কোনো এক শনিবার সকালে

ঠিক তিন মাস আগে শনিবার শীতের সকাল, বরাবরের মতো মেঘে ঢাকা কুয়াশাঘেরা চিরচেনা মেলবোর্ন। এহেন ছুটির দিনে সকালে ঘুম ফেলে ওঠার কোনো মানে নেই, তারপরও উঠতে হলো, সিটিতে একটা সেমিনার আছে, আগেই নিবন্ধন করা ছিল যাব বলে। ইনভাইটেশন মেইলে লেখা ছিল পেইড পার্কিংয়ের ব্যবস্থা থাকবে, তাই ঝটপট তৈরি হয়ে গাড়ি নিয়ে বের হলাম। সকাল আটটা প্রায়...কুয়াশাভেজা অদ্ভুত সুন্দর সুনসান চারপাশ, শুধু থেকে থেকে কিছু গাড়ি ছুটছে যার যার গন্তব্যে...

পৌঁছে গেলাম নির্ধারিত সময়ের ১০ মিনিট আগেই, পার্কিং করে মেইলের ঠিকানা অনুযায়ী ইমারত নম্বর এবং গেট নম্বর খুঁজছি...কিছুতেই পাই না। একসঙ্গে অনেকগুলো জায়ান্ট ইমারতে, কোনটা যে! শহরের এদিকটা আসা হয়নি আগে। আমার নার্ভাস লাগা শুরু হলো। কারণ, হাতের ১০ মিনিট শেষ, এহেন শীতের সকালেও ঘামতে শুরু করলাম, দৌড়িয়ে দৌড়িয়ে হাঁটছি, অবশেষে কাঙ্ক্ষিত ইমারত পেলাম, কিছুটা স্বস্তি কিন্তু গেট নম্বর ১ দেখছি, আমার যেতে হবে ১৪ নম্বরে। সময় দেখলাম, সেমিনার শুরু হয়ে গেছে, হৃৎস্পন্দন অতিরিক্ত...নিজের ওপর নিজেই কিঞ্চিৎ বিরক্ত, চারপাশে কাউকে দেখছি না যে জিজ্ঞাসা করব। ছুটির দিনের সকাল, প্রয়োজন ছাড়া কেউ নেই। অগত্যা ১ নম্বর গেটের দিকে এগোতে থাকলাম, একটু পরে দেখি ২ নম্বর গেট, সেখানে একজন ইউনিফর্ম পরা ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে। আরও কিছুটা এগিয়ে গিয়ে তার নাম ও অর্গানাইজেশনের নাম দেখে নিশ্চিত হলাম সিকিউরিটির লোক। উত্তাল সমুদ্রে ডিঙি নৌকা পেয়ে গেছি এমন আশ্বস্ত হলাম যেন, শুভ সকাল বলে জিজ্ঞেস করলাম—‘তুমি কি জানো গেট নম্বর ১৪ কোন দিকে?’

লোকটি স্মিত হাসি দিয়ে বলল—‘শুভ সকাল, অবশ্যই জানি...চলো দেখিয়ে দিই...’

আমি বললাম—‘তোমার কষ্ট করে আসতে হবে না, আমাকে শুধু বলো কোন দিকে?’

বলল—‘কোনো সমস্যা নেই, তোমাকে বললেও বুঝে উঠবে না, যদি এখানটা আগে না এসে থাকো, ১৪ নম্বর গেট একটু দূরেই; কিন্তু আমি যেহেতু এখানে কাজ করি। সুতরাং শর্টকাট ওয়েটা জানি।’

আমি কথা না বাড়িয়ে ‘ধন্যবাদ, আচ্ছা চলো’ বলে তাকে অনুসরণ করলাম, হাঁটছি...তো হাঁটছি মাঝে টুকটাক ভদ্রতার কিছু কথা যা অবশ্যই আবহাওয়া নিয়ে বা লোকাল কোনো ফুটি খেলা অথবা কে কোন দেশ থেকে এসেছি।

প্রায় মিনিট তিনেক হাঁটার পর কিছু মানুষ চোখে পড়ল, গেট নম্বর ১৩ দেখলাম...সেখানে কোনো একটা সেমিনার হচ্ছে। বুঝলাম কাছাকাছি চলে এসেছি সাহায্যকারী ব্যাক্তিকে বললাম তোমাকে অসংখ্য ধন্যবাদ, আমি আসলেই এত তাড়াতাড়ি খুঁজে পেতাম না, অলরেডি ১৩ মিনিট লেট, আমি একা হলে আরও ১৩ মিনিট লাগত।’

সে আবারও হেসে বলল, ‘এটা আমার কাজ, আমি তোমার জন্য বাড়তি কিছুই করিনি, কিন্তু তুমি আমার কিছু ধারণা বদলে দিয়েছ, সে জন্য ধন্যবাদ।’

জিজ্ঞেস করলাম—‘কেমন?’

‘মাফ করো, বলতে চাচ্ছি না, তোমার সেমিনার কতক্ষণ? দুপুর পর্যন্ত গড়াবে? নাকি আগেই শেষ?’

‘কেন?’

উত্তর দিল—‘এই যে বাঁ পাশে সিঁড়ি দেখছ, তার পেছনে রেস্টরুম, তারপর প্রেয়ার রুম আছে, তোমরা তো দুপুরে প্রে কর, তাই দেখিয়ে দিলাম, যেন তোমার খুঁজে পেতে কষ্ট না হয়।’

আমি এবার চমকে গেলাম অন্তরে, অন্তর চমকে দিতে খুব কম মানুষ পারে, সবাই খুব ওস্তাদ অন্তরে যন্ত্রণা দিতে। এই প্রথম ভদ্রলোকের দিকে ভালোভাবে তাকালাম, কোন দেশ থেকে এসেছে আগেই শুনেছি, কিন্তু চেহারা স্বাভাবিক রেখে বললাম, ‘নাহ, সেমিনার মোটে দুই ঘণ্টা, যার ১৭ মিনিট ইতিমধ্যে পেরিয়ে গেছে। কিন্তু তুমি বুঝলে কী করে আমি প্রে করি?’

বলল—‘এই যে তোমার মাথার চুল কভার করা, মাথার চুল কভার করা যত মুসলিম লেডি আমি কর্মক্ষেত্রে দেখেছি, তাদের সবাইকে আমি প্রে করতে দেখেছি।

দন্ত বিকশিত হাসি দিয়ে বললাম—‘তুমিও কিন্তু আমার ধারণা বদলে দিলে আজ, সে জন্য তোমাকে ও তোমার পরিবারের জন্য শুভেচ্ছা।’

সে সুন্দর করে হাসল, হাতের তর্জনী উঠিয়ে একটি নির্দিষ্ট দিক দেখিয়ে বলল—‘ওই যে তোমার গেট নম্বর ১৪, তোমার জন্য আজ আমার সকালের শুরুটা সুন্দর হলো, তোমার উইকেন্ড ভালো কাটুক।’

দেখিয়ে দেওয়া দিকে তাকিয়ে যেই অর্গানাইজেশনের সেমিনারে অংশগ্রহণ করতে এসেছি, তাদের ইউনিফর্ম পরা বেশ কিছু মানুষ দেখতে পেলাম। আবার হেসে বললাম, ‘তোমাকে ধন্যবাদ দিলে কম হয়ে যাবে, তুমি ভালো থেকো, তোমার সঙ্গে আর কখনো দেখা হবে কি না জানি না; তবে যে শিষ্টাচার তুমি আমাকে দেখালে, সে জন্য আমি তোমাকে মনে রাখব। তোমার উইকেন্ডও আনন্দময় হোক,’ বলে এগিয়ে গেলাম ১৪ নম্বর গেটের দিকে এবং মুহূর্তেই বুঝে গেলাম কেন আজ আগে বেরিয়েও আমার দেরি হলো, স্রষ্টা এভাবেই জীবনের ঝুড়িতে ছোট ছোট প্রাপ্তি ও অভিজ্ঞতা যোগ করেন, আমরা অনেকেই বুঝি আবার অনেকে বুঝি না।

পুরো অস্ট্রেলিয়ায় এমন শতাধিক দেশের মানুষের চমৎকার সহাবস্থান, যারা একে অন্যকে সম্মান করে; আর সম্মান করে বলেই সম্মান ফেরত পায়। কর্মক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম নয়, লাগাতার দেশ ক্রিকেটে হারলে প্রতিবেশী দেশের সহকর্মীদের খোঁচা মাঝেমধ্যে শুনতে হয়; কিন্তু হেসে পাল্টা সঠিক উত্তরও আমরা দিতে জানি। দেশকে কখনো ছোট করি না।

হ্যাঁ এখানে কালেভদ্রে কখনো কানে আসে অমুক স্টেটে লেবুতে লেবুতে মারামারি, তমুকে চিঙ্কু চিঙ্কুতে রেশারেশি, বা পাকিতে পাকিতে গ্যাঞ্জাম, আর পান্তা ভাতের সঙ্গে ইলিশ মাছের চুলোচুলি তো অহরহ শোনা যায়।

আমি কখনোই শুনিনি এক জাতির সঙ্গে অন্য জাতির কোনো প্রকট ঝামেলা, অন্তত মেলবোর্নে। অতিরিক্ত শীতল আবহাওয়া কি কোনো পরিপূরক ভূমিকা রাখে এ সহনশীলতায়? আমার তা মনে হয় না।

অপরের প্রতি সহনশীলতা ও সম্মান প্রদর্শন পুরো অস্ট্রেলিয়ার সব স্টেটে বিরাজমান। কারণ, প্রত্যেক মানুষ এখানে তার দেশের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর হিসেবে প্রতিনিধিত্ব করে, সজ্ঞানে কেউ চায় না সেই ধারা কলুষিত হোক।

দু–চারটি অনিয়ম ও অপরিপক্বতা তো থাকবেই। কারণ, নানা দেশের বিভিন্ন ধরনের মানুষের সহাবস্থান। সেটুকু সন্তর্পণে পেছনে ফেলে আমরা এগিয়ে যাই বলে সহনশীল অস্ট্রেলিয়া পাকাপোক্তভাবে দাঁড়িয়ে।

সম্মান, অধিকার ও ভালোবাসা আদায় করতে হয় নিজের আচরণ ও যোগ্যতা দিয়ে। অন্যের আচরণকে হেয় বা ক্ষুণ্ন করে নয়।