সিডনির শপিং মলে হামলা, বাংলাদেশিরা ভালো আছেন
অস্ট্রেলিয়ার সিডনির একটি শপিং মলে আচমকা এক ব্যক্তির এলোপাতাড়ি ছুরিকাঘাতে ৬ জন নিহত এবং ১২ জন মারাত্মক জখম হওয়ার ঘটনা ঘটেছে। এরপর পুলিশের গুলিতে এই আক্রমণকারীও নিহত হয়। গত শনিবার (১৩ এপ্রিল) সিডনির জনপ্রিয় ভ্রমণ গন্তব্য বন্ডাই সমুদ্রসৈকতের নিকটবর্তী ওয়েস্টফিল্ড বন্ডাই শপিং সেন্টারে এ মর্মান্তিক হামলা ঘটে। সাম্প্রতিক দশকের মধ্যে এটিই দেশটির সবচেয়ে মারাত্মক গণ-সহিংসতার ঘটনা বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। তবে দেশটির পুলিশ এখন পর্যন্ত নিশ্চিত করেছে, এ ঘটনার পেছনে কোনো জঙ্গিবাদ বা নির্দিষ্ট কোনো উদ্দেশ্য নেই। গতকাল রোববার বন্ডাই পরিদর্শন করেছেন এই প্রতিবেদক। কোনো বাংলাদেশির হতাহতের খবর পাওয়া যায়নি।
সিডনির দুপুরে আচমকা হামলা
সিডনির সময় দুপুর ৩টা ২০। এক ব্যক্তি প্রায় ১ ফুট লম্বা ছুরি হাতে সিডনির ওয়েস্টফিল্ড বন্ডাই জংশন শপিং সেন্টারে প্রবেশ করে। এর পরপরই এই ব্যক্তি এলোপাতাড়িভাবে টানা ৯ জনকে ছুরি দিয়ে আঘাত করে। শপিং মলের ভেতর শতাধিক মানুষের ছোটাছুটি শুরু হয়ে যায়। এরপর আক্রমণকারী এদিক-ওদিক দৌড়ে আরও ৯ জনকে আঘাত করে।
হামলার শিকার হলেন যাঁরা
সিডনির এই হামলায় শিকার বেশির ভাগই নারী। ছুরিকাঘাতে ঘটনাস্থলে ৫ জন এবং হাসপাতালে নেওয়ার পর আরও একজন নিহত হয়েছেন। নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে ৫ জন নারী এবং আক্রমণকারীকে বাধা দেওয়ার চেষ্টায় শপিং মলের নিরাপত্তাকর্মী একজন পুরুষ রয়েছেন। এর মধ্যে একজন চীনের শিক্ষার্থীও রয়েছেন। আহত ১২ জনের মধ্যে ৯ মাস বয়সী মেয়ে শিশু থেকে ৫৫ বছর বয়সী নারীও রয়েছেন। আহত ব্যক্তিদের মধ্যে ৮ জন গুরুতর অবস্থায় চিকিৎসাধীন।
আক্রমণকারী পুলিশের গুলিতে নিহত
জরুরি অবস্থার কল পেয়ে দ্রুত ঘটনাস্থলে পৌঁছায় পুলিশ। তৎক্ষণাৎ পুলিশ গোটা শপিং মল এবং আশপাশের এলাকা বন্ধ করে দেয়। প্রথমে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা করেন তাঁরা। আক্রমণকারীর গতিবিধি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ায় পুলিশ আক্রমণকারীকে গুলি করে এতে ঘটনাস্থলে নিহত হয় আক্রমণকারী।
কোনো বাংলাদেশি হতাহত হননি
বন্ডাই এলাকায় বাংলাদেশিদের ব্যবসা এবং বাংলাদেশি কর্মী রয়েছেন। তবে এখন পর্যন্ত কোনো বাংলাদেশির হতাহতের খবর পাওয়া যায়নি।
আক্রমণকারী অস্ট্রেলিয়ার কুইন্সল্যান্ড রাজ্যের বাসিন্দা
নিহত আক্রমণকারীকে শনাক্ত করেছে পুলিশ। তাঁর নাম জোল কাওচি, বয়স ৪০। তিনি অস্ট্রেলিয়ার সিডনির রাজ্য নিউ সাউথ ওয়েলস রাজ্যের পার্শ্ববর্তী কুইন্সল্যান্ড রাজ্যের বাসিন্দা। জোল ‘ব্যাগপ্যাকার’ ভ্রমণকারী ছিলেন, অর্থাৎ তাঁর নির্দিষ্ট কোনো ঠিকানা নেই। তিনি একটি গাড়িতে বসবাস করতেন। এক মাস আগে তিনি সিডনিতে ঘোরাঘুরি শুরু করেন। তিনি বেকার এবং অবিবাহিত। পরিবার হিসেবে তাঁর মায়ের সঙ্গে গত মার্চ মাসে তিনি শেষবার কথা বলেছিলেন। বলা হচ্ছে, ১৭ বছর বয়স থেকে মানসিক সমস্যায় ভুগছিলেন জোল। হামলার এক ঘণ্টা আগেও ঘটনাস্থলের কাছে তিনি স্বাভাবিকভাবে মুরগির তরকারি আর ভাত দিয়ে দুপুরের খাবার খেয়েছিলেন। এর আগে তাঁর বিরুদ্ধে রাজ্য পুলিশের কাছে কোনো অপরাধের রেকর্ড নেই।
প্রত্যক্ষদর্শী বাংলাদেশির বক্তব্য
শপিং মলটির ভেতরের লবস্টার টেইল সি ফুড রেস্টুরেন্টের শেফ হিসেবে কাজ করেন প্রবাসী বাংলাদেশি সিডনির রকডেলের বাসিন্দা সুমন আহমেদ। শুধু শপিং মলটিতেই ৫০–এর অধিক বাংলাদেশি বিভিন্ন পেশায় কাজ করেন বলে জানিয়েছেন তিনি। পুলিশের ডাকে গিয়ে শপিং মলের বাইরে অবস্থানকালে মুঠোফোনে এই প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা হয় তাঁর। হামলার সময়ের ঘটনার বর্ণনায় তিনি বলেন, ‘আমাদের তো সি ফুডের রেস্টুরেন্ট। পুলিশ ভেতরের সব বন্ধ করে রেখেছে। তারা ফোন করে জানিয়েছে সামুদ্রিক মাছ পচে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। আমরা কেউ যেন এসে পুলিশ পাহারায় তা পরিষ্কার করে যাই, তাই এসেছি।...ওয়েস্টফিল্ড শপিং সেন্টার এমনিতেই একটি ব্যস্ত জায়গা। প্রচুর ভিড় হয় আর সাপ্তাহিক ছুটির দিন হওয়ায় সেদিন আরও বেশি ভিড় ছিল। আমি একটু বিরতিতে রেস্টুরেন্টের বাইরে এসে হাঁটাহাঁটি করছিলাম। এমনিই দেখি প্রচুর মানুষ ছোটাছুটি করছে। কয়েকজন এসে ভয়ে ক্রন্দনরত অবস্থায় বলছিল, ওদিক যেয়ো না, ও সবাইকে মেরে ফেলছে, ভাগো ভাগো। পরে আমিও দৌড়ে বাইরে চলে যাই আর এর মিনিট দশেক পর পুলিশ আসে।’
আক্রমণকারী মুসলিম নন, ঘটনাস্থল ইহুদি-অধ্যুষিত এলাকা
সিডনির বন্ডাইয়ের আক্রমণকারী জোল মুলসিম নন, এমনকি তিনি নিয়মিত কোনো ধর্ম পালন করতেন কি না, তা–ও নিশ্চিত নয়। কিন্তু তাঁর ৭০ বছরের বেশি বয়সী বাবা-মা খুবই ধার্মিক বলে জানিয়েছেন তাঁদের প্রতিবেশী। এদিকে বন্ডাই একটি ইহুদি-অধ্যুষিত এলাকা। হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে ইহুদিও রয়েছেন। তাই জোলের হত্যাকাণ্ডের পেছনে ইহুদি-বিদ্বেষ থাকতে পারে বলে একটি সম্ভাব্য প্ররোচনার কথা বলেছেন দেশটির ইহুদি সংঘের প্রধান ডেভিড অ্যাডলার। টেলিভিশন সংবাদের এক আলোচনায় তিনি বলেন, ‘আমরা ইহুদিরা এখন সারা বিশ্বেই হামলার শিকারের আতঙ্কে আছি। এর মধ্যে আমরা এটা ভেবে শান্তি পেতে চাই যে এই ঘটনার পেছনে কোনো ইহুদি-বিদ্বেষ প্ররোচনা নেই। তবে শপিং মলটি একটি বিখ্যাত ইহুদি পরিবারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট এবং যারা ইসরায়েল সমর্থন করে।’
সার্বিক পরিস্থিতি
ওয়েস্টফিল্ড বন্ডাই জংশন শপিং সেন্টার এলাকা এখন শোক আর আতঙ্কের ছায়ায় ছেয়ে রয়েছে। বন্ডাই দেশি-বিদেশি ভ্রমণকারীদের জন্য একটি জনপ্রিয় গন্তব্যস্থল। আর শপিং সেন্টারটিতে তিন হাজারের বেশি গাড়ি পার্কিং করার স্থান রয়েছে। এত বিশাল একটি শপিং মলসহ আশপাশের আর অনেক দোকানপাট কড়া পুলিশি পাহারায় বন্ধ রাখা হয়েছে। এর মধ্যে জোল কাওচির পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করেছে কুইন্সল্যান্ড রাজ্য পুলিশ। তাঁরা পুলিশকে সার্বিক সহযোগিতা করবেন বলে জানিয়ে একটি লিখিত বিবৃতি দিয়েছেন। সেখানে তাঁরা বলেছেন, ‘সিডনির যে মর্মান্তিক ঘটনা ঘটেছে তাতে আমরা একেবারেই ভেঙে পড়েছি। সবার ভুক্তভোগী এবং তাঁদের পরিবারের জন্য আমাদের প্রার্থনা জারি রয়েছে। জোলের কাজগুলো সত্যিই ভয়ংকর ছিল।
ফুলে ফুলে নীরবতা আর শোক প্রকাশ
সরেজমিনে বন্ডাই দেখা যায় অসংখ্য মানুষ নীরবে দাঁড়িয়ে আছেন ওয়েস্টফিল্ড বন্ডাই জংশন শপিং সেন্টারের সামনে। পুলিশ তখনো জনসাধারণের জন্য চলাচল নিষিদ্ধ করে রেখেছিল শপিং মলসহ আশপাশের দোকানপাট। মানুষ অনেক দূর থেকে পায়ে হেঁটে এসে শপিং মলের উল্টো পাশে ফুল দিয়ে শোক প্রকাশ করছেন। আবার নিহত ব্যক্তির পরিবার ও আহত ব্যক্তিদের জন্য সান্ত্বনা বার্তা লেখার জন্যও ছিল জায়গা। মোম জ্বালিয়ে কেউ কেউ প্রকাশ করছেন নীরব দুঃখ। সেখানে আবার সরকারি মানসিক স্বাস্থ্য সংস্থার কর্মীরাও উপস্থিত আছেন। তাঁদের উপস্থিতির কারণ জানতে চাইলে বলেন, ‘অনেকেই শোক প্রকাশ করতে এসে মানসিকভাবে ভেঙে পড়ছেন, তাঁদের সহযোগিতা করার জন্যই আমরা আছি।’ চারদিকে অস্ট্রেলিয়ার প্রায় সব গণমাধ্যমের সংবাদকর্মীরা অবস্থান করছিলেন নতুন কোনো তথ্য পরিবেশনের জন্য।
এদিকে গতকাল দেশটির প্রধানমন্ত্রী অ্যান্থনি আলবানিজ ও রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী ক্রিস মিনস ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন। এ সময় তাঁরা শোক প্রকাশ করেন। এই হামলার শোক প্রকাশ করে আজ অস্ট্রেলিয়ার জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত রাখা হয়েছে।
দূর পরবাসে ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল অ্যাড্রেস [email protected]