‘সাহিত্যের কবীর সুমন’ নিয়ে পাঠশালার আসর
টরন্টোভিত্তিক শিল্প-সাহিত্য চর্চার প্ল্যাটফর্ম ‘পাঠশালা’র ৪৬তম ভার্চ্যুয়াল আসরটি ৪ মে অনুষ্ঠিত হয়। এ আসরে ‘সাহিত্যের কবীর সুমন’ নিয়ে আলোচনা করেন শিক্ষক-লেখক-আলোকচিত্রী প্রবুদ্ধ ভট্টাচার্য।
কবীর সুমন। গান-কারিগর, গানের শিল্পী। মিউজিশিয়ান, সং রাইটার, গায়ক। গত শতকের নয়ের দশকের শুরুতে গানের কথা-সুর-উপস্থাপনার মধ্য দিয়ে আধুনিক বাংলা গানে প্যারাডাইম শিফট ঘটিয়ে দিয়েছিলেন। এ পর্যন্ত হাজার তিনেকের বেশি আধুনিক বাংলা গান লিখেছেন-বেঁধেছেন-গেয়েছেন। গত ১৫ বছরেরও বেশি সময় ধরে ধ্যানমগ্নভাবে বাংলা খেয়ালের চর্চা করছেন, দেড় হাজারের মতো খেয়াল বন্দিশ লিখেছেন, গাইছেন, শেখাচ্ছেন। এখনো গান বেঁধে চলছেন। এই কবীর সুমনকে আমরা কিছুটা জানি।
গত শতকের সাতের দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে আটের দশকের শেষ পর্যন্ত ভয়েস অব জার্মানি ও ভয়েস অব আমেরিকায় বেতার সাংবাদিকতার সময়ে অনুবাদ, পাঠ ও লেখালেখির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন কবীর। সাতের দশকের মাঝামাঝি সময় থেকেই ‘দেশ’ পত্রিকায় লেখা শুরু। তারপর একে একে দেশ, ফ্রন্টিয়ার, আজকাল, আনন্দবাজার, সংবাদ প্রতিদিনের মতো বিভিন্ন স্বনামধন্য পত্রিকায় কলাম, প্রবন্ধ, নিবন্ধ লিখেছেন। কাগজের নির্বাচিত লেখা নিয়ে প্রকাশিত হয়েছে কয়েকটি সংকলন। আটের দশকের মাঝামাঝি নিকারাগুয়ায় নিজে থেকে এসে বিপ্লবোত্তর নিকারাগুয়া নিয়ে বই লিখেছেন। ভয়েস অব আমেরিকায় কর্মকালীন আমেরিকার প্রতিষ্ঠানবিরোধী শিল্পী-অ্যাকটিভিস্ট-লেখকদের নিয়ে সাক্ষাৎকারভিত্তিক বই লিখেছেন। লিখেছেন মুক্তগদ্য, গল্প, উপন্যাস, কবিতাও।
কবীর সুমনের প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা ২৫ টির বেশি (লিরিকের বইসহ)। বইগুলো হচ্ছে ‘হয়ে ওঠা গান’ (১৯৯৪), কোন পথে গেল গান’ (২০০৬), ‘দূরের জানলা’ (২০০০), ডিসকভারিং দ্য আদার আমেরিকা’ (২০১২), ‘মনমেজাজ’ (২০১৩), ‘সুমনের গান সুমনের ভাষ্য, সুমনামি’ (২০১৬), ‘আলখাল্লা’ (১৯৯৭), ‘মুক্ত নিকারাগুয়া’ (১৯৮৭), ‘রীতিমতো নভেল’ (২০০৩), ‘৫২’ (২০০৫), ‘নিশানের নাম তাপসী মালিক’ (২০১০), ‘মরূদ্যানে নন্দীগ্রাম’ (২০০৮), ‘সুমনের গান’ (১০ খণ্ড), ‘বাংলা খেয়াল’ (২০১৮), ‘বাংলা খেয়াল বন্দিশ ও স্বরলিপি’ (২ খণ্ড) (২০২২) ও ‘কবীরের বাংলা খেয়াল: বন্দিশ ও স্বরলিপি’ (২০২৩)। কবীর সুমনের সাক্ষাৎকার নিয়ে প্রকাশিত হয়েছে—‘গানের প্রতিবাদ প্রতিবাদের গান’ (২০২০), ‘সুমনে সুমনে’ (২০১৮) ‘ও কবীরা’ (২০২০)। বেশ কয়েকটি সম্পাদিত বইয়ে ও সংকলনে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে তাঁর সঙ্গীতসম্পর্কিত নানাসময়ের লেখা। বিভিন্ন ম্যাগাজিনে ও কাগজে এখনও লিখে চলেছেন বিষয়ভিত্তিক লেখা।
২৩ এপ্রিল ছিল কবীর সুমনের ‘তোমাকে চাই’–এর ৩২ বছর পূর্তি। মাসখানেক আগেই গেল কবীরের জন্মদিন, ৭৫ পেরিয়ে ৭৬-এ পড়লেন তিনি। এইরকম এক উৎসবমুখর সময়ে, আমাদের খুব কম-জানা এক কবীর সুমনকে নিয়ে ‘সাহিত্যের কবীর সুমন’ শিরোনামে আয়োজিত পাঠশালার এই আসরে আলোচক প্রবুদ্ধ ভট্টাচার্য কবীর সুমনের সাহিত্যকর্মের-গদ্যের-লেখালেখির নানা দিক তুলে ধরেন।
কবীর সুমনের আত্মজীবনীমূলক বই ‘হয়ে ওঠা গান’ পড়তে পড়তে বারবার অবন ঠাকুরের ‘আপনকথা’ বইটির কথা মনে আসে। আবছা অব্যক্ত আলোছায়ার জগৎ, বিভিন্ন দৃশ্যরূপ মনের মধ্যে ভেসে ওঠা—এসব নিয়ে যে শৈশব অতিবাহিত হয় তার প্রকাশ ঘটে এক আশ্চর্য ভাষায়, যে ভাষা সংগীতময়, বিভিন্ন মাত্রায় লয় তাল ছন্দে বাঁধা। ‘হয়ে ওঠা গানে’র প্রথম অংশটি মূলত এ আলোছায়ায় ঘেরা অব্যক্ত এক জগৎ। বইটির এক জায়গায় কবীর সুমন লিখছেন, মৃণাল চক্রবর্তীর গাওয়া ‘যমুনা কিনারে শাজাহানের স্বপ্ন শতদল’ গানটায় কেমন একটা সকাল-সকাল ভাব ছিল।
কবীর সুমনের বাবা সুধীন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়, মা উমা চট্টোপাধ্যায়, দাদা আনন্দরূপ চট্টোপাধ্যায়—তাঁদের সাহচর্যে এক সাংগীতিক আবহে, সংগীতচর্চায়, গান শোনা ও শেখার মধ্য দিয়ে কবীরের হয়ে ওঠার সূচনা। তারপর এক আশ্চর্য সংবেদনশীল মন ও মনন এগিয়ে চলে বহুদূর!
কবীর সুমনের চিন্তাভাবনা ও লেখার বৈশিষ্ট্য (সংগীতের কথাই হোক বা গদ্যের প্রকাশে) হলো, নিজের কথা তাঁর কাছে কখনো একার কথা হয়ে ওঠে না। এমনকি তাঁর প্রেমের গানেও প্রকাশিত হয় একটা সমাজ, দেশ ও সময়ের কথা। নেহাতই ব্যক্তিগত অবস্থান থেকে তিনি লেখেন না, রচনা করেন না কোনোও কিছু। তাঁর নিজের অবস্থানে এসে পড়ে আরও অনেকের উল্লেখ। ‘হয়ে ওঠা গানে’ উল্লেখ রয়েছে জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ, পঙ্কজ কুমার মল্লিক, সুধীরলাল চক্রবর্তী, নিখিল চন্দ্র সেন, দিলীপ সরকার, ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য, হিমাংশু দত্ত, অনুপম ঘটক, রবিশঙ্কর, নির্মলা মিশ্র, সতীনাথ মুখোপাধ্যায়, উৎপলা সেন, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়, সুধীন দাশগুপ্ত, নচিকেতা ঘোষ, জটিলেশ্বর মুখোপাধ্যায়, পরেশ ধর, শচীন দেববর্মন, পান্নালাল ভট্টাচার্য, পান্নালাল ঘোষ, অলোকনাথ দে এবং আরও অনেকের কথাই। এঁদের সবার অবদানে, সুরবৈচিত্র্যের স্বকীয়তায়, আধুনিক বাংলা গানের জগৎ ও তার ঐতিহ্য রূপময় ও সম্বৃদ্ধ হয়ে উঠেছে। এক ঐশ্বর্যময় সংগীতের জগত—যার পরম সান্নিধ্যে ও আশ্রয়ে কেটে গেল কবীরের শৈশব ও যৌবন।
কবীর বিদেশে গিয়ে দীর্ঘদিন করলেন বেতার সাংবাদিকতা, বিভিন্ন বিষয়ে লেখালেখিতে মগ্ন থাকলেন, কিন্তু সংগীতসৃষ্টির প্রবাহ অবিচ্ছিন্ন রইল। নিজের কথায় নিজের সুর বসিয়ে সৃষ্টি করলেন এক নতুন ধারার বাংলা আধুনিক গান, যেখানে বিদেশের সংগীতের অভিজ্ঞতা, আধুনিক সময়ের কথা এক সেতু রচনা করল বাংলা গানের ধারাবাহিকতা ও ঐতিহ্যের সঙ্গে। নিজের গানের দল ‘নাগরিক’ সংগঠিত হলো। কয়েক বছর পর তিনি উপলব্ধি করলেন, তাঁর দলের অন্যান্য গায়কেরা তাঁর লেখা গান গাইলেও গানের আঙ্গিক ঠিক থাকছে না, একটা নিষ্ঠা ও আন্তরিকতার কোথাও ঘাটতি দেখা দিচ্ছে। সেই সময় তিনি স্থির সংকল্প নিলেন—তাঁর গান তাঁকেই গাইতে হবে। যার পরিণতি পূর্ণ রূপ পেল ‘তোমাকে চাই’য়ে।
এরপর আসে ‘কোন পথে গেল গান’ বইটির প্রসঙ্গ। ‘হয়ে ওঠা গান’ এবং ‘কোন পথে গেল গান’ একটি আরেকটির সম্পূরক গ্রন্থ। যেমন উইলিয়াম ব্লেকের ‘সংস অব ইনোসেন্স’ এবং ‘সংস অব এক্সপেরিয়েন্স’-এ ইনোসেন্স ও এক্সপেরিয়েন্স একে অপরের ওপর নির্ভরশীল। ‘কোন পথে গেল গান’ বইটিতে আছে আরও বিস্তীর্ণ অভিজ্ঞতাময়, বাংলা গানের পথ চলার ইতিহাস। সে কারণে বইটির গদ্য কিছুটা জটিল। বাংলা গানের ইতিহাস ও পরিণতির এক সমাজতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ বইটির ছত্রে ছত্রে।
২০০০ বছর আগে নিকারাগুয়ায় ইন্ডিয়ানদের বসতি স্থাপন থেকে স্প্যানিশ উপনিবেশ, মার্কিনি প্রবেশ, মার্কিন মদতপুষ্ট স্বৈরাচারী সোমোসাশাহী ও ১৯৭৯ সালে সশস্ত্র জুলাই বিপ্লবের মাধ্যমে সান্দিনিস্তা জাতীয় মুক্তিফ্রন্ট শাসনক্ষমতা দখল করে। ১৯ জুলাই সান্দিনিস্তা ফ্রন্টের নেতৃত্বে বিপ্লবীরা সার বেঁধে ঢুকলেন মানাগুয়ায়।
গোটা ট্রাভেলগে কবীর বিপ্লবী নিকারাগুয়া সরকারের সংস্কৃতি, শিল্প, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যব্যবস্থার পুনর্গঠন প্রকল্পগুলির অনুপুঙ্খ বর্ণনা দিয়েছেন। আমরা জানতে পারি অসামান্য স্বাক্ষরতা অভিযান, বিপ্লবের অন্যতম ফসল সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় ও অভিনব-অনন্য ‘বাংকো দে লেচে দে লাস মাদ্রেস’ বা ‘মায়ের দুধের ভাঁড়ারের’ কথা। বিপ্লব থেকে উঠে আসা নিকারাগুয়ার ‘নিউ সং’য়ের ওপরও বিশেষ আলোকপাত করেন কবীর।
কবীর সুমনের একটি উল্লেখযোগ্য কাজ ‘ডিসকভারিং দ্য আদার আমেরিকা।’ ভয়েস অব আমেরিকায় বেতার সাংবাদিকতা করার সময়কালেই তিনি আমেরিকার র্যাডিক্যাল ভাবধারার উল্লেখযোগ্য ১৪ জন চিন্তকের সাক্ষাৎকার নিয়ে এই বইটি লেখেন। যাঁদের সাক্ষাৎকার নেন তাঁরা হলেন—ভাষাবিজ্ঞানী নোম চমস্কি, গানের কারিগর ও গায়ক পিট সিগার, নাগরিক অধিকার সংগ্রামী ও লেখিকা মায়া এঞ্জেলু, কবি-নাট্যকার-নাগরিক অধিকার সংগ্রামী লিরয় জোন্স বা আমিরি বরাকা, নোবেল বিজয়ী বিজ্ঞানী জর্জ ওয়াল্ড, অর্থনীতিবিদ পল সুইজি, শিক্ষাবিদ এনেট রুবিনস্টাইন, লেখক হ্যারি ম্যাকডফ, র্যাডিকেল নাট্যকর্মী ম্যাক্সিন ক্লাইন, মার্কসবাদী অধ্যাপক ও লেখক বারটেল ওলম্যান, শিক্ষক মার্গারেট র্যানডাল, নারী অধিকার সংগ্রামী ও লেখিকা বারবারা এয়রেনরাইখ, সমাজসচেতন গায়িকা হলি নিয়ার ও ভাবুক-লেখক ম্যানিং মারাবেল।
কবীর সুমন ‘রীতিমতো নভেল’ ও ‘৫২’ নামে দুটি উপন্যাস লেখেন।
১১ সেপ্টেম্বর, ২০০১। আমেরিকার টুইন টাওয়ারে বিমান আক্রমণ। মাত্র কয়েক মুহূর্তের ঘটনা। তাতেই থমকে গিয়েছিল আমেরিকা ৷ আর তার প্রভাব ছড়িয়ে পড়েছিল সমস্ত পৃথিবীজুড়ে, এমনকি কলকাতা শহরেও। নগরজীবনের প্রাত্যহিকতায় মোড়া কিছু কিছু মানুষের জীবনেও ঘটেছিল নানা রদবদল। এসব নিয়েই রাজনৈতিক স্যাটায়ারধর্মী নভেলা ‘রীতিমতো নভেল।’ এতে চলে সমান্তরাল তিনটি গল্প। ৪৫ বছর বয়সী পলাশকাফি, স্বপন হালদার নাম পাল্টে আলি আকবর খানের তৈরি পলাশকাফি রাগের নামে নিজের নতুন নামকরণ করেন। তিনি টিভি সেটের সামনে সেসময়। তার ঘরের একটা টিকটিকির সাথে পলাশকাফির কথোপকথন শুরু হয়। যমজ মিনার আক্রমণের খবর প্রচারের সময় কোন সাউন্ড ইফেক্ট না-থাকায় টিকটিকির অনুরোধে তিনি টেলিভিশনের শব্দ বন্ধ করে সরোদে ‘পলাশকাফি’ বাজিয়ে সাউন্ড ইফেক্ট দেন। ৫৮ বছর বয়সী শৈলেন রায়, আমেরিকান সরকারের পররাষ্ট্রনীতি সমর্থনযোগ্য মনে করতেন না। তিনিও টিভির সামনে। তাঁর স্ত্রী বিনীতা (৫৫) সমাজসেবী। বিনীতা তখন দক্ষিণ কলকাতার অফিস টলি ক্লাবে মিটিং-এ অফিসের সহকর্মীদের সঙ্গে। এই তিন জায়গায় বিভিন্ন বাঁকে ঘটে চলে নানা ঘটনা।
কবীর সুমন সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম নিয়ে গান বেঁধেছেন, গান গেয়েছেন, পথে নেমেছেন, পথে নামিয়েছেন অন্যদের, কলমও ধরেছেন নানান সংবাদমাধ্যমে। ২০০৭ সালের পূর্বাভাস, একদিন, একপক্ষ কাগজের সেইসব লেখার মধ্যে কয়েকটি লেখা নিয়ে সংকলন ‘মরুদ্যানে নন্দীগ্রাম ২০০৭।’
দুর্দান্ত বৈঠকী মেজাজে মূলত সংগীতবিষয়ে আনন্দবাজার পত্রিকায় লেখা কলামের সংকলন ‘সুমনামি।’ কবীর সুমনের গানবাজনা শোনা ও মনে রাখা থেকেই সুমনামি। তবে এগুলো নিছক স্মৃতিচারণা না। স্মৃতিকে একটা পরিপ্রেক্ষিতে আনার চেষ্টা। এর সঙ্গে রয়েছে বিশ্লেষণ, মন্তব্য ইত্যাদি। ব্রেশট্ থেকে সুধীরলাল পর্যন্ত অসংখ্য চরিত্র এসেছে এখানে অদ্ভুত নির্ভার গদ্যের মধ্য দিয়ে।
‘আলখাল্লা’য় লেখক কবীর সুমন বলছেন, ‘অভিজ্ঞতাগুলো, স্মৃতিগুলো ছেঁড়া কাপড়ের মতো। হরেকরকম রং। কাপড়ও নানা রকমের। টুকরোগুলো জুড়তে জুড়তে, জুড়তে জুড়তে …।’ ছোটবেলায় তাঁর বাবা কবীরকে বলতেন, ‘গানটাকে পেশা করিস না, লোকে সম্মান করবে না। এক রোববার সকালে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় এলেন তাঁদের বাসায়। বাবার অনুরোধে হেমন্ত রবীন্দ্রনাথের একটি গান শোনালেন। কবীরের জ্যাঠতুতো দাদা ও বৌদি সেখানে উপস্থিত। তাঁদের ছেলেটি তখন নেহাতই শিশু। কবীরের বাবা সুধীন্দ্রনাথ তাকে জিজ্ঞেস করলেন—কিরে, এই লোকটাকে চিনিস? ছোট্ট ছেলেটি মাথা দুলিয়ে বলল—হ্যাঁ হেমন্ত। কবীরের বাবা গম্ভীর মুখে রসিকতা করে বললেন, দেখেছ হেমন্ত, এ জন্যেই গানের লাইনে থাকিনি। নাতিরাও নাম ধরে ডাকে।’
‘১৯৮৮ সাল। কোলোনের রাস্তা ধরে হাঁটছি। গরমকাল। একটা দোকানের বাইরে ছোট্ট একটি মেয়ে বসে আছে। জার্মান মেয়ে। বয়স বড়জোর চার-পাঁচ। ফিক করে হেসে আমায় কাছে ডাকল। … হাসিমুখে জিজ্ঞেস করল—
তুমি বুঝি তুরস্কের লোক?
–না, কলকাতার।
তোমার ভাষায় কিছু বলো আমাকে।
আমি তোমায় ভালোবাসি।
মানে কী?
জার্মান ভাষায় অনুবাদ করে দিলাম। মেয়েটি হাসিতে, আনন্দে উচ্ছ্বল হয়ে বললো—তোমাদের ভাষা কী সুন্দর!
তার গালে একটা চুমু খেয়ে আমার প্রস্থান।
I met a young girl
She gave me a rainbow.
নানা বৈচিত্র্যের, বর্ণের, ভালো লাগা ও খারাপ লাগার বিচিত্র অনুভূতি ‘আলখাল্লা’র পাতায় পাতায়। এই বইটিতে আরও আছে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় ও রবিশঙ্করের দুটি সাক্ষাৎকার, রবীন্দ্রনাথের উদ্দেশে লেখা একটি খোলা চিঠি, নিজেকে যে পাল্টায়, যেখানে ভোলফ বিয়ারম্যানের জীবনের নানা পরিবর্তনের আভাস, পিট সিগারের একটি সাক্ষাৎকার এবং ‘কহেন কবি কোহেন’—সং রাইটার লেনার্ড কোহেনকে নিয়ে একটি অসামান্য নিবন্ধ।
এরপর আসা যায় ‘দূরের জানলা’ বইটিতে। বিদেশে কর্মরত অবস্থায় বিস্তৃত পাঠ, পাশ্চাত্যের ছাত্ররাজনীতি, ড্রাগসেবন, ফ্যাসিবাদ ইত্যাদি বিভিন্ন অবস্থার এক বিচিত্র অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে গিয়েছিলেন কবীর। তাঁর সাহিত্যপাঠ ও মননের বিস্তীর্ণ ক্ষেত্রই এই বইটির বিষয়। ‘দেশ’ পত্রিকায় এই প্রবন্ধগুলি প্রথমদিকে সুমন চট্টোপাধ্যায় ও পরে মানব মিত্র নামে ছাপা হয়। কাহিনিকার হাইনরিখ ব্যোল, ছাত্র আন্দোলনের দশক ও রুডি ডুচকে, নাইনটিন এইটিফোর, গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস, এ্যাটেনবরোর গান্ধী, জর্জ স্টাইনার, বারবারার চোখে রবীন্দ্রনাথ—ইত্যাদি প্রবন্ধ এই বইকে সমৃদ্ধ করেছে।
‘বারবারার চোখে রবীন্দ্রনাথ’ সাক্ষাৎকারভিত্তিক এ আলোচনাটি যেমন মর্মস্পর্শী, তেমন মুগ্ধকারী। বারবারা নামে কোলোনের এক অল্পবয়সী মেয়ে তার বাবার লাইব্রেরি ঘাঁটতে ঘাঁটতে আবিষ্কার করে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা একটি ছোট্ট বই। সেই বইটি পড়তে পড়তে সে এতটাই বিভোর হয়ে যায় যে সে বইটিকে হাতছাড়া করে না কখনো। রবীন্দ্রনাথ তার সারা জীবনের সঙ্গী হয়ে ওঠেন। পরবর্তী সময়ে বড় হয়ে তিনি ফটোগ্রাফি নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন। সেখানে ফটোগ্রাফির প্রজেক্টে বিষয় হিসেবে তিনি রবীন্দ্রনাথের গভীর চিন্তাভাবনাকে বেছে নেন।
কবীর সুমনের আর একটি বৈচিত্র্যময়, ঐশ্বর্যময় বই হলো ‘মনমেজাজ’, যার ছোটো ছোটো নিবন্ধগুলো ‘আজকাল’ পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়েছিল। অসম্ভব সংগীতময়, কখনো কখনো কাব্যিক ও বিচিত্র তার ভাষা, যা ছবিময় হয়ে ওঠে এক দৃশ্য থেকে আরেক দৃশ্যে, এক প্রান্ত থেকে বাস্তবতার আরেক প্রান্তে বিচরণ করে। যেমন ‘দুঃখ লেখে তার নাম’-এ কবীর লিখছেন—‘নীল দিগন্তে ঐ ফুলের আগুন লাগল’ গানটিতে বসন্তের কোনো এক সকাল-দুপুরে তাঁর মৌসুমি প্রফুল্লতার রঙরস গানের দেহে লাগিয়ে দিতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথের কী দরকার ছিল সঞ্চারিতে হঠাৎ লেখার—‘নীল দিগন্তে মোর বেদনখানি লাগল, অনেক কালের মনের কথা জাগল?’ কাব্যি করা দুঃখবিলাস? রঙের বর্ণালিতে একফোঁটা বেদনা লাগিয়ে দিয়ে বৈচিত্র্য আনতে চাওয়া, পাছে গানের ভাবনাটা একপেশে, একমুখী হয়ে পড়ে? প্রথম থেকেই তার সপ্তক, মানে চড়ার দিকে সুর করে, অন্তরাতে সেই দিকটাকেই প্রাধান্য দিয়ে সঞ্চারিতে তিনি যে নিচের দিকে নেমে এলেন, এক শান্ত বিষণ্ণতার ছোঁয়া রেখে দিলেন আলগোছে, সেটা কি শুধুই বাংলা গানের সঞ্চারির সুর নিচের দিকে করার রীতি আছে তাই? … শহিদ কাদরীর একটি কবিতায় আছে ‘ফুটবল ম্যাচের মাঠে/উঁচু ডায়াসে রাখা/মধ্যদুপুরের নিঃসঙ্গ মাইক্রোফোন’-এর ছবি। দুঃখী মনে হয় মাইক্রোফোনটিকে। দেখা, শোনা, গন্ধ পাওয়া, অনুভব করার সূক্ষ্ম ক্ষমতা যার নেই, সেই ভাগ্যবান মানুষটি হয়তো বলবেন—এর মধ্যে দুঃখ পাচ্ছ কোথায় বাপু? ঠিক যেমন রবীন্দ্রনাথের ঐ বাসন্তী গানে ‘এলো আমার হারিয়ে যাওয়া কোন ফাগুনের পাগল হাওয়া’ শুনে পরম সুখকর প্রাপ্তির কোনো মুহূর্তেও কেউ শিউরে উঠতে পারেন ভুলে যাওয়া, হারিয়ে যাওয়া কোনো স্মৃতির হঠাৎ-হাজিরায়, তেমনি কেউ হয়তো থাকতে পারেন সম্পূর্ণ আবেগহীন। বেঁচে থাকার পথে মাটি কাঁকর নুড়ি পাথরের মতো ছড়ানো থাকে সুখের পাশেই দুঃখ, হর্ষের গা ঘেঁষে বিষাদ। এই যেমন পুজোর মুখেই চন্দনদস্যু বীরাপ্পন নিহত হলেন। তাঁর নিথর মুখের ছবিটি পত্রিকায় দেখতে দেখতে মনে পড়ছিল একসময়ে তিনি নাকি চন্দনগাছের চোরাকারবার চালানোর পাশাপাশি জঙ্গলে একা বসে বসে বাঁশি বাজাতেন। দস্যু-বাঁশরিয়ার ‘ডাকাতিয়া বাঁশি।’ তাঁর কপালের একপাশে বুলেটের কালো ক্ষত। ‘দস্যি ছেলে লক্ষ্ণী আজ।’
এই স্বল্প পরিসরে কবীর সুমনের সাহিত্যকৃতি নিয়ে আলোচনা কতটুকুই–বা সম্ভব। শুধু তাঁর গদ্যের ব্যাপকতা, সৃষ্টিশীলতা, বৈচিত্র্যের কিছু আভাস রাখার চেষ্টা করা হয়েছে পাঠশালার এই আসরে। যদি সবাই এই সজীব সাহিত্য ও গদ্যের কাছে আসেন, পড়েন ও চর্চা করেন তাহলেই এই উদ্যোগ কিছুটা সার্থকতা অর্জন করে। ভবিষ্যতে কবীর সুমনের এইসব লেখালেখি নিয়ে আরও বিস্তৃত আলোচনার অবকাশ আছে। সে আলোচনা আগামীতেও বহাল থাকবে, এই প্রত্যাশা।
কবীর সুমনের লেখালেখির জগৎ নিয়ে পাঠশালার এ আসরের সঞ্চালনা ও সূত্রধরের দায়িত্ব পালন করি আমি নিজেই।
*দূর পরবাসে ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]