সিদু ভ্রমণ: বেইজিংয়ের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে একদিন

বেইজিং শহর চীনের রাজধানী। সবুজে ঘেরা এই শহরের আরবান এরিয়া গোছানো ও সুশৃঙ্খল। বেইজিং মূলত গ্রেট ওয়াল বা চীনের প্রাচীরের জন্য বিশ্ববিখ্যাত হলেও, এই শহরের প্রতিটি পরতে পরতে লুকিয়ে আছে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আর প্রাচীন স্থাপত্যের অপূর্ব মেলবন্ধন। বেইজিং শহর মোটামুটি চারদিক থেকে পাহাড়ে ঘেরা।

দীর্ঘ সময় ধরে বেইজিংয়ে থাকার সুবাদে শহরের অনেক জায়গাতেই ঘোরাঘুরি করা হয়েছে। এবার আমাদের গন্তব্য ছিল ‘সিদু’। সিদু মূলত বেইজিংয়ের ফাংশান ডিস্ট্রিক্টে অবস্থিত, যা সিটি সেন্টার থেকে প্রায় ৮০ কিলোমিটার দূরে। প্রাইভেট কারে প্রায় দুই ঘণ্টার যাত্রা। দীর্ঘ দিনের পরিকল্পনা অনুযায়ী, গত ১৮ তারিখ ভোরে আমরা ১২ জন পূর্বপ্রস্তুতি নিয়ে রওনা হলাম সিদুর পথে।

আমরা আগে থেকেই কিছু ভিডিও দেখেছিলাম সিদু সম্পর্কে। কিন্তু ওখানের প্রকৃত সৌন্দর্য কোনো ছবি বা ভিডিওতে পুরোপুরি প্রকাশ করা সম্ভব নয়। ‘সিদু’ একটি চায়নিজ শব্দ, যার অর্থ ‘দশটি ফেরি পার হওয়া’। আগে এই এলাকায় যেতে হলে ১০টি নদী ফেরি পার হয়ে যেতে হতো, তাই জায়গাটির নাম হয় ‘সিদু’। এখন যদিও ব্রিজ ও রাস্তার মাধ্যমে যাতায়াত অনেক সহজ, তবু এ নামের পেছনের ঐতিহাসিক ব্যাখ্যাটি জায়গাটিকে আরও আকর্ষণীয় করে তোলে।

‘দূর পরবাস–এ’ জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]

সিদুর সৌন্দর্য যেন এক নৈসর্গিক ক্যানভাস—পাহাড়, ঝরনা, পাহাড়ের বাঁকে বাঁকে স্বচ্ছ পানির লেক, সব মিলিয়ে অপূর্ব এক দৃশ্য। আমাদের দলে সবাই বাংলাদেশি, শুধু একজন ছিলেন চায়নিজ। টিমের মধ্যে দুজন ছাড়া বাকি সবাই বেইজিংয়ের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্যাচেলর, মাস্টার্স বা পিএইচডি পর্যায়ে অধ্যয়নরত। সঙ্গে ছিলেন আমাদের বড় ভাই, এক ব্যবসায়ী আর ভাবি।

আমরা সবাই এই সিদু ট্যুর নিয়ে বেশ উত্তেজিত ছিলাম। ভোরে রওনা দিয়ে বেলা ১১টার দিকে আমরা নির্ধারিত জায়গায় পৌঁছালাম। তখন সবাই বেশ ক্ষুধার্ত হলেও, পাহাড় আর লেকের স্বচ্ছ পানির প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখে আমরা খাওয়ার কথা প্রায় ভুলেই গিয়েছিলাম। সকালের খাবার শেষে শুরু হলো ছবি তোলা আর ঠান্ডা পানিতে নামার আনন্দ।

এরপর শুরু হলো গানের আসর। চারপাশের প্রকৃতির মধ্যে গান যেন এক অন্য রকম আবেশ তৈরি করেছিল। আমাদের গান শুনে আশপাশে থাকা চায়নিজ পর্যটকেরাও আমাদের জড়ো হতে লাগলেন। দেখতে দেখতে সময় পেরিয়ে যাচ্ছিল। তারপর আমরা গাড়ি নিয়ে আশপাশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখতে বেরিয়ে পড়লাম। যতই পাহাড়ি রাস্তা ধরে ভেতরে যাচ্ছিলাম, প্রকৃতির রূপ ততই মোহিত করে তুলছিল আমাদের।

বিকেলে লেকের পাশে স্বচ্ছ পানির ধারে বারবিকিউ করা হলো। আর দেখতে দেখতে পশ্চিমাকাশে সূর্য অস্ত যেতে শুরু করল, যা আমাদের ফিরতি পথ ধরতে বাধ্য করল।

এই বিদেশ বিভুঁইয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ল্যাব, ক্লাস আর কাজের মধ্যে এমন একটা দিন যেন আমাদের কিছু সময়ের জন্য হলেও দেশে থাকার অনুভূতি এনে দিল। দূরে থাকার বেদনায় এক পশলা শান্তির পরশ বুলিয়ে দিল এই আনন্দঘন সময়। যেমন সন্ধ্যায় পাখিরা নীড়ে ফিরে আসে, ঠিক তেমনি আমরাও আবার শহরের পথে ধরলাম একরাশ ভালো লাগা আর স্মৃতির বোঝা নিয়ে।

লেখক: জান্নাতুল আরিফ, পিএইচডি গবেষক, নর্থ চায়না ইলেকট্রিক পাওয়ার ইউনিভার্সিটি, বেইজিং, চায়না