আরশির প্রথম ঈদ

এ বছরের ২১ এপ্রিল আমেরিকায় উদ্‌যাপিত হয়ে গেল পবিত্র ঈদুল ফিতর। বাংলাদেশে ঈদুল ফিতর কী, তা বর্ণনা করার দরকার পড়ে না। ঈদের ব্যাপারে দেশের সবাই অবগত। তবে আমেরিকায় ব্যাপারটা ভিন্ন। এখানে ‘ঈদ’ কী, সেটা আলাদাভাবে বর্ণনা করা লাগে। গত ৮ বছরে বিভিন্ন ধরনের বর্ণনার বিভিন্ন ধরনের কার্যকারিতা পরীক্ষা করে দেখলাম, ঈদুল ফিতরের এক লাইনের পরিচয় হিসেবে ‘এটা আমাদের ক্রিসমাস’ শতভাগ কার্যকর। সত্যি বলতে কি, কার্যকর হলেও ঠিক সত্য নয়। আপাতদৃষ্টে একই রকম মনে হলেও কিছুটা ভিন্নতা তো আছেই। তবে আজকে ভিন্নতা নিয়ে নিজেকে ব্যস্ত রাখব না, উদ্‌যাপনেই আমার মূল লক্ষ্য।

আমাদের প্রথম ও একমাত্র সন্তান, আরশি রশিদের জন্ম গত বছরের জুলাইয়ে। গত ঈদুল ফিতরের মাস দুয়েক পরে, ঈদুল আজহার ঠিক পরদিন। সে হিসাবে এবারের ঈদ ছিল আরশির জীবনের প্রথম ঈদ। বিদেশের মাটিতে আরশির প্রথম ঈদ। বিদেশের মাটিতে আমি আর শামীম এই নিয়ে বেশ কয়েকটা ঈদ উদ্‌যাপন করলাম। প্রতিবছরই এসব দিনে দেশের কথা অনেক বেশি মনে পড়ে। ছোটবেলায় এই দিনের জন্য মাসের পর মাস অপেক্ষা করতাম। মাসজুড়ে চিন্তিত থাকতাম ঈদের বাজারে কবে যাব, কী কী কিনতে পারব—এসব নিয়ে। আহ! কী যে দিন ছিল! দেশের বাইরে ঈদের মজা নেই, থাকলেও কিছুটা কম; অনেকটাই কম।

সে রকম একটা ‘বিদেশ’–এর মাটিতে জন্ম নিয়েছে আরশি। অবশ্য এ দেশে যদি সে জন্ম নেয়, তাহলে তো সে শুরুতেই এই দেশি। আমি আর শামীম হয়তো ভবিষ্যতে বাংলাদেশি আমেরিকান হব, কিন্তু আরশি তো এখনই আমেরিকান। আমেরিকান বাংলাদেশি। এমন একটা দেশের নাগরিক সে, যে দেশে ঈদের আনন্দ উদ্‌যাপন করার জন্য কোনো সরকারি ছুটি নেই। এত কিছুর পরও এই ঈদে আমরা অনেক আনন্দ করেছি। আরশিও বেশ ব্যস্ততায় দিন কাটিয়েছে।

দেশের মতো, এদিনের পরিকল্পনা শুরু করেছি মাসখানেক আগে থেকেই। দেশে ঈদের দিন নামাজ শেষে ‘পাড়া বেড়ানো’ একটা অত্যাবশ্যক সংস্কৃতি। এলাকার যেকোনো বাড়িতে গিয়ে এলাকাবাসীর সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময় করা ঈদুল ফিতর উদ্‌যাপনেরই একটা অংশ। এটা বলাই বাহুল্য, এই শুভেচ্ছা বিনিময়ে কোনো বাড়ি থেকে আলাদা কোনো দাওয়াত লাগে না। সব বাড়ি সবার জন্য উন্মুক্ত। অন্তত গ্রাম এলাকায় কোনো দাওয়াত লাগে না। আর শহরে তো কেউ থাকেই না ঈদের সময়। তা ছাড়া, আমি গ্রামে বড় হওয়া মানুষ। গ্রামের আচার–আচরণই আমার কাছে দেশের সংস্কৃতি।

বিদেশের অবস্থা শহরের মতোই। দাওয়াত ছাড়া কোনো বাসায় যাওয়া যায় না। সে জন্য সবাই আগেভাগে প্রস্তুতি নিয়ে রাখে, কাকে কাকে দাওয়াত দেবে, কোনো বাড়িতে কয়টা থেকে কয়টা পর্যন্ত দাওয়াত থাকবে ইত্যাদি। ন্যাশভিলে, মাশা আল্লাহ, অনেক বাংলাদেশি পরিবার। বিশ্ববিদ্যালয়গামী বেশ কিছু দেশি ভাইবোনও আছে। সব মিলিয়ে ঈদের দিনে ভালোই বড়সড় একটা জমায়েত হয়। বেশ কিছু পরিবার ‘ওপেন হাউস’–এর আয়োজন করে থাকে। তাদের মেহমানদের সময় থাকতেই দাওয়াত দিয়ে রাখে যাতে মেহমানরা আগেভাগে দাওয়াতের হিসাব করে দিনের পরিকল্পনা সাজাতে পারে। এসব নিয়ম মেনে নিয়ে আমি আর শামীম ঠিক করলাম, আমাদের প্রথম ওপেন হাউসে আমরা প্রাথমিকভাবে বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া এবং খুব কাছের কিছু পরিবারকে দাওয়াত দেব। ঈদের নামাজ শেষে আমরা কিছু ওপেন হাউসে অংশগ্রহণ করে সন্ধ্যার পর আমাদের হাউস ওপেন করে দেব, এইটাই সার্বিক পরিকল্পনা।

পরিকল্পনা অনুযায়ী জোগাড় শুরু করলাম। এটা আমাদের প্রথম ওপেন হাউস। এর আগে কখনো এত বড় পরিসরে ঈদের আয়োজন করার অভিজ্ঞতা আমাদের নেই। তাই মনে একটু ভয়ও আছে। ভাবলাম, কাটারিং সার্ভিসের সহায়তা নেব। কয়েক জায়গায় ফোন করে বুঝতে পারলাম, যারা কাটারিং করে, সবাই ঈদে ওপেন হাউসের পরিকল্পনা করে রেখেছে। অগত্যা নিজেরাই সব করব বলে সিদ্ধান্ত হলো। শামীম ঈদের এক সপ্তাহ আগে থেকে রান্নাবান্না শুরু করে দিল। আরশি রাত জেগে ওর মাকে সর্বাত্মক সহায়তা দিয়ে গেছে এই এক সপ্তাহজুড়ে। খুব ব্যস্ত সময় কেটেছে আমাদের এই এক সপ্তাহ।

এ তো গেল আরশির মা–বাবার ঈদের প্রস্তুতি। ওদের তুমুল ব্যস্ততার মাঝে আরশির ঈদের প্রস্তুতিও কোনো অংশে থেমে থাকেনি। আরশির বয়স এখন প্রায় ১০ মাস। ন্যাশভিলে আটজন কচিকাঁচার মধ্যে সে একজন। তার অন্য বন্ধুবান্ধব হলো ট্রিস্টান (১২ মাস), সুদাইস (১০ মাস), ইরহা (৯ মাস), জুরী (৫ মাস), আলিশবা (৪ মাস), আইয়ানা (৪ মাস) ও নুরাইজ (৩ মাস)। এদের মধ্যে ইরহা আপাতত ভার্জিনিয়া থাকে। তবে তাঁর শিকড় কিন্তু ন্যাশভিলে। ইরহাকে সবাই ন্যাশভিলবাসী হিসেবে বিবেচনা করে। ঈদ উপলক্ষে সে ন্যাশভিল এসেছিল। ওর জন্য ৫ ঘণ্টার রোডট্রিপ একটা বিশাল চ্যালেঞ্জ। তারপরও সে ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করতে ন্যাশভিল এসেছে দেখে অন্যরা খুব খুশি হয়েছে।

ঈদের দিন সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে আরশি দিনের প্রস্তুতি শুরু করে দিল। প্রথম কাজ: গোসল করা। ছোটবেলা থেকেই আরশি গোসল করা অনেক উপভোগ করে। প্রতিদিন দুপুরে সে বাথটাবে গোসল করে। তবে ঈদের দিনে এত সকালে গোসল করার ব্যাপারটা তার কাছে নতুন। একটু মন খারাপও হয়ে গিয়েছিল গোসল শেষে। তারপরও কী আর করা। ঈদ বলে কথা।

নতুন জামা পরে একটু সময় হাতে রেখে ঈদগাহের দিকে রওনা দিয়ে দিলাম আমরা। পথে একটু থেমে ফয়সালকে নিয়ে নিলাম আমাদের গাড়িতে। ঈদের জামাতে গিয়ে আরশির সঙ্গে অনেক আন্টির দেখা হলো। প্রতিবারের মতোই এবারের ঈদগাহ হলো টেনেসি স্টেট ইউনিভার্সিটির ফুটবল অনুশীলন কেন্দ্রে।

বিশাল একটা মাঠ, ওপরে ছাউনি দেওয়া। ঈদগাহ হিসেবে এর চেয়ে ভালো কোনো জায়গা হতে পারে না। তবে গাড়ি রাখাটা একটা সমস্যা। অন্যান্য বছরের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে এবার নয়টার জামাতের জন্য সাড়ে আটটায় পৌঁছে গেলাম। গিয়ে দেখি অনেকেই আমাদের মতো ৩০ মিনিট আগে গিয়ে সব পার্কিং দখল করে ফেলেছে। বেশির ভাগ মানুষ বুদ্ধিমান হয়ে গেলে যা হয় আরকি! অগত্যা অনেক দূরে গাড়ি রেখে হেঁটে হেঁটে ঈদগাহে প্রবেশ করলাম। গ্রামে বড় হওয়া মানুষ আমরা, এতটুকু হাঁটা নিয়ে কোনো সমস্যা নেই। হাইস্কুলে যাওয়ার জন্য এর চেয়ে বেশি হাঁটতাম। এমনকি স্কুলের টিফিনের সময় দোকানে যাওয়ার জন্য এর চেয়ে বেশি হাঁটতাম। সমস্যা হলো, আরশির স্ট্রলার নিয়ে। ঘাসের ওপরে এই জিনিস ঠেলে নিয়ে যাওয়া একটা বিশাল বিড়ম্বনার ব্যাপার।

ঈদের নামাজ পড়ালেন ইমাম বাহলুল। ধর্মীয় পড়াশোনায় ডক্টরেট ডিগ্রিধারী। ইসলামিক সেন্টার অব ন্যাশভিলের রেসিডেন্ট স্কলার। নামাজ ও খুতবা শেষে শুরু হল কোলাকুলির পর্ব। ন্যাশভিলের মতো ‘লাল’ একটা শহরে এত বড় ঈদের জামাত একটা আনন্দের ব্যাপার। নিউইয়র্ক, নিউ জার্সি কিংবা মিশিগানে এ রকম বড় বড় ঈদের জামাত খুবই স্বাভাবিক। তবে ন্যাশভিলে এটা গৌরবান্বিত হওয়ার মতো একটা বিষয়। তার ওপরে সবচেয়ে বড় আনন্দের ব্যাপার হলো এ জামাতে বাংলাদেশিদের উপস্থিতি। যেদিকেই তাকাই, পরিচিত দেশি মুখ। বাংলায় কুশলবিনিময়, বাঙালির সঙ্গে কোলাকুলি।

ন্যাশভিলে বাংলাদেশি সমাজ দিন দিন বড় হচ্ছে। এখানে মুসলমানদের সংখ্যাও অনেক বেশি। এবার তো মসজিদের মাঠে ঈদবাজারেরও আয়োজন করা হয়েছিল ঈদের সপ্তাহ খানেক আগে। পাঁচ থেকে ছয় শ মানুষের সমাগম হয়েছিল এই বাজারে। খুবই আনন্দের ব্যাপার।

নামাজ শেষ, কোলাকুলি চলছে

আরশি তার আন্টিদের সঙ্গে কুশলবিনিময় শেষে আমরা সবাই বাইরে বের হলাম। এরপর শুরু হলো ঈদের দিনের প্রাথমিক ছবি তোলা পর্ব। ছবি তোলায় আরশির কখনোই অনীহা নেই। এখানে দেখা হয়ে গেল সুদাইস, নুরাইজ, আইয়ানা ও ইরহার সঙ্গে। আলিশবাকে সামান্যর জন্য মিস করলাম। তবে চিন্তা নেই, বিকেলে তো ওদের বাড়িতে দেখা হবেই। জুরীর বাসায় সেমাই খাওয়ার দাওয়াত আছে। ঈদগাহের ছবি পর্ব শেষ করে জুরীদের বাসায় এসে সেমাই-নুডলস খেলাম আমরা। সেই ভোরে ঘুম থেকে ওঠে, তখন প্রায় বেলা ১১টা। আরশির একটু একটু ঘুম পাচ্ছে দেখে আমরা ওখান থেকে বিদায় নিয়ে বাসায় এলাম। পথে আরশি একটু ঘুমানোর সুযোগ পেল।

ঈদে রশিদ পরিবার

পরবর্তী গন্তব্য আমিনুল ভাইয়ের বাসা। ওখানে শামীম ও আরশিকে রেখে আমি আর আমিনুল ভাই মসজিদে গেলাম জুমার নামাজটা সেরে নিতে। জুমার পরে একে একে সাইফ ভাই, খালিদ ভাই, আদনান ভাইয়ের বাসা ঘুরে দিনের ঘোরাঘুরির পর্বে ইতি টেনে বাসায় ফেরত এলাম সবাই। খালিদ ভাইয়ের বাসা থেকে আসার পথেই যে আরশি ঘুমিয়ে গেল, আলিশবার (আদনান ভাই) বাসায় গিয়ে পুরো সময়টাই সে অঘোরে ঘুম দিল। চাঁদরাতে রাত জেগে মাকে কাজে জোগান দেওয়ায় তার ঘুমে একটু কমতি পড়ে গিয়েছিল। এখন সে ঘুম পুষিয়ে নিচ্ছে। আমিও মনে মনে খুব খুশি। রাতে সবাই আমাদের বাসায় আসবে। আরশির ঘুমে কমতি থেকে গেলে একসঙ্গে মেহমান আর বাচ্চা সামলানো আমাদের জন্য কষ্টকর হয়ে যেতে পারে। সে জন্য ওর ঘুমে ব্যাঘাত ঘটালাম না। বাসায় এসে কোনোরকমের ঝামেলায় না গিয়ে কার সিটেই ওকে ঘুমাতে দিলাম।

আমরা ওপেন হাউসে ৬০ জনের মতো মেহমান আশা করছিলাম। সন্ধ্যা ছয়টা থেকে রাত দশটা পর্যন্ত ছিল আমাদের সময়। কপালের এমন ফের, পাঁচটার দিকেই বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল। সন্ধ্যা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বৃষ্টির পাল্লাও বেড়ে চলল। এই টানা বৃষ্টির মধ্যেও আমরা মোটামুটি ভালো একটা উপস্থিতি পেলাম আমাদের ঘরে। অনেক দিন পরে আমার বাসায় পার্টি আয়োজন করেছি। করোনাভাইরাসের মহামারি আর আরশি জন্ম—এসব মিলিয়ে বছর দুয়েক ধরে কোনো বড়সড় আয়োজন করিনি। ঈদ উপলক্ষে সেই পুরোনো জমজমাট ফেরত আসছে দেখে ভালো লাগল। উপস্থিতির মধ্যে বেশ কয়েকজনের জন্য বিদেশে এটাই তাদের প্রথম ঈদ। আর কিছু মেহমানের জন্য জীবনে এটাই প্রথম ঈদ। কিছু মেহমান খারাপ আবহাওয়ার জন্য আসতে পারেনি। আর ট্রিস্টান আসতে পারেনি ঘুমিয়ে পড়েছে দেখে। তবে ট্রিস্টানের বাবা কেইস আর চাচা নিকো এসেছে।

ঈদে আমাদের বাসায় সর্বপ্রথম অতিথি হলো সুদাইস। সুদাইসের বাবা-মা হলো শাওন ও ইয়েসমিন এবং বড় ভাইয়ের নাম সুহাইল। আমাদের বাসার অলিগলি সুহাইলের মুখস্থ। এসেই সে বাসার সব জিনিস ঠিক আছে কি না, ধরে ধরে দেখা শুরু করল। আর আরশি আর সুদাইস ব্যস্ত কী যেন একটা খেলনা নিয়ে টানাটানিতে। আস্তে আস্তে অন্যরাও আসা শুরু করল। শামীম ইতিমধ্যে সব খাবারদাবার কিচেনে সাজিয়ে রাখা শেষ করেছে। খুবই জমজমাট অবস্থা। খাওয়াদাওয়া শেষে একে একে যখন সবাই বিদায় নিচ্ছিল, তখন খেয়াল করলাম, আমরা অনেক বেশি রান্নাবান্না করে ফেলেছি। তবে শামীমের মতামত হলো, প্রথম আয়োজনে যে কম পড়েনি, সেটাই শান্তি।

রাতে বিদায় নেওয়া সর্বশেষ অতিথি হলেন কামরুল ভাই আর টুনা আপু। জোর করে ওদের বসিয়ে রেখেছিলাম। কামরুল ভাইয়ের সঙ্গে গল্প করে মজা আছে। তা ছাড়া ওনার দুটো ছেলেই (নিহান আর আদিয়ান) খুব আদরণীয়। নিহান আর লাবিব হলো ‘বেস্ট ফ্রেন্ড’। ওরা দুজন এসেই এক্সবক্সের কন্ট্রোলার নিয়ে খুব ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল। ওরা এত ব্যস্ত ছিল যে ঘরের কোণে একটা ছোট অ্যাকুয়ারিয়াম আছে সেটা নিহান খেয়ালই করেনি। যখন জোর করে এক্সবক্স বন্ধ করে দিতে হলো, তখন সে অ্যাকুয়ারিয়ামটা খেয়াল করল। ওখানে মাছের সঙ্গে কথা বলা, খাবার খাওয়ানো, কামরুল ভাই–টুনা আপুর সঙ্গে গল্প করা, এসব করতে করতেই অনেক রাত হয়ে গেল। সারা দিন ঘোরাঘুরি করে তারাও ক্লান্ত। শেষে কামরুল ভাইয়ের সঙ্গে একটা ঈর্ষা–জাগানিয়া সেলফি তুলে সেটা আরাফাত ভাইকে পাঠিয়ে দিয়ে আমাদের ওপেন হাউস ক্লোজ করে দিলাম। এবারের ঈদের দিন খুবই উপভোগ করলাম। বছর দুয়েক আগে গ্রামের বাড়িতে করা ঈদের মতোই কিছুটা আনন্দ পাওয়া গেল। আরশিও তার জীবনের প্রথম ঈদের আনন্দ ওই দিনের মতো শেষ করে টুপ করে ঘুমিয়ে গেল। একটু ঘুম খুব দরকার তার। পরের দিন আবার ট্রিস্টানের জন্মদিন উদ্‌যাপন করতে অনেক দূরে যেতে হবে।

ঈদের পরদিন দুপুর পর্যন্ত ঘুমাতেই চলে গেল। ঘুমের মধ্যেই কেইস মেসেজ দিয়ে মনে করায় দিল ট্রিস্টানের জন্মদিনের পার্টি যেন মিস না করি। ওরা থাকে শহরের একেবারে অন্য পাশে, ম্যাডিসনে। ট্রিস্টান আর আরশির মধ্যে তুলনা করলে কে আমেরিকান আর কে এশিয়ান, তা একনজরেই বোঝা যায়।

কেইস আমার পুরোনো বন্ধু। ন্যাশভিল শহরে আসার পরপরই তার সঙ্গে আমার পরিচয়। খুবই পরোপকারী ব্যক্তি সে। ওখানে গিয়ে কেইসের ভাই, মা, শাশুড়ি, বন্ধুবান্ধবী, অনেকের সঙ্গে দেখা হলো।

পার্টিতে আমরা দেরি করে গিয়েছি। আবার তাড়াতাড়ি বিদায় নিয়ে চলে এলাম। সন্ধ্যার পরে নাবিদদের বাসায় যাওয়ার কথা। নাবিদ আর সিন্থিয়া ন্যাশভিলে তুলনামূলকভাবে নতুন। মাত্র আট মাস আগে এসেছে ওরা। এখন আবার চলে যাচ্ছে। নাবিদের মা–বাবা খুব অমায়িক। আমাদের বাসায় এসে গল্প করেছিলেন অনেক। ওদের বাড়িও চট্টগ্রামে। আন্টির সঙ্গে শান্তিতে আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলা যায়। ওদের ওখানে গিয়ে পৌঁছালাম সন্ধ্যা সাতটার আগে আগে। ওখানে কিছুক্ষণ পরে আলিশবা, আর আইয়ানার সঙ্গে আরশির দেখা হয়ে গেল। ঈদের পরের দিনের সব কর্মকাণ্ড মনে হলো আরশির জন্যই সাজানো। ওদের বাসায় পুরো সময়টা আরশি অনেক আনন্দে কাটিয়েছে। তিন পিচ্চির কেউই কথা বলতে জানে না। তবে পিচ্চিদের খেলাধুলা করার জন্য কথা বলার যে দরকার পড়ে না, সেটা ওরা আবার নতুন করে দেখিয়ে দিল আমাদের। ওদের দেখলে মাঝেমধ্যে মনে হয়, আমরা বড়রা কথা বলি দেখেই হয়তো সবাই এত দূরে দূরে। বয়স যত বাড়ে, সঙ্গে সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ে দূরত্ব। পিচ্চিরা কোনো কথা বলে না দেখেই হয়তো ওদের মধ্যে দূরত্ব থাকে না।

শুক্রবার ছিল ঈদের দিন, শনিবারেও কম বেড়ালাম না। বলতে গেলে, বিদেশে এইটাই আমার কাটানো সবচেয়ে ভালো ঈদ। শামীমও তা–ই বলেছে। আমি নিশ্চিত, কথা বলতে পারলে, আরশিও বলত, এইটা তার জীবনের সেরা ঈদ। সেরা না হয়ে উপায় নেই। যে পরিমাণ উপহার আর সালামি পেয়েছে সে, আমার ছোটবেলায় এ রকম সালামি পেলে তো সাত দিন ধরে শুধু সাইকেল চালাতাম আর আচার খেতাম। ছোটবেলায় সালামির টাকা দিয়ে এর বাইরে কিছু করার কথা মাথায় কখনো আসেনি। সালামি পেলেই ঘণ্টা হিসাবে সাইকেল ভাড়া নিয়ে রাস্তায় বের হয়ে যেতাম। অনেকেই মার্বেল কিনত। আমি মার্বেল খেলায় ভালো ছিলাম না। তবে আচার খাওয়ায় খুব ভালো ছিলাম। বার্মিজ আচারগুলো ঈদের সময়ে একটু বেশি সুস্বাদু মনে হতো। আমি জানি না আরশি তার সালামি দিয়ে কি করতে চায়। সে জন্য আপাতত ওগুলো তুলে রাখছি। পরেরটা পরে দেখা যাবে।

বিদেশে জীবনযাপন খুব ব্যস্ততায় কাটে। ব্যস্ততার মধ্যে বেশি মনে না পড়লেও ঈদে-চান্দে দেশের কথা খুব মনে পড়ে। আমার মনে আছে, গত বছর আমরা খুব নীরবে ঈদ পার করেছিলাম। কোথাও যাইনি তেমন, যাওয়ার মতো অবস্থায় ছিলামও না। কোরবানের ঈদে তো নামাজই পড়তে পারলাম না। তার মাত্র আগের দিনই আরশি এই পৃথিবীতে এল। হাসপাতালেই দিনটা কাটিয়েছিলাম। ন্যাশভিলে ভালো কিছু বন্ধুবান্ধব জুটেছে আমাদের। ওদের কারণে এসব কষ্ট কিছুটা হলেও লাঘব হয়। সে কারণেই সব বন্ধুকে জানাই ভালোবাসা। বয়সের কারণে সৃষ্ট দূরত্ব দিন দিন কমে আসুক, না কমলেও অন্তত না বাড়ুক, সেই আশা নিয়েই সবাইকে জানাই ঈদের শুভেচ্ছা, ঈদ মোবারক।