জাতিস্মর জগতি রেলস্টেশন
ইতিহাস বলছে, আজ থেকে দেড় শ বছরেরও আগে স্থাপিত হয় কুষ্টিয়ার জগতি রেলস্টেশন। সেই সময় থেকে এখনো কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে লাল রঙের ভবনটি। স্টেশনটির সঙ্গে আমার পরিচয় হয় ১৯৯১ সালে। চরভবানীপুর প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে প্রাথমিক পাস করে এসে ভর্তি হলাম শহরতলির জগতি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে। তখনো জানতাম না জগতি নামটা উপমহাদেশের একটা অন্যতম পরিচিত; আর বাংলাদেশের সর্বপ্রথম রেলস্টেশনেরও নাম। আমাদের বিদ্যালয় ভবনটা ছিল ইংরেজি ‘এল’ অক্ষরের আকৃতির। আর এর পেটের মধ্যে ছিল ‘আই’ আকৃতির প্রাথমিক বিদ্যালয় ভবন।
রাস্তার পাশের অফিস ভবনটা ছাড়া আমাদের বিদ্যালয়ের বাকি সব কক্ষ ছিল সেমিপাকা ভবন। একটা অংশের ওপর ছিল টিনের ছাউনি, অন্য অংশটার ওপরে ছিল টিনের চৌচালা। একটু বৃষ্টি হলেই টিনের চালের ফুটো দিয়ে পানি পড়ে আমাদের বসার বেঞ্চ ভিজিয়ে দিত। তখন আমাদের সরে সরে বসতে হতো। আর বেশি বৃষ্টি হলে কক্ষের মধ্যে বন্যা বয়ে যেত। আমাদের মেঝে ছিল ইটের সোলিং করা, তাই পানি বেশিক্ষণ জমে থাকতে পারত না। বিদ্যালয়ের সামনের রাস্তার পাশেই রেললাইনের জায়গায় খাল।
আর খালের অপর পাড়েই রেললাইন। আমাদের তাই রেলগাড়ি দেখতে আর দূরে যেতে হতো না।
রেলগাড়িগুলো জগতি স্টেশনে এসে থামত। তারপর সেখান থেকে আরও মালামাল এবং মানুষ নিয়ে যাত্রা করত। যাত্রা শুরুর আগে স্টেশন ঘরের পাশে ঝোলানো রেলের পাতে সজোরে একটানা আঘাত করে জানিয়ে দেওয়া হতো কিছুক্ষণের মধ্যেই গাড়ি ছেড়ে যাবে। বিদ্যালয়ে বসেও আমরা এই ঘণ্টাধ্বনি শুনতে পেতাম। জগতি স্টেশনের অপর পাশেই ছিল রেলবাজার। সব সময় সরগরম থাকত বাজারটি। আশপাশের এলাকার মানুষেরা নির্দিষ্ট দিনে এখানে বাজার করতে আসত। আর ছিল জগতি হাট।
সেখানেই সপ্তাহের দুই দিন হাট বসত। তখন অনেক দূরদূরান্ত থেকে মানুষ আসত হাট করতে।
আমাদের বিদ্যালয়ের দেয়ালের পেছনেই রাস্তার ধারে ছিল জগতি ডাকঘর। সেখানেও ব্যস্ততা থাকত সারা দিন। বিভিন্ন জায়গা থেকে চিঠি সংগ্রহ করে সেগুলো কুষ্টিয়া সদরে নিয়ে যাওয়া আবার সদর থেকে বস্তাভর্তি চিঠি নিয়ে এসে বিলি করার তোড়জোড় চলত সারা দিন। অনেকেই সরাসরি ডাকঘরে এসে খোঁজ নিতেন তাঁদের কোনো চিঠি এসেছে কি না? আমাদেরও বেশ কয়বার যেতে হয়েছিল আব্বার চিঠি এসেছে কি না জানার জন্য। পোস্টমাস্টারের ছেলেমেয়েরা আমাদের সঙ্গেই আমাদের বিদ্যালয়ে পড়ত।
অনেক দিন পর বেড়াতে গেলাম জগতি স্টেশনে। আগে স্টেশনের কাছাকাছি এলেই লোকজনের গমগম আওয়াজ পাওয়া যেত। এখন স্টেশনে মানুষই খুঁজে পাওয়া দায়। স্টেশনের অপেক্ষাঘর ফাঁকা পড়ে আছে।
স্টেশনের ট্রেনের তালিকা বোর্ডে কবেকার পুরোনো ট্রেনের সময়সূচি। তার ওপর কেউ একজন দয়াপরবশ হয়ে ইংরেজিতে স্টেশনের নামটা লিখে রেখেছে। স্টেশনের ঘণ্টাটা এখন বড্ড নিঃসঙ্গ। স্টেশনের পানির ট্যাংকের ওপর বটের চারা জন্মেছে। সেটাকে আর পানির ট্যাংক বলে চেনার উপায় নেই। অনেকক্ষণ ধরে স্টেশনে হাঁটাহাঁটি করলাম, কিন্তু কোনো যাত্রী বা রেলগাড়ির দেখা পেলাম না।
এরপর গেলাম রেলবাজারে। সেখানেও মানুষের আনাগোনা খুবই কম। রেলবাজারের পাশেই ছিল ভিসিআরের দোকান। সেটা উঠে গেছে অনেক আগেই। এরপর গেলাম বিদ্যালয়ে। বিদ্যালয়ের পুকুরপাড়ে লাগানো বটগাছটা ধীরে ধীরে মহিরুহের আকার নিচ্ছে। বিদ্যালয়ের ভবন এখন পাকা হয়ে গেছে। রাস্তার পাশে নির্মাণ করা হয়েছে দেয়াল এবং নামসংবলিত সুদৃশ্য ফটক। আরও নির্মাণ করা হয়েছে শহীদ মিনার। ডাকঘরটাও এখনো আছে কিন্তু কোনো জনমানুষের দেখা পেলাম না। ডাকঘর পার হয়ে দয়াল বেকারি নামে একটা বেকারি ছিল, সেটাও আর নেই এখন। এরপর হেঁটে হেঁটে বাড়ির রাস্তা ধরলাম। চৌড়হাস মতি মিঞার রেলগেটে এসে দেখা পেলাম রেলগাড়ির।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বদলায় প্রকৃতি, বদলায় মানুষ, কিন্তু মানুষের নির্মিত স্থাপনাগুলো কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। এই স্থাপনাগুলোর গায়ে কতশত মানুষের সুখ–দুঃখের গল্প লেখা থাকে। জগতি রেলস্টেশনও এমনই এক জাতিস্মরের নাম। অস্ট্রেলিয়ায় দেখেছি, পুরোনো স্থাপনাগুলোকে ‘ঐতিহ্য’ ঘোষণা করে সেগুলো রক্ষণাবেক্ষণের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেওয়া হয়। যে স্টেশনগুলো পরিত্যক্ত হয়ে গেছে, সেগুলোকে জাদুঘরে রূপান্তর করা হয়। সেখানে প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ বেড়াতে আসে। হয়তোবা কান পেতে শোনে কালের গর্ভে হারিয়ে যাওয়া মানুষদের প্রতিধ্বনি।
জগতি স্টেশনের জৌলুশ ফিরিয়ে আনতে সরকার পদক্ষেপ নিলে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম হাতেকলমে জানতে পারত দেশের প্রথম রেলস্টেশনের ইতিহাস।