ব্রিকস সম্মেলন: পুতিনের কূটনৈতিক বিজয় এবং আন্তর্জাতিক ক্ষমতার ভারসাম্য পরিবর্তনের চেষ্টা
ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকেই পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা এবং আন্তর্জাতিক বিচ্ছিন্নতার মুখোমুখি হওয়া সত্ত্বেও রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন সাম্প্রতিক ব্রিকস সম্মেলনে কূটনৈতিক ক্ষেত্রে একটি বিশাল সাফল্য অর্জন করেছেন। চীন, ভারত এবং দক্ষিণ আফ্রিকার নেতাদের রাশিয়ায় স্বাগত জানিয়ে তিনি বৈশ্বিক মঞ্চে নিজের প্রভাবশালী অবস্থান আরও দৃঢ় করতে সক্ষম হয়েছেন। এ সম্মেলন এমন একসময় অনুষ্ঠিত হয়েছে, যখন পশ্চিমা শক্তিগুলো রাশিয়াকে বিশ্বরাজনীতি থেকে বিচ্ছিন্ন করার প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। কিন্তু পুতিন চীন, ভারত এবং অন্য উন্নয়নশীল দেশের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক আরও শক্তিশালী করে নিজেকে দৃঢ়তর অবস্থানে স্থাপন করেছেন।
ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিনাল কোর্ট (আইসিসি) তাঁর বিরুদ্ধে জারি করা গ্রেপ্তারি পরোয়ানার কারণে আন্তর্জাতিক ভ্রমণে বাধার সম্মুখীন হলেও পুতিন চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এবং দক্ষিণ আফ্রিকার নেতাদের রাশিয়ায় স্বাগত জানিয়ে নিজের একটি শক্তিশালী কূটনৈতিক অবস্থান তুলে ধরতে পেরেছেন। কাজানের ঐতিহাসিক ক্রেমলিনে শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে তিনি দেখিয়ে দেন যে পশ্চিমা বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন হলেও তাঁর শক্তিশালী মিত্র রয়েছে বৈশ্বিক অঙ্গনে। চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং রাশিয়ায় পৌঁছানোর সময় তাঁর বিমান রাশিয়ান ফাইটার জেট দ্বারা এসকর্ট করা হয় এবং তাঁকে রেড কার্পেট সংবর্ধনা ও ঐতিহ্যবাহী খাবারের মাধ্যমে স্বাগত জানানো হয়। নেতাদের এই উপস্থিতি পুতিনের জন্য একটি কূটনৈতিক মঞ্চ তৈরি করেছে, যেখানে তিনি পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার মধ্যেও নিজেকে বৈশ্বিক প্রভাবশালী রাজনীতিবিদ হিসেবে উপস্থাপন করতে সক্ষম হয়েছেন।
BRICS (ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চীন এবং দক্ষিণ আফ্রিকা) এবারের সম্মেলনে মিসর, ইথিওপিয়া, ইরান ও সংযুক্ত আরব আমিরাতকে নতুন সদস্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করেছে। এ সম্প্রসারণ বিশ্বের মোট জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক এবং বৈশ্বিক অর্থনীতির ৩৫ শতাংশের বেশি কভার করে, যা যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রভাবকে দুর্বল করার লক্ষ্যে কাজ করছে। চীন, রাশিয়া ও ইরান ব্রিকসকে ব্যবহার করে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার ক্ষমতার প্রতি চ্যালেঞ্জ তুলে ধরার চেষ্টা করছে, অন্যদিকে ভারত ও ব্রাজিল উন্নয়নশীল দেশগুলোর স্বার্থ রক্ষার লক্ষ্যে আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানের সংস্কারে গুরুত্বারোপ করছে।
ব্রিকস-এর সম্প্রসারণ বৈশ্বিক ক্ষমতার ভারসাম্য পরিবর্তনের ইঙ্গিত দিচ্ছে। নতুন সদস্যদের অন্তর্ভুক্তি BRICS-এর মধ্যে ঐকমত্যে পৌঁছানোকে কঠিন করে তুলতে পারে, বিশেষত, একটি নতুন বৈশ্বিক পেমেন্ট সিস্টেম তৈরি করার প্রচেষ্টা। পুতিনের নেতৃত্বে একটি বিকল্প অর্থনৈতিক নেটওয়ার্ক গড়ে তোলার আলোচনা চলছে, যা SWIFT-এর পরিবর্তে কাজ করতে পারে। SWIFT থেকে রাশিয়াকে বাদ দেওয়ার পর একটি স্বতন্ত্র পেমেন্ট সিস্টেম গড়ে তোলার পরিকল্পনা বৈশ্বিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় নতুন মাত্রা যুক্ত করতে পারে।
BRICS-এর সদস্য এবং সহযোগী দেশগুলো বিভিন্ন উপায়ে রাশিয়ার অর্থনীতিতে সহায়তা প্রদান করলেও ইউক্রেন যুদ্ধে চূড়ান্ত বিজয়ের জন্য এটি যথেষ্ট কি না, সে বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের মধ্যে সংশয় রয়েছে। রাশিয়ান অর্থনীতিকে শক্তিশালী করার জন্য ভারত যেমন রাশিয়া থেকে তেল আমদানি করছে, ঠিক তেমনই ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি পুতিনকে বলেন, ‘আমরা বিশ্বাস করি, বিরোধের সমাধান শান্তিপূর্ণভাবে করা উচিত।’ এটি পরিষ্কার যে ভারতের দৃষ্টিভঙ্গি রাশিয়ার প্রতি একেবারে সমর্থন নয় বরং মধ্যপন্থী। তিনি সংঘাতের দ্রুত সমাধানের জন্য জোর দিয়েছেন, যা রাশিয়ার সঙ্গে ভারতের কূটনৈতিক সম্পর্ক বজায় রাখার একটি কৌশল।
জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেসের উপস্থিতি ইউক্রেনের মধ্যে অসন্তোষ সৃষ্টি করেছে। অনেকেই মনে করছেন, গুতেরেসের রাশিয়া সফর রাশিয়ার বৈশ্বিক বিচ্ছিন্নতা কাটিয়ে ওঠার প্রচেষ্টা হিসেবে কাজ করছে। তবে সম্মেলনে তাঁর উপস্থিতি নিয়ে বিতর্ক থাকলেও BRICS-এর কূটনৈতিক প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে এবং পুতিন নিজের কূটনৈতিক সক্ষমতাকে আরও দৃঢ় করেছেন।
BRICS সম্মেলন পুতিনের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ কূটনৈতিক সাফল্যের মঞ্চ তৈরি করেছে, যেখানে তিনি পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার প্রভাবকে কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হয়েছেন। তবে ইউক্রেন যুদ্ধের পটভূমিতে রাশিয়ার অবস্থান আরও শক্তিশালী করতে কেবল কূটনৈতিক সমর্থন যথেষ্ট নয়; এর জন্য আরও বাস্তবসম্মত অর্থনৈতিক ও সামরিক পদক্ষেপের প্রয়োজন রয়েছে। BRICS-এর সম্প্রসারণ এবং সদস্যদেশগুলোর বৈশ্বিক আর্থিক প্রভাব বাড়ানোর প্রচেষ্টা একটি নতুন আন্তর্জাতিক ব্যবস্থার সম্ভাবনা ইঙ্গিত দিচ্ছে। তবে এই উদ্যোগগুলো কতটা সফল হবে, তা সময়ই বলে দেবে।