সুন্দর আর সত্যের আলিঙ্গনে

অন্তরে বাজে জয় জয় দেবী চরাচর সারে
ছবি: লেখক

বলা চলে হঠাৎ করেই মনোযোগ আকর্ষণ করে গানটি। কথা নয়, সুরটি বুঝলেন হিরণ্ময়। ওই যে সেই কৈশোরে শুনেছেন। ‘জাগো জাগো নগরবাসী!..’  ওখানে আহ্বান। আর এখানে সুন্দরের গুণকীর্তন। ‘জয় রাধামাধব জয় কুঞ্জবিহারী। জয় গোপীজন বল্লভ। জয় গিরিবরধারি।’ কথাগুলো পরিষ্কার করে দিলেন সংগীতজগতের ঊর্মি হাওলাদার। নন্দনতত্ত্বে এই এক আশীর্বাদ। গানে দখল থাকলে কথাগুলো মনে গেঁথে যায়।

মাঘ মাসের শ্রীপঞ্চমী তিথি। আবুধাবির নিসর্গ নগরী আল আইন। লোকনাথ সেবাশ্রম। এখানেই বাণী অর্চনা। আরও এক পুণ্যধাম ‘মরুতীর্থ গীতা মন্দির’। সেখানেও পূজা। দুই আয়োজনকে ধরে হিরণ্ময় এসেছেন ছুটে রাজধানী থেকে। আনন্দ উদ্‌যাপন। পাশাপাশি প্রকৃতির কাছে আসা।

মিহির শর্মা সেবা আশ্রমের সাধারণ সম্পাদক। বাসুদেব শর্মাও ব্যবস্থাপনার সঙ্গে জড়িত। অতিথিরা এলেন। তাঁরা তাঁদের সাদরে গ্রহণ করলেন। মানুষ ভাগ হয়ে গেল। ভেতরে আরও ভেতরে জায়গা করে দিলেন। আমরা গিয়ে বসলাম। আল আইন আমাদের গন্তব্য। একবার পৌঁছালেই হলো। তারপর অন্ন বাসস্থান দুইয়ের দায়িত্ব তুলে নেয় ঊর্মি-উত্তম হাওলাদার দম্পতি। অগ্রদূত-ভূমিকায় উত্তম কুমার হাওলাদার নিয়ে গেলেন দুই তীর্থে।

বিদ্যাদেবীকে সাড়ম্বরে বরণ করলেন তাঁরা। পূজার্থীরা পলাশ ফুল, বেলপাতা, গাঁদা ফুল, দূর্বা প্রভৃতি দিয়ে সরস্বতীর পায়ে অঞ্জলি দেন। ‘জয় জয় দেবী চরাচর সারে, কুচযুগ শোভিত মুক্তাহারে। বীণা রঞ্জিত পুস্তক হস্তে, ভগবতী ভারতী দেবী নমোহস্তুতে।’ নরনারী কিশোর-কিশোরী-শিশু সবাই অঞ্জলিতে অংশ নিয়েছেন। আমরা দুই জায়গায়ই এ সুযোগটি গ্রহণ করেছি।

পবিত্র মনে দেবীর সামনে
ছবি: লেখক

এক দল অনুজ আমার এখানে। দেখা হলো তাদের  সঙ্গে গীতা মন্দিরে। বিকো রায় নমস্কার জানাল। ভালোবাসা জানালাম। পংকজ ঘোষ হাত মেলাল। বললাম, ভালোবাসি। সুজন শর্মা জড়িয়ে ধরল। বললাম ভালোবাসি...ভালোবাসি। সুজন দাস, সঞ্জয় পাল একটু দূরে তখন। ছড়িয়ে দিলাম ভালোবাসা।...

ছোটরা নাচল আনন্দে। ওরা মঞ্চে বসল। কখনোবা একক কখনো যৌথ নৃত্য করল। র‌্যাপাঞ্জেল, সুপ্রিয়া, সুবিদ্যা, আরাধ্যা, অর্চিতা, মৌমিতা ঝড় তুলল। আনন্দের ফোয়ারা ছুটল ঝীলেন, ঝিমুন, প্রীতম, গোপীর অংশগ্রহণে।

বীণাপাণি
ছবি: লেখক

সত্যিই এ ছিল অন্য লগ্নে প্রত্যাবর্তন। তাঁরা সমবেত কণ্ঠে গাইলেন। শুরুটা আমার কাছে ছিলো বিশেষ এক জাগানিয়া গান। উজ্জীবনতো বটেই। ‘নিশি অবসানে...।’ আর এখানে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের মতে শ্রীকৃষ্ণ হলেন ভগবান। পুরাণ অনুযায়ী তিনি বিষ্ণুর অষ্টম অবতার। তরুণেরা ভগবানেরই জয়কীর্তন করলেন। এর আগে গীতা থেকে অনুবাদ পড়লেন বিপ্লব চৌধুরী।

পূজা করছেন পুরোহিত। অন্যদিকে খোল–করতাল বাজিয়ে একদল পুণ্যার্থী গেয়ে যাচ্ছেন ভক্তিমূলক গান। হিরণ্ময় উপভোগ করছেন সময়টি। এরই ফাঁকে সম্মানের স্মারক উত্তরীয় পরিয়ে দেওয়া হলো তাঁকে। লাকি হালদার উল্কাও সানন্দে ভক্তিতে গর্বে ধারণ করলেন এ পরিচ্ছদ। জ্বলজ্বল করে উঠল চরাচর।

সেবাশ্রমের পক্ষে অঞ্জনা সূত্রধর এগিয়ে এলেন। শিল্পী চৌধুরী, মুন্নি কর্মকার অভিনন্দন জানালেন আরেকবার। সঙ্গে ছিলেন, শর্মী শীল।  দাঁড়ালেন সবার সঙ্গে শম্ভূ শীল, অলোক কর্মকার।

খোল করতাল নিয়ে ‘জয় কুঞ্জবিহারী’র দল
ছবি: লেখক

বাঙালি সংস্কৃতিতে সরস্বতী বিদ্যা দেবী। সরস্বতী দ্বিভুজা। শ্বেতবরণী, শ্বেতাম্বরা, শ্বেত দলবাসিনী, শ্বেত হংসবিহারিণী। বীণা পুস্তক কমলধারিণী। হিন্দু সম্প্রদায়ের কাছে সরস্বতী জ্যোতির্ময়ী। সরস শব্দের অর্থ জল। সরস্বতী শব্দের আদি অর্থ হলো জলবতী বা নদী। সরস্বতী নদীর তীরে যজ্ঞের আগুন জ্বেলে ঋষি লাভ করেন বেদ ঋগ্‌মন্ত্র। এ নদী বাগ্‌দেবীর বাসস্থান। নদী অর্থে তিনি পবিত্র। সংগীতময় ও সুন্দর স্তোত্রের উদ্বোধনকারী। সেই অর্থে দেবী জ্ঞানের দেবী। ঈশ্বরের বাক্‌শক্তির প্রতীক এই সরস্বতী। তাই তিনি বাগ্‌দেবী।

সুন্দরের জয় সর্বত্র। ওরা আগেও জয় করেছে। এখনো করল। প্রিয় সেই মুখগুলো চাইল আশীর্বাদ। এর জন্য হিরণ্ময় কি যোগ্য? তিনি জানান আশীর্বাদ ও ভালোবাসা। সুস্মিতা দাস, ইংকিং রায়, জেনি ঘোষ, প্রিয়াংকা শর্মা, সুভদ্রা শীল শুভ্রা, নীপা পাল একই কাতারে এল।

আমি ছবি তুললাম।। সীমা সাহা রূপা, আশ্রম এবং মন্দির দুই জায়গায়ই এই পরিবারের তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা। তাঁর স্বামী বাদল রায় লোকনাথ সেবাশ্রমের উপদেষ্টা। বেড়ানোর অনুরোধ। কয়েক বছরই বলেছি পরের বার। এবার কী বলব? হাতে যে সময় নেই। বললাম, সত্যি সত্যি পরেরবার বেড়াব।

তরুণী মায়েদের উদ্‌যাপন
ছবি: লেখক

বিপ্লব-শিল্পীকেও একইভাবে বুঝানো হলো। লোকনাথ সেবাশ্রমের প্রধান উপদেষ্টা দুলাল চন্দ্র শীল এলেন একটু পরে। হাত বাড়িয়ে দিলেন। উষ্ণতা অনুভব করলাম হৃদয়ে। এখানকার সভাপতি উত্তম সূত্রধর।

অর্পণ রায় অঞ্জলি দিল। দশম মানের শিক্ষার্থী। বাসন্তী পাঞ্জাবি আর সাদা পাজামায় সাজিয়ে দিয়েছেন মা। জাগ্রত বুকে তার ‘বীণাপাণি'র  মন্ত্র। ‘ভগবতী ভারতী দেবী নমোহস্তুতে।’  উজ্জ্বল ও রিয়ার সঙ্গে দেখা হলো। কথা হলো শ্রেষ্ঠা, সৃষ্টির সঙ্গে। অঞ্জলি, অর্ঘ্য, অপূর্ব। ওরা ছুটছে এক দিক থেকে আরেক দিকে। তারাও পূজার্থী।

বাগ্‌দেবী অর্থে  তিনি সুন্দরও মর্ত্যবাক্যের প্রেরণা দেন। মহাসমুদ্রের মতো পরমাত্মার প্রকাশ করেন। সমুদয় মানব-মানবীর হৃদয়ে জ্যোতি সঞ্চার করেন। তিনি আলোকরশ্মি। পরমাত্মার মুখ থেকে তার আবির্ভাব। বেদ, পুরাণ ও বিভিন্ন শাস্ত্রীয় গ্রন্থে সরস্বতীর নানা রূপ ও প্রকৃতির বর্ণনা আছে।

সনাতন ধর্মীয় মানুষেরা শিশুর হাতেখড়ির অনুষ্ঠান করে বাণী অর্চনায়। নলখাগড়ার কলম আর দোয়াতে রাখা দুধ নিবেদন করা হয় দেবীর পাদপদ্মে। শিশু লেখে। চকমাটি দিয়ে বসুমতির বক্ষে অ, আ...। নলখাগড়ার কলমে মাথা রেখে দেবীর মাহাত্ম্য প্রচার করে। জয় জয় দেবী। আলাদা মহিমা পায় এ আসর।

ছোটরা নেচেছে গেয়েছে আনন্দে
ছবি: লেখক

দূর্বা এবার বারোর শিক্ষার্থী। সরস্বতী পূজায় এর আগেও শাড়ি পরেছে একবার। আজও। আর দুই কন্যার নাম না বললেই নয়। পূর্বা আর  উর্নিশা। একজন কানাডার টরেন্টো অন্যজন চীনের উহানে পূজা করছেন। নৈবেদ্য সাজিয়েছে চকোলেট দিয়ে। তাঁরাও এখানে একদিন শামিল ছিলেন বাণী–অর্চনায়।

দেখা হলো গীতা মন্দিরের সভাপতি জগদীশ চন্দ্র ঋষি বাবুর সঙ্গে। শুভেচ্ছা বিনিময় হলো। সুজন দাস দুই হাত এগিয়ে দিলেন। ভালোবাসাময় হয়ে উঠল চারপাশ। অগ্রদূত বলেছিলাম উত্তম-ঊর্মি–কে। কথা তাঁদেরই বাসভবনে। দেখলাম, তাঁদের সংগ্রহ। শ্রীমদ্ভগবদের ১২ খণ্ড। পৃথিবী কিংবা বিশ্বকে জানার এ এক অবলম্বন। আনিয়েছেন ভারত থেকে। জানলাম, উত্তম ১০ খণ্ড পর্যন্ত পড়েছেন। দেখলাম, আগ্রহ তাঁর নির্লোভ এক স্বপ্নপুরীর দিকে। কুঞ্জবিহারীর জয়বার্তা শুনেছিলাম শুরুর লগ্নে। খাওয়ার সময়ও বুঝি একই সুর। ‘নাচে গোবিন্দ। প্রেমানন্দে বলো সবে নাচে গোবিন্দ। মধুমাখা কৃষ্ণ নামে নাচে গোবিন্দ।‘ হিরণ্ময় একটু পরেই ছুটবেন আবুধাবির দিকে।