শিশুদের ‘স্বর্গে’
প্রায় এক বছর ধরে চিন্তাভাবনা, সংযোজন আর বিয়োজন নিয়ে এগিয়েছে আমাদের সফর পরিকল্পনা।
গত জুলাইয়ে বিনি ভাবি আর সানিয়াত ভাইয়া কানাডা সফরে এলে প্রথম এ নিয়ে কথা তোলে রুমা।
তারপর নিঝুম আর তানিম এলে পালে আরও বাতাস লাগে। আমাদের ট্যুর ম্যানেজারের (অঘোষিত) দায়িত্ব পরে তিয়াশা আপুর ওপর। তারপর ‘নো চিন্তা ডু ফুর্তি’ দশা। চার কাজিন মিলে ফাইনাল হয় সফর। গন্তব্য অরল্যান্ডো!
জুলাই মাসের ২১ তারিখ চড়ে বসি উড়োজাহাজে। একটানে অরল্যান্ডো বিমানবন্দরে, সেখান থেকে গাড়ি ভাড়া করে চলে যাই ডেটোনা সমুদ্রসৈকতে। অসাধারণ এক বিকেল কাটালাম, আড়াই ঘণ্টা পানিতে দাপাদাপি করে ক্লান্ত সব!
প্রথম যখন পরিকল্পনা করি, তখন ইচ্ছা ছিল দুই সপ্তাহের জন্য যাব; কিন্তু রুমার নতুন চাকরির কারণে এত বড় ছুটি নেওয়া সম্ভব নয়। তাই এক সপ্তাহের ছুটি নিতে হলো আর বদলে গেল পরিকল্পনাও। দূরের মিয়ামি সৈকতের চার ঘণ্টা প্ল্যান বদলে আমরা চলে গেলাম এক ঘণ্টা দূরের ডেটোনা সৈকতে। মনে হলো যেন ছোট কক্সবাজার! রুমা আর আমি ফিরে গেলাম আমাদের প্রথম সমুদ্রসৈকত অভিজ্ঞতায়। কত আগের মনে হলেও মাঝেমধ্যে মনে হয়, এই তো সেদিনের কথা। সময়ের পরিক্রমায় আমাদের কোলে এসেছে জাহিন, জারাহ আর সর্বশেষে জুনাইরাহ। আমরা ঋদ্ধ হয়েছি প্রতিনিয়ত।
ছোট্ট ছোট্ট ঢেউ...জাহিন আর জারাহর আনন্দ দেখে কে। জুনাইরাহ এর লবণ পানির অভিজ্ঞতা এই প্রথম। সে কিছুটা আশ্চর্য আর অভিভূত। পানি পেলেই হলো আর কোনো বাহানা লাগে না, সারাক্ষণ শুধু ঝাঁপাঝাঁপি আর ঝাঁপাঝাঁপি। আড়াই ঘণ্টা থেকে আফসোস মিটল না, সূর্য হেলে পড়াতে বের হতেই হলো। শেষ বেলায় নাইকিতে গিয়ে ২০ মিনিটে হালকা শপিং।
ডেটোনা সৈকতে ঝাঁপাঝাঁপি আর ফ্লাইটের ঝক্কি কাটিয়ে সবাই ক্লান্ত শরীরে হোটেলের বিছানায় টপাটপ কাত। পরের দিন শনিবার সকালে হোটেল চেক আউট করে সরাসরি চলে গেলাম কসকোতে। পানি, গেটোরেড, চিপস, কুকিজ দিয়ে গাড়ির পেছনের ডেক ভর্তি করে ছুটলাম আকাঙ্ক্ষিত রিসোর্টে।
দুপুরে তিয়াশা আপু, সানিয়াত ভাইয়া, বিনি ভাবি, তানিম, নিঝুম আর মিকাইল, আদিয়ান, আলিফ আর তাহান চলে এল ইউনিভার্সালস এন্ডলেস সামার রিসোর্ট-ডকসাইড ইন অ্যান্ড স্যুইটস, রুম পেতে পেতে বিকেলে। ফ্রেশ হয়ে সবাই শাটল বাসে চলে গেলাম ইউনিভার্সাল স্টুডিওজ ফ্লোরিডাতে। তীব্র রোদ, আশপাশে ঘোরার মতো পরিস্থিতি নেই। নৌকা দিয়ে আশপাশের লেকপাড়ের রিসোর্ট ঘুরতে গেলাম। পোলাপান বেশ মজা পেল, বড়রাও খুশি, রোদে ঘুরতে হচ্ছে না বলে। এভাবেই শেষ হলো আমাদের রিসোর্টে প্রথম দিনের যাত্রা।
দ্বিতীয় দিন সকাল সকাল উঠে লাইনে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বেজে গেল ১০টা। ইউনিভার্সাল স্টুডিওজ ফ্লোরিডার গেটের সামনে হাজারখানেক মানুষ। রোদের তাপও মাশা আল্লাহ। তবু মানুষ দমার পাত্র নয়।
আন্ডাবাচ্চা নিয়ে সবাই হাজির, লাইনে দাঁড়িয়ে পড়লাম। ২০ মিনিট ঢোকার লাইনে থেকে টিকিট চেক করতে গিয়ে দেখা গেল আমাদের চারজনের টিকিট ভুল ছাপা হয়েছে। অগত্যা আবার গেস্ট সার্ভিসে গিয়ে টিকিট ঠিক করে আনতে আনতে আধা ঘণ্টা সাবাড়।
আধা ঘণ্টা দেরি হয়ে ভালোই হলো মনে হয়, কারণ শুরুতেই ওদের একটা রেলি দেখে ফেললাম। শিশুরা গানের তালে তালে নেচে ব্যাপক আনন্দ দিল আগত দর্শকদের। গরমে টেকা দায়, তাই চলে গেলাম ইনডোর রাইডগুলো চড়তে। মামি, ট্রান্সফরমারস, ইটি করতে করতে বেজে গেল দুপুর ১২টা। কি যে মজার এক একটা রাইড, ছোটরা তো খুশিতে বাকবাকুম। হঠাৎ আকাশ কালো করে নামল বৃষ্টি, সবাই মোটামুটি কাকভেজা! তাই হোটেলে ফিরে বিকেলে ডিজনে স্প্রিংসে যাওয়ার প্ল্যান হলো।
বিকেলে উবারে করে সবাই চলে গেলাম ডিজনি স্প্রিংয়ে। অসাধারণ আয়োজন, সারি সারি সব দোকানপাট। মানুষ দোকানে ঢুকছে আর বিরাট সব ব্যাগ নিয়ে বের হচ্ছে। আমরা এমঅ্যান্ডএম চকলেট কিনলাম, তিয়াশা আপু আমাদের সবাইকে—সানিয়াত ভাই, বিনি ভাবি, নিঝুম, তানিম আর ছোটদের আইসক্রিম খাওয়াল। তারপর উবারে করে হোটেলে ফেরা হলো। এভাবেই শেষ হলো আমাদের দ্বিতীয় দিনের সফর।
তৃতীয় দিনের বিশাল পরিকল্পনা নিয়ে আমরা লবিতে দেখা করলাম। পুরো আইল্যান্ড অব অ্যাডভেঞ্চার অ্যাট ইউনিভার্সাল স্টুডিওস অরল্যান্ড আর ইউনিভার্সাল স্টুডিওস অরল্যান্ড হ্যারি পটার দেখে ফেলার পরিকল্পনা। ম্যাচিং ম্যাচিং শার্ট আর স্কার্ট এল নিঝুম আর রুমার সৌজন্যে।
শুরুতেই আমরা সিউস পার্কে তিনটা রাইডে পটাপট উঠে গেলাম। বাইরে প্রায় ৩৮ ডিগ্রির মতো গরম, তাই ইনডোর রাইডে আমাদের আরাম আর ছোটদের বেশ আনন্দ দিচ্ছিল। দ্য ক্যাট ইন দ্য হ্যাট রাইডে ছোটরা দুবার উঠল মজা পেয়ে। কি যে সুন্দর করে বানানো রাইডগুলো ছোটদের জন্য, ভাবতেই অবাক লাগে।
তিনটা রাইড শেষ করে আমাদের গন্তব্য হ্যারি পটার-হগোর্টে। জাহিন, জারাহ, মিকাইল আর আদিয়ানের খুশি দেখে কে! প্রতিটা গলিতে গিয়ে দৌড়াদৌড়ি করে বই আর মুভির সিনগুলো ফিল করার চেষ্টা করছিল যেন ওরা। হাজার হাজার মানুষ এলোমেলো হয়ে চারদিক ঘুরছে, সবাই যে যার মতো আস্বাদনে ব্যস্ত যেন। ঘণ্টা দুয়েক থাকলাম আমরা।
দুপুর হয়ে গেল, সবার পেটে ক্ষুধা। একটা বাঙালি বাফেট রেস্টুরেন্ট আছে আহমেদ ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্ট ওবিটি। এই কয় দিন পিৎজা, চিপস, শর্মা আর স্যান্ডউইচ খেয়ে ছিল সবাই, বাফেটে এসে গত দুই দিনের আর আগামী দুই দিনের খাবার খেয়ে ফেললাম। তিয়াশা আপুর সৌজন্যে আমাদের দুপুরের খাওয়া হলো।
এত খেয়ে সবাই ভাতঘুমের জন্য পুরোপুরি তৈরি হোটেলে ফিরে ঘুমিয়ে আবার আমরা এক ঘণ্টার জন্য গেলাম পার্কে। আটটায় পার্কে ঢুকে দেখি একটু খালি, মিনিয়নের দুটো রাইড, ট্রান্সফরমার (দুবার) করতে করতে টাইম আপ। তিয়াশা আপু, সানি ভাইয়া, বিনি ভাবি, নিঝুম আর তানিম মিলে ফটোসেশনও হলো পার্কের বাইরে। এভাবেই শেষ হলো আমাদের তৃতীয় দিনের সফর।
চতুর্থ দিনে আমাদের গন্তব্য ইউনিভার্সালস ভোলকেন বে ওয়াটার পার্ক। ছোটরা পানি পছন্দ করে, আর এ যেন পানির রাজ্য। সারা দিন পানিতে থাকা আর পানির মধ্যেই সব রাইড। পুরোটাই আর্টিফিশিয়াল, কিন্তু প্রকৃতির সবুজ দিয়ে সবই সাজানো-গোছানো।
আমরা সকাল সকাল চলে গেলাম পার্কে। জাহিন, জারাহ, মিকাইল, আদিয়ান, আলিফ, জুনাইরাহ প্রায় পুরোটা সময় ছিল পানিতে। ‘বীরপুরুষ’ তাহান প্রথমে পাড়ে থাকলেও শেষ পর্যন্ত নেমেছে পানি। নিঝুমকে ধন্যবাদ আমাদের সব ছবি তুলে দেওয়ার জন্য। তানিমকে ধন্যবাদ এক বিশেষ কারণে। তিয়া আপুকে আমরা খুঁজে পাচ্ছিলাম না অনেকটা সময়। প্রায় চারটে পর্যন্ত ছিলাম সবাই। পানিতে ঝাঁপাঝাঁপি করে ক্লোরিন পানিতে সবাই ‘ট্যান’ পেয়ে গেলাম ফ্রিতে। রাতে বিনি ভাবি আর সানিয়াত ভাই আমাদের মজার আইসক্রিম খাওয়াল। সে কি স্বাদ।
পঞ্চম দিন ছিল আমাদের রিজার্ভ ডে! মানে ইউনিভার্সাল স্টুডিও ফ্লোরিডা আর আইল্যান্ড অব অ্যাডভেঞ্চার অ্যাট ইউনিভার্সাল স্টুডিও অরল্যান্ডের বাকি সব রাইড আর ভালো ভালো রাইডগুলো চড়ার প্ল্যান। দেরি করে রওনা দেওয়া হলো যেন সারা দিন পার্কে থাকা যায়। দুপুরে খাওয়ারও প্ল্যান হলো পার্কে!
ইউনিভার্সেল স্টুডিওতে ঢুকেই ব্লু ব্রাদারের লাইভ শো দেখতে বসে গেলাম। বেশ কিছুক্ষণ মন্ত্রমুগ্ধের মতো গান শুনলাম। রাস্তার অন্যদিকে দেখি সালসা নাচ চলছে, গানের মাদকতার সঙ্গে চলছে উত্তাল নাচ।
আধা ঘণ্টার মতো থেকে চলে গেলাম অন্যান্য রাইডের দিকে। চড়া হলো ফাস্ট অ্যান্ড ফিউরিয়াস রাইডে আর দেখা হলো ভয়ংকর মেকআপের কারিগরি। ফাঁকে আবার ডোরা দ্য এক্সপ্লোররের সঙ্গে ছবিও তোলা হলো।
গেলাম অ্যাডভেঞ্চার পার্কের হ্যারি পটার হগোটস অংশে। বাইরে থেকে বোঝার উপায় নেই, কিন্তু ভেতরটা এত সুন্দর। হ্যারি পটার রোলার কোস্টারে তিনবার চড়েছি, তারপরও জুনাইরাহ কাঁদতে কাঁদতে শেষ। প্রায় ঘণ্টার ওপরে থেকে আমরা Simpson রাইডে চড়ে চলে গেলাম লাঞ্চে। লাঞ্চ করে বিনি ভাবি, সানিয়াত ভাই, তিয়াশা আপু, নিঝুম আর তানিম ফেরত গেল হোটেলে।
খাওয়ার পর আরও রাইডে চড়ার ইচ্ছা থাকলেও এল বৃষ্টি। বৃষ্টিতে রইলাম আটকে, জানতাম না যে রাইড বন্ধ হয়ে যায় বৃষ্টিতে। সময় হয়ে গেল প্রায় আটটা। অগত্যা বিশ্ব বিখ্যাত ডোনাট কিনে ও খেয়ে হোটেলে ফেরা। এভাবেই শেষ হলো পঞ্চম দিনের সফর।
ষষ্ঠ দিন সকাল সকাল নিঝুম আর তানিম রওনা দিল বিমানবন্দরের দিকে। সানি ভাইয়া, বিনি ভাবি, তিয়াশা আপুর গন্তব্য ইউনিভার্সাল স্টুডিও। আর আমাদের গন্তব্য ডিজনি ম্যাজিক কিংডম। তারা সবাই এর আগে ম্যাজিক কিংডম গেলেও আমাদের যাইনি। তাই অরল্যান্ডো এসে না দেখে ফেরত গেলে আফসোস আরও বাড়বে।
তাই, উবার করে হোটেল থেকে ২০ মাইল দূরে চলে গেলাম কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যে। মেইন গেট থেকে আবার শাটল ট্রেন দিয়ে নিয়ে গেল পার্কে। পার্কে ঢুকেই দেখি স্টেজ শো। এলাহি কাণ্ড, কে নাই তাতে? মিকি, মিনি, গুফি, ডোনাল্ড ডাক, সিন্ডারেলা, রাপুন্জেল, এলসা, আনা আরও কত কে! নাচে-গানে ভরপুর এক শো আর শেষে আতশবাজি। ২০ মিনিটের শো শেষ করে প্রথমেই গেলাম ভূতের রাজ্যে ভূত দেখতে। বেশ মজার সেই রাইড।
তারপরে চলে গেলাম প্রিন্সেসদের রাজ্যে। ফেইরিল্যান্ডে থ্রি-ডি শো দেখে মুগ্ধ সবাই। সিন্ডারেলা আর এলাইনাদের সঙ্গে ছবি তোলা হলো। জুনাইরাহ তো প্রিন্সেসদের দেখে চরম খুশি। ওর কথাই শেষ হয় না তাদের সঙ্গে। ইউনি দ্য পুহ-এর রাইড চড়া হলো আর তারপর দেখি ক্ষুধায় মাথা ঘুরছে। পার্কেই ফিশ অ্যান্ড চিপস খেয়ে এনার্জি পেয়ে চলল আমাদের পরবর্তী অভিযান।
জীবনে কতই না প্যারেড দেখেছি, তবে এই রকম অসাধারণ প্যারেড জীবনে কমই দেখা হয়েছে। দুপুরে লাঞ্চ করে দাঁড়িয়েছি প্যারেড দেখতে, তপ্ত রোদে নাকাল দশা। ‘কপোল ভিজিয়া গেল সোয়েটিং-এর জলে’ অবস্থা। রাস্তার দুই পাশে বসে শয়ে শয়ে মানুষ, অপেক্ষা প্যারেডের।
মিউজিক শুরু হলো আর ছোটদের মধ্যে তৈরি হলো শিহরণ। সেই শিহরণ ছড়িয়ে গেল বড়দের মধ্যেও। সবাই যেন শিশু হয়ে গেল। কার্টুন চরিত্র সব কটি নেচে-গেয়ে হাত নাড়তে লাগল, আর সবাই অভিভূত হয়ে ওদের দেখতে লাগল। আশ্চর্য ভালো লাগার অনুভূতি।
প্রায় আধা ঘণ্টার বেশি চলা প্যারেড দেখে সবাই একদিকে আনন্দিত আর অন্যদিকে নাকাল। চলে গেলাম জাহিনের ছোট্টবেলার ফেবারিট বাজ লাইটইয়ারের রাইডে। ছবি তোলা হলো, সঙ্গে কেনা হলো খেলনা।
কার ট্রেকে জুনাইরাহ প্রথম গাড়ি চালাল। জাহিন আর জারাহ আলাদা করে গাড়ি চালাল। বেশ আনন্দের ছিল বিষয়টা। তারপর আমরা গেলাম মিনি মাউসের সঙ্গে দেখা করতে। দেখাসাক্ষাতের পর ছবিও তোলা হলো। দেখতে দেখতে বেজে গেল প্রায় আটটা। আস্তে আস্তে পার্ক ছেড়ে আসার সময় হলো। এক আশ্চর্য বিষণ্নতায় পেয়ে বসল আমাদের। আল্লাহ বাঁচিয়ে রাখলে হয়তো আবার দেখা হবে।