যুদ্ধ, গণতন্ত্র, স্বৈরশাসন নাকি রোবোটিকতন্ত্র, বিশ্ব এখন কোন পথে

গণতন্ত্র মঞ্চ

বর্তমান বিশ্ব যেন আবার এক বিস্ফোরণের প্রান্তে দাঁড়িয়ে। এটি আর শুধু সেনাবাহিনী বা অস্ত্রের সংঘাত নয়, বরং ধারণার ওপর ধারণা এবং শাসনের ওপর শাসনের এক অদৃশ্য যুদ্ধ। মানুষের স্বাধীনতা এখন এমন এক লড়াইয়ের মুখোমুখি, যার সূচনা হয় পর্দার আড়ালে, তথ্য প্রবাহের মধ্যে এবং প্রযুক্তির অদৃশ্য অ্যালগরিদমে। বিশ্বায়নের সুবিধা এবং সংযোগের শক্তি আজ এক ভয়ংকর অস্ত্রেও পরিণত হয়েছে, যেখানে অল্প কিছু শক্তিধর রাষ্ট্র এবং করপোরেট ক্ষমতাধরেরা চুপিসারে নিয়ন্ত্রণ স্থাপন করছে।

পৃথিবীর বড় বড় শহরগুলোতে উন্নতি এবং অগ্রগতির আলো জ্বলছে, কিন্তু সেই আলোই একই সঙ্গে দীর্ঘ ছায়া ফেলছে কোটি মানুষের জীবনে। প্রযুক্তির দৌড় মানবসভ্যতাকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে গেলেও একই সঙ্গে এটি গণতন্ত্রের ভিত নীরবে দুর্বল করে দিচ্ছে। সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার ক্রমেই সরে যাচ্ছে জনগণের হাত থেকে, চলে যাচ্ছে তথ্য, প্রযুক্তি এবং অর্থনীতির মুষ্টিমেয় মালিকদের কাছে। ফলে এক নতুন ধরনের অস্থিতিশীলতা তৈরি হচ্ছে, যেখানে রাষ্ট্র, সমাজ এবং ব্যক্তি তিন স্তরেই অনিশ্চয়তা বাড়ছে।

এই নতুন বাস্তবতায় সাধারণ মানুষ দাঁড়িয়ে আছে দ্বিধায়, ভয় এবং বিভ্রান্তিতে। কারণ, বিশ্ব যত দ্রুত বদলাচ্ছে, তত দ্রুত পিছিয়ে পড়ছে সেই আশি বা নব্বই ভাগ মানুষ, যারা এই প্রযুক্তিগত পরিবর্তনের সঙ্গে মানিয়ে ওঠার সুযোগ পাচ্ছে না। তাদের জ্ঞান সীমিত, প্রবেশাধিকার সীমিত এবং রাজনৈতিক অংশগ্রহণও দুর্বল হয়ে পড়ছে।
মানবসভ্যতার সামনে আজ তাই এক মৌলিক প্রশ্ন দাঁড়িয়ে। আমরা কি গণতন্ত্রকে বাঁচাতে পারব নাকি স্বৈরশাসনের নতুন সংস্করণ প্রযুক্তির হাত ধরে আবার ফিরে আসবে।

আমরা কি যুদ্ধের দিকে এগোচ্ছি নাকি মানবিক ভবিষ্যতের দিকে। নাকি আমরা অজান্তেই এমন এক রোবোটিকতন্ত্রের দিকে হাঁটছি, যেখানে মানুষ থাকবে কিন্তু সিদ্ধান্ত নেবে যন্ত্র এবং অ্যালগরিদম।

বিশ্বায়ন এবং অস্থিরতার রাজনীতি—

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বিশ্ব যখন গণতন্ত্র এবং মানবাধিকারের ওপর নতুন ভরসা খুঁজে পেয়েছিল, তখন আমরা ভাবিনি একদিন এই ব্যবস্থাকেই আবার ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেওয়া হবে। আজ বিশ্বের প্রায় নব্বই শতাংশ মানুষ কোনো না কোনোভাবে স্বৈরশাসনের প্রভাবে বসবাস করছে। Freedom House এর সর্বশেষ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত উনিশ বছর ধরে বিশ্বব্যাপী নাগরিক স্বাধীনতা এবং রাজনৈতিক অধিকারে ধারাবাহিক পতন ঘটছে। বেশির ভাগ দেশে এখন গণতন্ত্র কেবল নির্বাচনের আনুষ্ঠানিকতায় সীমাবদ্ধ। ক্ষমতাসীনেরা ভোটের আয়োজন করে নিজেদের বৈধতা দেখায়, কিন্তু শাসন চালায় কর্তৃত্বমূলক পদ্ধতিতে।

পুতিনের দাবি হচ্ছে, ইউক্রেনে যুদ্ধ ও আগ্রাসনের নামে রাশিয়া যে বিভীষিকা চালাচ্ছে, সেটি যেন দেখেও না দেখে পশ্চিমা বিশ্ব।
ছবি : রয়টার্স

আধুনিক স্বৈরাচারের প্রকৃতি

আধুনিক স্বৈরাচার আগের মতো আর সোজাসাপটা নয়। আজকের একনায়কেরা ট্যাংক বা বন্দুক দিয়ে নয়, তথ্য, প্রচার এবং ভয় দিয়ে শাসন করে। তারা জনগণের কণ্ঠ রোধ করে না প্রকাশ্যে, বরং জনগণকেই নিজেদের শাসনের অংশ করে তোলে মিথ্যা তথ্য, ধর্মীয় উত্তেজনা এবং জাতিগত বিভাজনের মাধ্যমে। এই নব্য স্বৈরাচার গণতন্ত্রের ভাষা ব্যবহার করে জনগণের ওপর আধিপত্য বিস্তার করে। এ কারণে আজকের সবচেয়ে বড় বিপদ হচ্ছে গণতান্ত্রিক স্বৈরাচার, যেখানে ভোট আছে কিন্তু স্বাধীনতা নেই এবং উন্নয়ন আছে কিন্তু ন্যায় নেই।

প্রযুক্তি মুক্তি নাকি বন্দিদশা  

এই সময়ের সবচেয়ে জটিল প্রশ্ন হলো প্রযুক্তি কি গণতন্ত্রকে বাঁচাবে নাকি দাফন করবে। একদিকে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, রোবট এবং তথ্যপ্রযুক্তি মানুষকে ক্ষমতাবান করছে, অন্যদিকে একই প্রযুক্তি রাষ্ট্র এবং করপোরেট শক্তির জন্য নজরদারি এবং নিয়ন্ত্রণের অস্ত্র হয়ে উঠছে।

রোবোটিকতন্ত্র বা অ্যালগরিদমিক শাসন

রোবোটিকতন্ত্র মানে কোনো দেশের সিদ্ধান্ত বা শাসন মানুষ দ্বারা নয় বরং অ্যালগরিদম বা কোডের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত হয়। এটি আধুনিক স্বৈরশাসনের নতুন রূপ, যেখানে প্রযুক্তি নাগরিকদের স্বাধীনতা সীমিত করতে পারে। এখানে স্বয়ংক্রিয় সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে মানবিক যাচাই সীমিত, ফলে নাগরিকদের অধিকার এবং ন্যায়বিচার ঝুঁকির মধ্যে পড়ে।
বিশ্ব এখনো প্রস্তুত নয়, কারণ বিশ্বের প্রায় ৯০ শতাংশ মানুষ রোবোটিক টেকনোলজি এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সম্পর্কিত জ্ঞানের বাইরে। তাই রোবোটিকতন্ত্র যদি অমোচিতভাবে ছড়িয়ে পড়ে, এটি হতে পারে নতুন বৈষম্য এবং স্বৈরশাসনের হাতিয়ার।

দূর পরবাস-এ জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]

ডিজিটাল বঞ্চনা এবং বৈষম্য

প্রযুক্তির যুগে সবচেয়ে বড় বৈষম্য তৈরি হয়েছে ডিজিটাল বঞ্চনা থেকে। বিশ্ব জনসংখ্যার প্রায় ৯০ শতাংশ মানুষ এখনো উচ্চমানের প্রযুক্তি ব্যবহার করতে পারে না। ফলে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এবং রোবোটিকসের উন্নয়ন যেমন একশ্রেণিকে শক্তিশালী করছে, অন্য শ্রেণিকে আরও দুর্বল এবং নির্ভরশীল করে তুলছে। এই বৈষম্য যদি রোধ না করা যায়, তবে প্রযুক্তি হবে নতুন শ্রেণিব্যবস্থার হাতিয়ার যেখানে জানতে পারাই হয়ে উঠবে নতুন প্রিভিলেজ।

কী করণীয় একটি নতুন রাজনৈতিক কল্পনায়

এখন সময় এসেছে গণতন্ত্রকে রক্ষা নয় বরং পুনর্গঠন করার। শুধু ভোট নয়, গণতন্ত্রের কেন্দ্রবিন্দু হতে হবে মানুষ এবং প্রযুক্তি হতে হবে তার সহায়ক শক্তি।
মানবকেন্দ্রিক ডিজিটাল গণতন্ত্র প্রযুক্তি যেন শাসনের হাতিয়ার না হয়ে অংশগ্রহণের মাধ্যম হয়।
অর্থ এবং ক্ষমতার স্বচ্ছতা করপোরেট লবিং, নির্বাচনী অর্থায়ন এবং তথ্য নিয়ন্ত্রণে আন্তর্জাতিক মানদণ্ড জরুরি।
নাগরিক ক্ষমতায়ন এবং শিক্ষা প্রযুক্তি, নীতি এবং অধিকার সম্পর্কে মানুষের জ্ঞান বাড়ানো ছাড়া গণতন্ত্র টেকসই নয়।  
মিডিয়ার স্বাধীনতা যে সমাজে সাংবাদিক ভিত, সেখানে জনগণের কণ্ঠও নীরব থাকে।
অর্থনৈতিক ন্যায় এবং সামাজিক নিরাপত্তা বৈষম্য হ্রাস না হলে গণতন্ত্রের ভিত দুর্বল থাকে।
আন্তর্জাতিক সংহতি এক দেশে গণতন্ত্র ক্ষয়ে গেলে অন্য দেশও প্রভাবিত হয়, তাই বিশ্বব্যাপী ঐক্য প্রয়োজন।

মানবতান্ত্রিক শাসন একটি নতুন দৃষ্টিভঙ্গি

সামনে হয়তো গণতন্ত্র বা স্বৈরশাসন এই দুটি শব্দই যথেষ্ট নয়। আমাদের দরকার এক নতুন দর্শন মানবতান্ত্রিক শাসন, যেখানে প্রযুক্তি, ন্যায়, নীতি এবং মানবিকতা একসঙ্গে থাকবে। এখানে রাষ্ট্র কেবল ক্ষমতার প্রতিষ্ঠান নয় বরং মানুষের মর্যাদা এবং বুদ্ধির বিকাশের জায়গা।

শেষকথা

যুদ্ধের ছায়া কেবল সীমান্তে নয়, আমাদের রাষ্ট্রব্যবস্থাতেও নেমে এসেছে। আজ আমরা এমন এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছি যেখানে প্রশ্নটি আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি প্রাসঙ্গিক। আমরা কি গণতন্ত্রে বাঁচতে চাই নাকি প্রযুক্তি এবং পুঁজির দাসত্বে।
বিশ্বের ধনী দেশগুলো, ক্ষমতাধারী ব্যক্তি এবং করপোরেট নেতৃত্বের উদ্দেশ্যে একটি স্পষ্ট বার্তা।

যদি কাগজে–কলমে হলেও আমরা গণতন্ত্রে বিশ্বাসী হয়ে থাকি, তাহলে ইলন মাস্কের মতো একজনের ভোটের মতো আমারও একটি ভোট। এখন ভাবুন, যদি দরিদ্র মানুষের সংখ্যা বাড়তেই থাকে এবং কোটি কোটি ডলার বিনিয়োগ সত্ত্বেও মানুষের কণ্ঠ রোধ করা না যায়, তাহলে অর্থ দিয়ে ক্ষমতা ধরে রাখার চেষ্টার ফল কী হবে।
এখন বিশ্বের কাছে আমার প্রশ্ন। আপনি চাইছেন যুদ্ধ নাকি শান্তি।