস বা ব্যায়ামের চেয়ে পরিবার আর বন্ধু আমাদের সুস্থভাবে বেঁচে থাকার জন্য অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। (প্রথম আলো, ৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৪)। এ ছাড়া বিশেষজ্ঞদের মতে, বিভিন্ন জায়গায় ঘুরতে যাওয়া বা ভ্রমণ স্বাস্থ্যের জন্য খুবই উপকারী। তাই পরিবার বা বন্ধুদের সঙ্গে কখনো যদি ভ্রমণের সুযোগ আসে, আমি সেটা হাতছাড়া করি না। কৈশোর জীবনের কলেজের বন্ধুদের সঙ্গে তিন দিনের ছোট্ট একটা ভ্রমণের এমনটাই সুযোগ পেয়ে গেলাম এ বছরের ফেব্রুয়ারিতে।
বছরের এ সময়টাতে ফিনল্যান্ডে আমরা এক সপ্তাহের শীতকালীন ছুটি পাই। উচ্চশিক্ষার্থে বিদেশে চলে আসি ২৯ বছর আগে ক্যাডেট কলেজ থেকে পাস করার পড়ে, দেশের অনেক রোমাঞ্চকর জায়গা যেমন যাওয়া হয়ে ওঠেনি, তেমনি হয়ে ওঠেনি অনেক বন্ধুদের সঙ্গে আর দেখা। ক্যাডেট কলেজের বন্ধুদের মধ্যে আমাদের বন্ধনটা একটু বেশিই। এর কারণ হয়তোবা যে সময়টাতে আমাদের বাবা-মা, ভাই-বোন, আত্মীয়স্বজনদের সঙ্গে থাকার কথা ছিল, সে সময়টা আমরা কাটিয়েছি সব বন্ধুর সঙ্গে। প্রতি চার বছর পরপর অরকা, আমাদের এক্স ক্যাডেট অ্যাসোসিয়েশন রাজশাহীর সারদায় পদ্মাপারের ক্যাডেট কলেজে রি–ইউনিয়নের আয়োজন করে। ব্যাচমেট, সিনিয়র, জুনিয়র এবং অন্য স্টাফদের সঙ্গে দেখা হওয়ার, কিছু সময় কাটানোর এটা দুর্লভ সুযোগ। এক্স ক্যাডেটদের অনেকেই আমার মতো প্রবাসীর রি–ইউনিয়ন উপলক্ষে সে সময়টা দেশে আসার চেষ্টা করে।
এ বছর ১-৪ ফেব্রুয়ারি কলেজ রি–ইউনিয়ন হবে শুনছিলাম; কিন্তু পরে এসএসসি পরীক্ষাও ফেব্রুয়ারিতে পড়ায় এটা বাতিল হয়ে যায়। সংগত কারণেই মনটা খুব খারাপ হয়। কিন্তু আমাদের ব্যাচের বন্ধুরা নাছোড়বান্দা, আমরা রি–ইউনিয়ন করবই, কলেজ রি–ইউনিয়ন হবে না ঠিকই, কিন্তু একই ফরম্যাটে একই সময়ে হবে ব্যাচ রি–ইউনিয়ন। জায়গা হিসেবে বেছে নিলাম বিশ্বের অন্যতম সমুদ্রতীরবর্তী ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবনকে। ব্যাচমেট সুন্দরবন দস্যুমুক্ত করার নায়ক মোহসীন-উল হাকিম, তাঁর সহযাত্রী বেলায়েত সরদার ও বায়েজিদ ইসলাম পলিনকে সঙ্গে পাব, এদের চেয়ে অভিজ্ঞ গাইড আর কোথায় পাব! দুই রাত তিন দিনের ভ্রমণ প্যাকেজের জন্য পর্যটকবাহী ছোটখাটো জাহাজ ‘এমভি দ্য ওয়েভ’ বুকিং করা হলো। ঢাকা থেকে মংলাগামী একটা এসি বাসও রিজার্ভ করা ছিল।
১ ফেব্রুয়ারি, বৃহস্পতিবার রাত ১১টায় বাস ছাড়ার কথা ঢাকার পীরেরবাগ থেকে; কিন্তু বাসের খবর নেই। ঘণ্টাখানেক পর বাস এল, ছাড়ল ২ ফেব্রুয়ারি, শুক্রবার দিবাগত রাতে। কিছুদূর যেতেই দেখি যানবাহনের লম্বা সারি। প্রায় দেড় বছর আগে পদ্মা সেতু উদ্বোধন হয়; সম্ভবত এ কারণেই সুন্দরবন ভ্রমণে দেশি-বিদেশি পর্যটক এখন অনেক বেড়েছে। আমি বেশ ক্লান্ত ছিলাম, তবু বাসে জেগে ছিলাম প্রথমবারের মতো পদ্মা সেতু দেখার জন্য। পদ্মা সেতুর সৌন্দর্য দেখে খুব ভালো লেগেছে। যাহোক ভোরবেলায় মোংলায় পৌঁছে গেলাম, ফেরিঘাট থেকে একটা ইঞ্জিনবোটে চড়ে কিছুদূর যেতেই দেখি ‘দ্য ওয়েভ’ আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে। জাহাজে উঠে বরাদ্দ করা রুমে লাগেজগুলো রেখেই ছুটলাম সকালের নাশতার জন্য। তিন বেলার খাবার, দুই বেলা হালকা নাশতা, বন বিভাগের অনুমতি, নিরাপত্তারক্ষীসহ যাবতীয় খরচ প্যাকেজের অন্তর্ভুক্ত ছিল। সুন্দরবন বিশাল একটি অঞ্চল, দর্শনীয় জায়গা রয়েছে এখানে অনেক। এত অল্প সময়ে সবকিছু দেখা সম্ভব না, তাই জাহাজে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডার পাশাপাশি তিনটি জায়গা ঘুরে দেখব বলে ঠিক করলাম: তিনকোনা দ্বীপ, দুবলার চর ও বঙ্গবন্ধু চর।
পশুর নদ ধরে জাহাজ দক্ষিণে চলতে শুরু করল, কিছুদূর যেতেই পশ্চিম দিকে চোখে পড়ল ঢাংমারী খাল, মূলত এখান থেকেই সুন্দরবন শুরু, জাহাজের দুই পাশেই সুন্দরবন। জাহাজের ওপরতলা থেকে সুন্দরবনের সৌন্দর্য সবচেয়ে বেশি উপভোগ করা যায়। তীর ঘেঁষে হাঁটা কয়েকটা হরিণের দেখা মিলল। মাঝেমধ্যে দেখা গেল কিছু ডলফিন। যাওয়ার পথে বেশ কিছু খাল দেখা গেল, গাইড বলল পূর্ব দিকে জয়মনিরঘোল, নন্দবালা, হারবাড়িয়া, চড়াপুটিয়া হয়ে পশ্চিম দিকে আকরাম পয়েন্ট। সেখান থেকে পৌঁছে গেলাম তিনকোনা দ্বীপে। নিরিবিলি খুব সুন্দর এ জায়গাটা। জাহাজ নোঙর করে আমরা ইঞ্জিনবোটে চড়ে তিনকোনা দ্বীপের খালগুলোতে ঘুরে বেড়িয়েছি। সুন্দরী ছাড়াও যে ধরনের গাছপালা খালের পাশ দিয়ে দেখতে পেলাম: গড়ান, প্রেমকাঁটা, হেতাল, গোলপাতা, কেওড়া ও কেওড়াবন। এখানে একটা জায়গায় আমরা নেমেছিলাম, বন্ধুরা সবাই মিলে কিছু সময় কাটিয়েছি।
এটাই ছিল সুন্দরবনে আমার জীবনের প্রথম পা দেওয়া। কিছুটা সাবধানে হাঁটতে হয়েছিল গাছের শ্বাসমূল থাকাতে। আমরা এখানে কিছু বন্য হরিণ দেখতে পেয়েছি, শুনেছি এখানে বাঘও আসে। বিকেলের আগেই পশুর নদে ফিরে এলাম, এখান থেকে উল্টো দিকে ছিল নীলকমল বা হিরণ পয়েন্ট। সন্ধ্যার দিকে নেমেছিলাম সুন্দরবনের জেলে দ্বীপ দুবলার চরের আলোর কোলে। এখানে গড়ে উঠেছে অনেক শুঁটকিপল্লি। প্রতিবছর অক্টোবরের বা নভেম্বর থেকে মার্চ পর্যন্ত এখানে চলে মাছ আহরণ ও শুঁটকি তৈরির কাজ। বছরের বাকি সময় থাকে প্রাণহীন। আমরা যে সময় গিয়েছিলাম সে সময়টা দুবলার চরে বেশি লোকজন দেখতে পেলাম না। যতটুকু জেনেছি, এ সময়টাকে বলা হয় মরা গোন। সাগরের অনেক গভীরে সরে যায় মাছের দল, মাছ পাওয়া যায় কম। তাই মরা গোনের সময় ছুটিতে চলে যায় জেলের দল। আমরা কিছুদূর হাঁটতেই পেয়ে গেলাম নিউমার্কেট। এখানে রয়েছে বিভিন্ন খাবার হোটেল। কিছু সময় এখানে স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বললাম। এরপর রাত হওয়ার আগেই ফিরে এলাম জাহাজে।
ভ্রমণের দ্বিতীয় দিনে আমাদের গন্তব্য ছিল ‘বঙ্গবন্ধু চর’। পশুর নদের মোহনায় আমাদের জাহাজ যেখানে নোঙর করা ছিল সেখান থেকে ঘণ্টা দুয়েকের পথ। জাহাজ নোঙর করে আমরা ইঞ্জিনবোটে করে গিয়ে নেমে পড়লাম নয়নাভিরাম এই চরে। দুবলার চর যদি হয়ে থাকে নারীহীন চর, এ চরকে বলা যায় জনবসতিহীন একটা চর। আমার কাছে অর্ধচন্দ্রাকৃতির এ চরটি আমাদের এ ভ্রমণের সবচেয়ে আকর্ষণীয় জায়গা মনে হয়েছে। চরের তীরেই আমরা ইন্টার-হাউস ভলিবল প্রতিযোগিতার আয়োজন করেছিলাম। খুব প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হয়েছিল খেলাগুলো, বেশ মজা হয়েছিল। তিনটি ম্যাচ ছিল, দ্বিতীয় ম্যাচের মাঝপথে জোয়ারে পানি বাড়তে থাকল। উপায় না দেখে তৃতীয় ম্যাচের জন্য আমরা চরের একটু ভেতরের দিকে হাঁটা দিলাম, আর তখনই দেখতে পেলাম বাঘের পায়ের ছাপ। ধারণা করা যাচ্ছে, আগের রাতে হেঁটে গেছে একটা রয়েল বেঙ্গল টাইগার। পরে জেলেদের কাছে শুনলাম এখানে তিন থেকে চারটি বাঘের সন্ধান মিলেছে। যাহোক বঙ্গবন্ধু চরকে বিদায় দিয়ে মধ্যাহ্নভোজের আগেই চলে আসলাম জাহাজে। বঙ্গবন্ধু চর থেকে ফিরে এসে জাহাজ আবারও পশুর নদের মোহনায় দুবলার চরের পাশেই নোঙর করল। জাহাজে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডার পাশাপাশি ছিল সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। রাতের দিকে আমাদের কিছু বন্ধু দুবলার চরের জামতলায় গিয়েছিল মাছ ধরতে, জামতলার শুঁটকিপল্লি বেশ নির্জন ছিল। শুনেছি সেখানে প্রায়ই বাঘ আসে।
তৃতীয় ও শেষ দিনে আমরা প্রায় সবাই জাহাজেই ছিলাম। কার্ড, ক্যারামের মতো ইনডোর গেমসগুলো খেলা হলো, বিকেলের দিকে অনুষ্ঠিত হয় পুরস্কার বিতরণী। সুন্দরবনকে দস্যুমুক্ত করার অগ্রণী ভূমিকার জন্য আমাদের ব্যাচের পক্ষ থেকে বিশেষ সম্মাননা জানানো হয় মোহসীন, বেলায়েত এবং পলিনকে। এ ছাড়া ব্যাচে বিশেষ ভূমিকা রাখার জন্য বন্ধু শাহরিয়ার এবং রোকনকেও বিশেষ সম্মাননা জানানো হয়। খুলনায় পৌঁছালাম রাত সাড়ে নয়টায়, সেখান থেকে আবার রিজার্ভ করা বাসে ঢাকা আসতে সময় লাগল চার ঘণ্টা।
বাংলাদেশে প্রায় সব জায়গায়, বিশেষ করে শহরগুলো কোলাহলপূর্ণ। অন্যদিকে সবুজ অরণ্য ও হাজারো হ্রদে ঘেরা ফিনল্যান্ডে সব সময়ই ছিমছাম নীরবতা। সুন্দরবনের নীরবতায় এ তিন দিন আমার কাছে মাঝেমধ্যে মনে হয়েছে আমি ফিনল্যান্ডেই আছি। এ ভ্রমণের পরপরই ছুটি শেষে ফিনল্যান্ডে চলে আসি; কৈশোরের বন্ধুদের সঙ্গে এই তিন দিন আমার হৃদয়ে সব সময়ই একটা জায়গা করে রাখবে।
* লেখক: মারুফ দেওয়ান, সিনিয়র ইঞ্জিনিয়ার, রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট, এরিকসন, ফিনল্যান্ড
**দূর পরবাসে ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]