মেক্সিকোতে প্রথম দিন
আশা করছি স্মৃতি থেকে সব মুছে যাওয়ার আগেই কিছু লিখে ফেলি। এই যে মাত্র চার দিন ধরে মেক্সিকো শহরে চার বোন আর বোনজামাই মঞ্জুর মিলে লাগামহীন আনন্দময় সময় কাটালাম, ভাবছি, সেসব কথা লিখতে পারব তো গুছিয়ে? বাধা পার হয়ে সময় বের করতে হবে আমাকে? এই যেমন দিবাগত রাত সাড়ে ১২টায় বাসায় ফিরলাম, আজ ভোরে আবার নিজেকে অফিসের সঙ্গে জুতে দিয়েছি—এভাবে রুটিন নিয়মিত। তাই তো দিন শেষে যে লিখতে বসেও বারবার ভাবছি, লেখার বিলাসিতা কি আমার সাজে?
লিখতে বসে একটা কথা বারবার মনে পড়ছে, এত বড় দুনিয়ার কত কিছু না দেখেই তো চলে যেতে হবে, তাই না? তাহলে যে সামান্যটুকু দেখলাম, সে টুকুই বলে যাই। অন্তত আমার চোখ দিয়ে হলেও একজন মানুষও তো দেখতে পারবে, জানতে পারবে দুনিয়ার কিছু রূপ, তাই না?
যেমন আমি কোনো দিন ভারতে যাইনি বা নিদেনপক্ষে কলকাতাতেও কোনো দিন যাইনি। কিন্তু সেই ক্লাস নাইন থেকে কলকাতার সাহিত্যিকদের বই পড়েছি, আর জেনেছি কত কিছু—গল্পের বই না পড়লে তো তা–ও জানতাম না। লিখতে বসলে আরও একজনের কথা নিত্য মনে রাখি। প্রিয় শিক্ষক বোরহান উদ্দিন খান জাহাঙ্গীর স্যার বলেছিলেন, ‘লুনা, লেখাটা ছাড়বেন না। কথা দিন আমাকে, লেখা ছাড়বেন না কোনো দিন। জানেন তো, সব চলে যাবে, কিন্তু লেখা থেকে যাবে।’
তেমনি বলে যেতে ইচ্ছা করছে মেক্সিকো শহরের কথা—খুব সামান্যই বলতে পারব। খুব সামান্য, মাত্র চার দিন চার রাত। সেইসঙ্গে মুঠোফোনের ক্যামেরায় তুলে রাখা স্মৃতির অ্যালবামের কিছু ছবি। গোটা একটা জীবনে মাত্র একজন মানুষকে আমরা জানতে পারি না ভালো করে, সেখানে একটা দেশের কথা চার দিনে বলব কী করে, বলো?
ডালাস বিমানবন্দর থেকে সকাল ৯টায় আমরা চার বোন আর সেজ বোনজামাই মঞ্জুর যখন মেক্সিকো শহরের বিমানবন্দরে নামি, তখন বাইরে বাংলাদেশের মতো ঝকঝকে সোনাঝরা রোদ এবং সকাল। ঘড়িতে ১২টা বাজতে ১০ মিনিট বাকি। চারদিক আলোয় ঝলমল করছে। কিন্তু এই এক পৃথিবীতে ফেব্রুয়ারি মাসেই কানাডাতে জমাট বরফ ছিল। রওনা হয়েছিলাম ফেব্রুয়ারির ২৫ তারিখ। তখনো রীতিমতো বরফের পাহাড় এবং ডালাসেও বেশ শীত শীত করছিল। কিন্তু মেক্সিকোতে নেমেই যেন সোনার কাঠি রুপার কাঠির মতো আবহাওয়া বদলে গেল। কি অবাক করে একই দুনিয়ায় ভিন্ন রূপ ধারণ করে আছে নানা দেশ, তাই না? এই পৃথিবীতেই মানুষেরও যে কত রূপ আর রং, একমাত্র ভ্রমণ করলেই সেটার রস বোঝা যায়।
মেক্সিকোতে সবচেয়ে কঠিন ছিল ভাষার সঙ্গে পাল্লা দেওয়া। অন্যান্য দেশে গিয়ে রাস্তাঘাট বা সেখানকার লোকজনের মুখে দুই–একটা ইংরেজি শব্দ শোনা যায়, কিন্তু মেক্সিকোতে আপাদমস্তক সবাই স্প্যানিশভাষী। কেউ ইংরেজি জানে না বা বলবেও না। আসলে পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি মানুষের ভাষা হচ্ছে স্প্যানিশ।
অন্যদিকে মেক্সিকো থেকে চলে আসার আগের রাতে পরিচয় হয়েছিল দুই–তিনজন বাংলাদেশির সঙ্গে, সেই গল্পে পরে ফিরব। কিন্তু সেখানেই একজন দেশি ভাই বলছিলেন, জানেন তো আপা, মেক্সিকান চিকিৎসকদেরও ইংরেজি বলতে হয় না। কারণ, তাঁরা মেক্সিকান ভাষায় লেখা ডাক্তারি বই পড়েই ডাক্তার হতে পারেন। সুতরাং, মনে রাখবেন, এই দেশে বাস করতে গেলে ভাষা শেখার কোনো বিকল্প নেই।
বিমানবন্দর থেকে বেরিয়ে ২ মার্চ আমাদের পাঁচজনের বাহিনীর অভিযান শুরু হয়েছে চার দিনের। বহু কষ্টে গুগল গুরুর ট্রান্সলেশনের সাহায্য নিয়ে আমরা উবার পেতে সক্ষম হই। উবারে আমি বাদে সবার হাতে মুঠোফোন, সবাই ইংলিশ থেকে স্প্যানিশ ভাষা শেখার জোর চেষ্টা চালাচ্ছে। আর আমার মন পড়ে আছে একটা ছিমছাম এয়ারবিএনবির দিকে, যা ভাড়া করা হয়েছে চার দিনের জন্য। সেখানে পৌঁছে যেতে চাই খুব তাড়াতাড়ি। কারণ, তুমি তো জানো আজন্ম আমার মন থাকে ঘরের কোনায়, অনেকটা কুনো ব্যাঙের মতোই।
আমাদের সঙ্গে তুমিও থাকো চার দিন। সব গল্প শুনে তবেই তোমার মুক্তি। আপাতত উবারচালকের সঙ্গে মেক্সিকোর অসাধারণ অদেখা পথে আমাদের যাত্রা শুরু হয়েছে। চলবে...