বাবা দিবসের অঙ্গীকার

বাবা দিবসের শুভেচ্ছা বার্তা
ছবি: লেখক

আবহমান গ্রামবাংলায় আমরা বাবাকে আব্বা বলেই ডাকতাম। অবশ্য হিন্দু ধর্মের বন্ধুদের দেখতাম বাবাকে বাবা বলে সম্বোধন করতে। এরপর শহরে এসে দেখি আব্বা হয়ে গেছেন কখনো আব্বু, বাবা আবার কখনোবা ড্যাডি। আমাদের আব্বা ছিলেন একেবারে আটপৌরে গ্রামীণ মানুষ। দাদার অকালমৃত্যুর কারণে তৃতীয় শ্রেণির পর নিজের পড়াশোনাটা আর চালিয়ে নিতে পারেননি। পরিবারের বড় ছেলে হওয়াতে এরপর ধরতে হয়েছিল সংসারের হাল। এরপর কালের পরিক্রমায় শুরু করেন নিজের সংসার।

আমি বড় ছেলে হওয়াতে আব্বার সংগ্রামের অনেকটাই দেখেছি। আমিও ছিলাম সেই কঠিন সময়ে আব্বার সহযোদ্ধা, এবং সেটা নিয়ে লিখেছিলামও। আজ আব্বার যে গুণটা নিয়ে লিখব, সেটা আমি শিক্ষিত এবং অশিক্ষিত নির্বিশেষে খুব কম বাবার মধ্যেই দেখেছি। আমাদের আব্বা হচ্ছেন আমাদের তিন ভাইয়ের সবচেয়ে বড় বন্ধু। আরও সহজ করে বললে অনেকটা বড় ভাইয়ের মতো।

গ্রামের ছেলে বলেই আব্বার বিড়ি খাওয়ার নেশা ছিল। আমি ছোটবেলায় দেখেছি আব্বা ধূমপান করেন। কিন্তু বড় হয়ে ওঠার সাথে সাথে দেখলাম আব্বার বিড়ির নেশাটা আর নেই। দুটো কারণে এটা হতে পারে। প্রথমত, বিড়ি কেনার মতো বিলাসিতা করার আর্থিক সামর্থ ছিল না। দ্বিতীয়ত, আমাদের তিন ভাইয়ের কথা চিন্তা করে। যা–ই হোক, আব্বার যেহেতু ধূমপানের অভ্যেস ছিল না, তাই আমরাও আর ঐদিকে পা বাড়াইনি। আমাদের সমসাময়িক অনেক বন্ধুকে দেখেছি বিভিন্ন অছিলায় ধূমপায়ী হয়ে যেতে।

বাবা দিবসের শুভেচ্ছা বার্তা
ছবি: লেখক

গ্রামের মানুষ বলেই আব্বা দুর্দান্ত তাস খেলতে পারেন, হোক সেটা রাশিয়ান ব্রিজ কিংবা ম্যারিজ। আমার মনে পড়ে ছোটবেলায় আব্বা তাঁর খালাতো, মামাতো ভাইদের সাথে মুদির দোকানে বসে তাস খেলতেন আর আমাদের পাহারায় রাখতেন কখন ঐ রাস্তা দিয়ে উনার নানা (আমাদের বড় আব্বা) আব্বাস আলী মণ্ডল আসেন। বড় আব্বাকে দেখলেই আমরা ইশারা দিতাম। তখন উনারা তাস লুকিয়ে ভদ্রলোক হয়ে যেতেন।

বড় হয়ে উঠার সাথে সাথে আমাদের তিন ভাইয়ের মধ্যেও তাস খেলার বহুল প্রচলন দেখা দিল। আমি বুয়েটের ড. এম এ রশীদ হলে থাকি। আমার বিছানায় নিয়মিত তাসের আসর বসে। সেখানে নিয়মিত ম্যারিজ খেলা হয়। মেজ ভাইটা কুয়েটের ড. এম এ রশীদ হলে থাকে। সেখানেও একই অবস্থা তারও। এরপর একসময় আমাদের ছোট ভাইটাও বুয়েটে ভর্তির সুযোগ পেল এবং সিট পড়ল রশীদ হলে আমারই পাশের কক্ষে। তখন আমাদের তাসের আসরে সেও শামিল হয়ে গেল। কিন্তু আমরা সবসময় একটা নীতি অবলম্বন করতাম। সেটা হলো, আমরা কখনোই টাকা দিয়ে তাস খেতলাম না—যেটাকে বলে জুয়া খেলা।

এভাবে আমাদের বিভিন্ন আসরে আমাদের তিন ভাইয়ের বন্ধুরাও জুটে গেল। এরপর আমরা যখনই তিনজন একসাথে কুষ্টিয়া যেতাম, তখন বাড়িতে একসাথে একের অধিক সেট তাসও আমাদের সাথে হাজির হতো। এরপর কুষ্টিয়ার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে তিন ভাইয়ের বন্ধুরাও এসে পড়ত। তখন আমরা বিভিন্ন দলে ভাগ হয়ে ম্যারিজ খেলে সময় পার করতাম। অনেক সময় দেখা যেত, কয়েকটা দল হবার পর শেষের দলে একজন খেলোয়াড় কম পড়েছে। তখন আব্বা সেই দলে যোগ দিয়ে দল পূরণ করতেন।

বাবা দিবসের শুভেচ্ছা বার্তা
ছবি: লেখক

এ ছাড়াও বেশিরভাগ সময় আমরা তিন ভাই এবং আব্বা মিলে তাস খেলতাম। তখন আমি আর ছোট ভাইটা হতাম পার্টনার আর আব্বা এবং মেজ ভাইটা হতো পার্টনার। আব্বা এবং মেজ দুজনেই অনেক হিসেবি খেলোয়াড়। তাঁরা তাসের প্রতিটা চাল দিতেন অনেক হিসেব করে। কিন্তু তাস শুধু হিসেবের খেলা না। এটা অনেকটা ভাগ্যনির্ভর খেলাও। আমি আর ছোট ভাইটা তেমন ভালো খেলোয়াড় না। তাই বোধহয় আমাদের অনেক ভালো তাসের হাত পড়তো। তাই আব্বা এবং মেজ ভাইটা হিসেব করে চাল দিয়েও শেষমেষ আমাদের কাছে হেরে যেতেন।

হেরে যাওয়ার পর মেজ ভাইটা রাগে গজগজ করতো আর বলতো, সে তার হলের তাস খেলার চ্যাম্পিয়ন। আব্বা কিছু বলতেন না, শুধু মুচকি হাসি দিতেন। আর এদিকে মা বসে বসে রাগ করতেন আর আমাদের তাসের আসরে খাবারের যোগান দিয়ে যেতেন। মাকে প্রায়ই বলতে শুনতাম, বুড়ো মানুষ; ছেলেপেলেদের সাথে বসে তাস খেলে। এগুলো শুনেও আব্বা তার চিরপরিচিত মুচকি হাসি দিতেন। তাই তাস খেলার জন্য বা বিনোদনের জন্য আমাদেরকে তেমন কোনো লুকোছাপা করতে হতো না।

আমাদের বাড়িতে তখনো বিদ্যুতের সংযোগ আসেনি। সন্ধ্যা হলেই আমরা দুই ভাই হারিকেনের আলোয় টেবিলে পড়তে বসি। পড়া শেষ করে রাতের খাবার খাওয়া হলে একটু টেলিভিশন দেখা চাই আমাদের। তখন আমাদের পাড়াতে একমাত্র টেলিভিশন ছিল প্রতিবেশী সালামদের বাড়িতে। সেটা ছিল ন্যাশনাল ব্র্যান্ডের সাদাকালো একটা টেলিভিশন। খাওয়া শেষ করেই আমরা দুই ভাই বিভিন্ন অজুহাতে বাড়ি থেকে বের হতে চাইতাম।

বাবা দিবসের উপহারসামগ্রী
ছবি: লেখক

কিন্তু মায়ের বকুনির ভয়ে আমরা সাহস পেতাম না। তখন আমরা বলা শুরু করতাম সেদিন টেলিভিশনে কোন অনুষ্ঠানটা দেখাবে এবং তাতে কারা কারা অভিনয় করবেন এবং বিষয়বস্তুই বা কি! কারণ আমরা আশা করতাম, আমাদের আলোচনা শুনে আব্বাও টেলিভিশন দেখতে যাবেন। তখন তাঁর সাথে সাথে আমরাও যেতে পারবো।

এভাবেই আমরা রাত জেগে তখনকার দিনের টেলিভিশনের আনন্দময় অনুষ্ঠানগুলো দেখতাম। সেসব অনুষ্ঠান রাত ১০টার ইংরেজি সংবাদের আগেই শেষ হয়ে যেত। তখন আমরা বাড়ি ফিরে শুয়ে পড়তাম। মা রাগে গজগজ করতে করতে দরজার খিল খুলে দিতেন। টিনের চৌচালা ঘরের মাঝে সিমেন্টের বস্তার বেড়া দিয়ে দুটো কক্ষ তৈরি করা হয়েছিল। একটাতে আমরা দুই ভাই ঘুমাতাম আর অন্যটাতে আব্বা, মা আর ছোটভাই ঘুমাতেন। মাঝের বেড়ার মধ্যে একটা ছোট ছিদ্র করা হয়েছিল। সেটা দিয়ে হাত বাড়িয়ে উনাদের ঘর থেকে আমাদের ঘরে খিল দেয়া এবং খোলা যেত।

যতদূর মনে পড়ে, রোববার রাতে ‘হারকিউলিস’ নামে একটা ইংরেজি সিরিয়াল প্রচার করা হতো। সেই সিরিয়ালের নায়কের অসম্ভব ক্ষমতা আমাদের চুম্বকের মতো টানত। কীভাবে এ অনুষ্ঠানটার খোঁজ পেয়েছিলাম, সেটা আর এখন মনে নেই। কিন্তু আমরা একেবারে পাঁড় ভক্ত হয়ে গিয়েছিলাম সেই সিরিয়ালের। সমস্যা হচ্ছে অত রাত পর্যন্ত জেগে থাকা এবং আব্বাকেও জাগিয়ে রাখা। আর দশটার ইংরেজি সংবাদ প্রচারের আধা ঘণ্টা সময় ধৈর্য্য ধরে অপেক্ষা করা। সেখানেও আমরা সফল হতাম। সেদিন রাত্রে খিল খুলে দিতে দিতে মা আব্বাকে নিয়ে সেই একই কথা বলতেন, বুড়ো মানুষ ছেলেদের সাথে মিলে টিভি দেখে বেড়ায়।

বাবা দিবসের উপহারসামগ্রী।
ছবি: লেখক

এভাবেই শৈশব, কৈশোর পেরিয়ে তারুণ্যে পদার্পন করলাম। ইতোমধ্যে আমি বুয়েটে ভর্তি হয়ে গেছি কিন্তু ক্লাশ শুরু হতে দেরি আছে। তাই ভাবলাম অবসরটা কুষ্টিয়াতে থেকে টিউশনি করে কিছু টাকা জমাই। নতুন নতুন ঢাকাতে গেলে অনেক টাকা লাগবে। এক বাসায় টিউশনি করতে গিয়ে মাত্রাতিরিক্ত খাতির পেতে শুরু করলাম। অভিভাবক আমাকে দুই বেলা পড়াতে বললেন। নাশতাতে একগাদা খাবার দেন। অবস্থা এমন দাঁড়াল যে পারলে উনি আমাকে সারাদিন উনার বাসায় রেখে দেন। এইসব ঘটনা আমার কাছে অস্বাভাবিক মনে হওয়াতে আব্বাকে একদিন সব খুলে বললাম। শুনে আব্বা বললেন, ঐ পরিবারের ইতিহাস কিন্তু মারাত্মক। ওদের সব মেয়ের বিয়ে হয়েছে গরিব মানুষের মেধাবী ছেলেদের সাথে। তখন বুঝলাম আমি তাদের পরের শিকার হতে যাচ্ছি। এরপর আর সেই টিউশনিটা চালিয়ে নিইনি।  

এভাবেই আব্বা ছিলেন আমাদের সব কাজের ঢাল। পরবর্তীতে ইংরেজি শেখার পর জানলাম, এই বিষয়টাকে বলে—আই গট ইউর ব্যাক। আব্বা সব পরিস্থিতিতে বন্ধুর মতো আমাদেরকে সহায়তা করেন। এখনো অনেক বিষয় মার সাথে আলাপ করতে ইতস্তত করলেও আব্বাকে বলে ফেলি নির্দ্বিধায়। বর্তমানের দুনিয়ায় আমাদেরকে দ্বীপের মতো মানুষ হবার শিক্ষা দেয়া হচ্ছে।

সবাইকে নিয়ে ভালো থাকার পরিবর্তে নিজের সচ্ছলতা, স্বাচ্ছন্দ্য এবং সুখের ওপর জোর দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু সবাইকে নিয়ে থাকার মধ্যে যে বিরাট শিক্ষা নিহিত, সেটা থেকে আমরা প্রতিনিয়ত বঞ্চিত হচ্ছি। এভাবেই নিজেদের ভালো রাখতে গিয়ে আমাদের বাচ্চারাও একসময় আমাদের থেকে দূরে সরে যাচ্ছে।

এসব গল্প যখন আমি আমার পরিচিতজনদের সাথে ভাগ করি, তখন তারা অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকান। প্রযুক্তির উৎকর্ষতার এই সময়ে এখন সবকিছুই এখনকার বাচ্চাদের হাতের মুঠোয় এসে ধরা দিচ্ছে। সেখানে ভালো এবং মন্দের মধ্যে ফারাক বোঝা খুবই কঠিন। সেক্ষেত্রে মা-বাবারা হতে পারেন বাচ্চাদের সবচেয়ে বড় গাইড। কিন্তু যেহেতু মা–বাবারা কখনোই বাচ্চাদের বন্ধুর আসনে বসতে পারেন না, তাই তাঁরা তাঁদের সাথে সব বিষয় সহজে ভাগ করে নিতে পারেন না। আর তখনই তারা ভুল পথে পা বাড়ায়। বাবা যদি অভিভাবকের পাশাপাশি বাচ্চাদের সবচেয়ে বড় বন্ধু হয়ে উঠতে পারেন, তাহলে তাদের জীবন অনেক সহজ হয়ে যেত।

অস্ট্রেলিয়াতে প্রতিবছর বাবা দিবস পালিত হয় সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম রোববার। এ দিনটাকে সামনে রেখে সন্তানেরা তাদের বাবাদের জন্য অনেক ধরনের আয়োজন করে। সেখানে উপহার থেকে শুরু করে খাওয়া—সবই থাকে। প্রবাসের নতুন পরিবেশে মা–বাবাকে একসাথে অনেকের রোল প্লে করতে হয়। কারণ, প্রবাসী দ্বিতীয় প্রজন্ম দেশে ফেলে আসা আত্মীয়স্বজনের স্নেহ ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত হয়।

তাই বাবা যদি তাঁর সন্তানের বন্ধু হয়ে উঠতে পারেন, তাহলে বাবা যেমন একজন সঙ্গী পাবেন, সন্তান পাবে তার ভবিষ্যৎ পথ চলার নির্দেশনা। বাবা দিবসকে সামনে রেখে তাই আসুন আমরা নিজ নিজ সন্তানের সাথে বন্ধু–ভাবাপন্ন সহজ, সাবলীল এবং সুন্দর সম্পর্ক গড়ে তুলি।