মন্টজুইক ক্যাসল–বার্সেলোনার আকাশে ঝুলে থাকা নীরব ইতিহাস
১২ নভেম্বর ২০২৫। জার্মানির স্টুটগার্ট শহরে তখন ভোরের কোমল আলো। ঘুম ভাঙতেই মনে অদ্ভুত এক উচ্ছ্বাস—আজ যাচ্ছি স্পেন, যেখানে ইতিহাস, শিল্প, সংগীত ও রঙের এক বিস্ময়ভূমি। স্টুটগার্টে বসবাসরত মেয়ে ও জামাতা ঢাকায় আমাদের ভিসা পাওয়া মাত্রই প্যারিস, বার্সেলোনা, গ্রানাডাসহ ইউরোপের বিভিন্ন শহরের ট্যুর, টিকিট, থাকা–খাওয়ার সব আয়োজন করে রেখেছিল। আমরা স্টুটগার্টে আসার পর থেকেই তাদের পরিকল্পনা অনুযায়ী জার্মানি, সুইজারল্যান্ড, অস্ট্রিয়া, প্যারিস ও মিউনিখ ভ্রমণ শেষে এবার পালা সেই বহুল প্রতীক্ষিত স্পেন ভ্রমণের।
আমাদের চার মাসের নাতনি রূপকথাকে নিয়ে ভ্রমণ ছিল এক রকম বিস্ময়। আমাদের কোলের মধ্যে ওর ছোট্ট হাসি, বিমানে, গাড়িতে, পাতাল রেল, ট্রাম ও বাসে স্ট্রলারে ঘুমিয়ে থাকা শান্ত মুখ, আর নতুন শহরের আলো দেখে বিস্ফোরিত চোখ—সব মিলিয়ে আমাদের যাত্রা যেন আরও মায়াময় হয়ে উঠেছিল। মনে হয়েছিল, রূপকথাকে সঙ্গে নিয়ে পৃথিবীকে যেন প্রথমবার আবার দেখছি। বিমানবন্দরে শিশুদের প্রতি যে যত্ন ও সহানুভূতি দেখলাম, তা সত্যিই অবাক করে। রূপকথার জন্য আলাদা স্ট্রলার পর্যন্ত দেওয়া হলো বিমানের সিঁড়ি পর্যন্ত। রাত ৮টা ৪৫ মিনিটে এয়ারবাস আকাশে উড়ল এবং ১ ঘণ্টা ৪৫ মিনিট পর পৌঁছালাম বার্সেলোনার বিশাল পরিচ্ছন্ন অত্যাধুনিক বিমানবন্দরে। লাগেজও এসে গেছে আমাদের আগেই, আরও এক চমৎকার অভিজ্ঞতা।
বার্সেলোনা বিমানবন্দরে পৌঁছেই অনিত সাত দিনের ট্রাভেল কার্ড কিনে নিল, যা দিয়ে বাস, ট্রাম ও মেট্রো—সবই ব্যবহার করা যাবে। শহরের দিকে রওনা হয়ে দেখলাম প্রশস্ত রাস্তা, পথচলার ফুটপাত কত বড়, প্রায় সব রাস্তা সরাসরি সোজা লম্বা, এক নিখুঁত স্থাপনা, যেন ছবির মতো। দ্রুতগতির বাস ও নিখুঁত গণপরিবহন ব্যবস্থা, উন্নত দেশের প্রকৃত পরিচয় যেন চোখের সামনে। আমাদের থাকার ব্যবস্থা করা ছিল তিন কক্ষের বেশ আরামদায়ক একটি অ্যাপার্টমেন্টে।
দূর পরবাসে জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই–মেইল: [email protected]
মন্টজুইক: ইতিহাসের পাহাড়ে
১৩ অক্টোবর সকাল ১০টায় আমরা পৌঁছালাম বার্সেলোনার বিখ্যাত মন্টজুইক পাহাড়ে। ‘মন্টজুইক’, কাতালান ভাষায় যার মানে ইহুদিদের পাহাড়। কারণ, একসময় এখানে ইহুদি কবরস্থান ছিল। পাহাড়টি শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে বার্সেলোনার ইতিহাস, রাজনীতি, যুদ্ধ, সংস্কৃতি ও প্রতিরোধের সাক্ষী।
মন্টজুইক ক্যাসলের ইতিহাস
১৬৪০ সালে কাতালান বিদ্রোহের সময় কাঠ ও মাটির তৈরি একটি সাধারণ দুর্গ হিসেবে এর সূচনা। পরবর্তী সময় ১৬৯৪ সালে পাথরের শক্ত দেয়াল, খাঁড়ি ও বেষ্টনী যুক্ত করে এটি ইউরোপিয়ান সামরিক স্থাপত্যের অনন্য নিদর্শনে পরিণত হয়।
দুর্গটি বার্সেলোনার প্রতিরোধ আন্দোলনের অন্যতম প্রধান কেন্দ্র ছিল। উনিশ থেকে বিশ শতকে এটি পরিণত হয় দমন–পীড়নের কারাগারে। এখানে ১৯৪০ সালে কাতালোনিয়ার নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট লুই এস কোম্পানিকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়, যা আজও কাতালান জাতির হৃদয়ে গভীর ক্ষতের মতো রয়ে গেছে। ২০০৭ সালে দুর্গটি সিটি কাউন্সিলের হাতে হস্তান্তর করা হলে তা রূপ নেয় শান্তি, সংস্কৃতি ও পর্যটনের কেন্দ্র হিসেবে।
প্রকৃতি, আলো আর জাদুর এক সন্ধ্যা
দুর্গের নিচে রয়েছে জাদুকরি ম্যাজিক—রঙিন আলো, সুর আর পানির সম্মিলনে সাজানো মনোমুগ্ধকর শো। সন্ধ্যা নেমে এলে আমরা সেখানে দুই ঘণ্টা ধরে আলোছায়ার অসাধারণ খেলা মুগ্ধ হয়ে দেখলাম। শো শেষে বের হতেই দেখলাম বড় রাস্তার পাশেই চলছিল অ্যাক্রোব্যাটদের উত্তেজনাপূর্ণ শো। সেই বিস্ময়ের মুহূর্তে ঘটে গেল এক অপ্রীতিকর ঘটনা। চতুর চোরেরা আমার মেয়ের দামি মুঠোফোন সেটটি তুলে নিল। আনিকা আগেই সতর্ক করেছিল যে এখানে কিছু অবৈধ ইতালিয়ান, আফ্রিকান, ভারতীয় ও বাংলাদেশি অভিবাসীরা চুরির সঙ্গে যুক্ত। তবু এই অভিজ্ঞ চোরেরা আমাদের মন খারাপ করে দিল।
মন্টজুইকের বাঙালিপাড়া—অন্য এক অভিজ্ঞতা
পাহাড় দর্শনের পর গেলাম এলাকাটির নামকরা বাঙালিপাড়ায়। সরু গলিপথে সাত থেকে আটতলা দালানের প্রতিটি রাস্তার দিকে জানালাজুড়ে ঝোলানো অসংখ্য রংবেরঙের ও নতুন–পুরোনো সব কাপড়—সব মিলিয়ে মনে হয়েছিল যেন একখণ্ড ঢাকার কোনো পুরোনো মহল্লার বাস্তব চিত্র বার্সেলোনায় দেখছি। নৌকা ও বিভিন্ন রুটে বাংলাদেশিরা স্পেনে চলে আসেন। খবরের কাগজে প্রায়ই দেখি অবৈধ উপায়ে আসার পথে ভূমধ্যসাগরে নৌকাডুবিতে অসংখ্য বাঙালিদের সলিলসমাধি। দুপুরে বাংলা খাবার ইচ্ছা হলে খাবার খেতে গেলাম নোয়াখালির মালিকের ‘মোহাম্মদিয়া’ নামের একটি বাংলা রেস্তোরাঁয়। রাথি ও আবুল নামের দুই তরুণ জানালেন, তাঁরা তিন থেকে চার বছর ধরে আছেন; অথচ কারও বৈধ কোনো কাগজ নেই। এখানে বসবাসরত অনেকেই অবৈধ পথে এসেছেন। অমানবিক পরিবেশে ১৮ থেকে ২০ জন মিলে একটি রুমে মানবেতর জীবন যাপন করছেন।
খাবার অর্ডার দিলাম, কিন্তু স্বাদ ভালো না হলেও খাবার শেষে বিল দেখে যেন মাথা ঘুরে উঠল—মেনু নেই, দাম নিজেদের মতো। নামে দুই পিস শর্ষে ইলিশ ২০ ইউরো, ছোট চিংড়ি–পালংশাক ৮ ইউরো, নেহারি, হাঁসের মাংস—সবকিছুর দাম বেআইনিভাবে তিন থেকে চার গুণ। জিজ্ঞাসা করলে বলল, মেনু নাকি সবাই চুরি করে নিয়ে যায়! অদ্ভুত অভিজ্ঞতা।
মন্টজুইক থেকে বার্সেলোনার সেরা প্যানোরামিক ভিউ
দুর্গের চূড়া থেকে দেখা যায় বার্সেলোনার ৩৬০ মনোরম দৃশ্য—নীল ভূমধ্যসাগর, বন্দরভর্তি জাহাজের সারি, পুরোনো শহরের লাল টেরাকোটা ছাদ, গথিক কোয়ার্টারের টাওয়ার, লা রামব্লা ও সবুজ পাহাড়ের রেখা। শীতল বাতাস মুখে লাগতে লাগতে মনে হয়, শত বছর আগে এই একই দৃশ্য কি সৈন্যরা দেখত?
আজ সেই যুদ্ধবিধ্বস্ত দুর্গ শান্তিতে ভরা, শিশুদের হাসিতে মুখর, পর্যটকদের কোলাহলে উজ্জ্বল। রাতের বার্সেলোনা শুধু একটি দৃশ্য নয়, এটি অনুভূতির এক অচেনা অধ্যায়, যা হৃদয়ে দীর্ঘদিন ধরে রয়ে যায়। এই শহর মানুষকে শেখায়, রাত মানেই নিস্তব্ধতা নয়; রাত মানেই সৌন্দর্যের আরেকটি ছায়াপথ।
শেষ কথা
মন্টজুইক শুধু ইতিহাস নয়, এটি বার্সেলোনার হৃদয়ের ওপর ভাসমান এক স্মৃতি, যেখানে অতীতের অন্ধকার মুছিয়ে আজ আলোর উষ্ণতা ছড়িয়ে আছে। দুর্গের প্রান্তে দাঁড়িয়ে যখন নিচে তাকিয়ে দেখছিলাম, তখন মনে হয়েছিল শহরটা যেন আমাকে এক নীরব গল্প শোনাচ্ছে।
*লেখক: শাহজালাল ফিরোজ, স্টুটগার্ট, জার্মানি