তোমাকে ভালোবাসি, বাবা

‘বাবা’—ছোট এ শব্দটি আমাদের জীবনে হয়তো সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব বহন করে। গুরুত্বপূর্ণ এ মানুষটি একজন ‘আনসাং হিরো’র মতোই, যাঁরা আড়ালে থেকে সারা জীবন নীরবে তাঁদের দায়িত্ব পালন করে যান; বিপরীতে খুব সামান্য কৃতিত্ব মিলে থাকে। যত বড় বিপদই আসুক, তাঁরা তাঁদের সর্বস্ব দিয়ে আগলে রাখেন পরিবারকে। জীবনের শেষনিঃশ্বাস পর্যন্ত যাঁদের দায়িত্ব কখনো শেষ হয় না। আমি নিজেকে খুবই ভাগ্যবান মনে করি, আমার জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে বিশাল দায়িত্বের এ মানুষটিকে পেয়ে।

আমার বাবার নাম সুকুমার দত্ত, অবসরপ্রাপ্ত ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, বাংলাদেশ মহাকাশ গবেষণা ও দূর অনুধাবন প্রতিষ্ঠান (স্পারসো)। এই লেখার শুরুতে ‘বাবা’-কে যেভাবে সংজ্ঞায়িত করলাম, সেই সংজ্ঞা বাবাকে দেখেই শেখা। বাবা যখন চাকরিজীবনে ছিলেন, সকাল-সন্ধ্যা অফিস করেও চেষ্টা করতেন আমাদের সময় দিতে। আমাদের বলতে মা, দিদি আর আমি। সারা দিন অফিসের কাজে ব্যস্ত থাকলেও আমাদের দেখলে তাঁর সব ক্লান্তি যেন দূর হয়ে যেত। আমাদের পড়াতে বসতেন বা কখনো ঘুরতে নিয়ে যেতেন। মাসের শেষে আর্থিক সমস্যা হলেও বাবা আমাদের কখনো তা বুঝতে দেননি। অফিসের কাজে তাঁকে দেশে-বিদেশে বিভিন্ন সময়ের জন্য থাকতে হয়েছে। তখন টেলিফোনের যুগ সেভাবে শুরু হয়নি। আর হলেও আমাদের মতো মধ্যবিত্ত পরিবারের জন্য তা ছিল ব্যয়বহুল। বাবা দেশের বাইরে গেলে আমাদের চিঠি লিখতেন। মা, দিদি বা আমি—আমাদের প্রত্যেকের জন্য ভিন্ন ভিন্ন চিঠি। যে চিঠি পরিবারের সবচেয়ে ছোট মানুষটি হয়েও তাঁর জীবনে আমাকে আমার গুরুত্ব বোঝাত। আমাদের সব আবদার পূরণ করতেন। সত্যি বলতে, আবদারের চেয়ে বেশিই করেন। অফিসের মিটিংয়ে কখনো কোনো খাবার প্যাকেট থাকলে নিজে না খেয়ে আমাদের জন্য নিয়ে আসতেন। সব ব্যস্ততার মধ্যেও যখন সাপ্তাহিক বা মাসিক বাজার করতেন, পরিবারের সবার পছন্দের কথা মাথায় রাখতেন।

কর্মব্যস্ত জীবন শেষে বাবা অবসরে যান ২০১৯ সালে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে সে বছরই আমরা মাকে হারাই। মাকে হারানোর পর বাবার দায়িত্ব যেন বেড়ে গেল আরও। নিজের দায়িত্বের পাশাপাশি বাবা আমার মায়ের দায়িত্বও পালন করতে শুরু করলেন। মায়ের রেখে যাওয়া কাজ আর অপূর্ণ ইচ্ছাগুলো পূরণ করতে লাগলেন একে একে। মাকে হারানোর পর সব আত্মীয় একে একে মুখ ফেরাতে লাগল, বাবা আমাদের আগলে রাখতে শুরু করলেন আরও শক্ত করে। আমার মায়ের খুব ইচ্ছা ছিল তাঁর সন্তানেরা উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হোক। আমি আর দিদি, আমরা দুজনেই মায়ের ইচ্ছাপূরণের পথে ছুটতে শুরু করলাম। বাবার সমর্থন না থাকলে যা কখনোই সম্ভব হতো না। স্বপ্নগুলো হয়তো স্বপ্নই থেকে যেত।

আমি এখন দেশের বাইরে। বাবা ঢাকার বাড়িতে মায়ের স্মৃতি আগলে আছেন। একা থাকেন, কিন্তু তারপরেও তাঁর একাকিত্ব দূর করতে আমাদের পথে কখনো বাধা হননি। সরকারি মারপ্যাঁচে বাবাসহ তাঁর সহকর্মীদের পেনশন আটকে আছে বেশ কয়েক মাস হলো। বাবা এসব নিয়ে দুশ্চিন্তা করেন, আমি বুঝতে পারি। কিন্তু সে দুশ্চিন্তার ভাগ কখনো আমাদের দিতে চাননি। এখনো, এই বয়সেও তিনি একাই সব সমস্যা মোকাবেলা করেন।

ছোটবেলায় যখনই কোনো সমস্যা হতো, ছুটে যেতাম বাবার কাছে। বুঝতাম, এই মানুষটার কাছে পৃথিবীর সব সমস্যার সমাধান আছে। যেন একজন সত্যিকারের ম্যাজিশিয়ান! সত্যিকারের একজন নায়ক! আমার অপারগতা, আমি বাবাকে আমার ভালোবাসার কথা কখনো জানাতে পারিনি। বাবাকে নিয়ে লেখা আমার এই খোলা চিঠিতে বলতে চাই, তোমাকে অনেক ভালোবাসি, বাবা

লেখক: দিব্যজ্যোতি দত্ত, পিএইচডি স্কলার, এসআরএম ইউনিভার্সিটি, অন্ধ্র প্রদেশ, ভারত

* দূর পরবাসে ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]