কাহালে আন্তর্জাতিক চিত্র প্রদর্শনী
স্বদেশেই একটি আন্তর্জাতিক চিত্র প্রদর্শনী করা কত ঝক্কিঝামেলার, সেখানে প্রবাসে এমন একটি জমজমাট প্রদর্শনীর আয়োজন করা সহজ কাজ নয়। কিন্তু স্বনামধন্য জাপানপ্রবাসী তরুণ চিত্রশিল্পী কামরুল হাসান লিপু সেই অসাধ্য সম্পাদন করে আসছেন এক দশকের বেশি সময় ধরে। এই মহৎ কাজের জন্য তাঁকে সাধুবাদ জানানো আনন্দদায়ক ব্যাপার।
১৪ জুলাই রোববার ছিল কাহাল গ্যালারি প্রতিষ্ঠানে দশম আন্তর্জাতিক চিত্র প্রদর্শনী। স্বল্পপরিসর, কিন্তু সুপরিকল্পিত এই গ্যালারির প্রতিষ্ঠাতাও শিল্পী কামরুল হাসান। জাপানে এমন উদ্যোগ দ্বিতীয় আর কোনো বিদেশি নিতে পেরেছেন বলে এখনো পর্যন্ত সংবাদ পাচ্ছি না। এখানেই বাঙালির পথিকৃৎ জয়যাত্রার একটি উজ্জ্বল অনুকরণীয় দৃষ্টান্তের প্রমাণ মেলে।
আমরা অনেকেই জানি না, এশিয়া মহাদেশে জাপান দেশটি শিল্পকলার জন্য অনন্য। এ দেশে প্রাচীনকাল থেকেই সংস্কৃতি ও শিল্পকলার যে গভীরতর প্রসার ঘটেছে, তার নজির প্রাচ্যের আর কোনো দেশে ঘটেনি। ঐতিহ্যগত ও আধুনিক শিল্পকলাচর্চার আন্দোলন জাপানে যেভাবে বিস্তৃত আকারে ঘটেছে, এমনটি এশিয়ার আর কোনো দেশে দেখা যায়নি। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জাপানের শিল্পকলা আন্দোলনের দ্বারা গভীরভাবে আন্দোলিত ও প্রভাবিত হয়েছেন। তাঁর রচিত ‘জাপানযাত্রী’ গ্রন্থে জাপানি শিল্পকলার প্রতি প্রবল অনুরাগের কথা জানা যায়। তিনি শান্তিনিকেতনে জাপানের ঐতিহ্যবাহী শিল্পকলা প্রচলন করার জন্য বিশেষভাবে আগ্রহী ছিলেন। তিনি জাপানি কয়েকজন বিশিষ্ট চিত্রশিল্পী ও দারুশিল্পীকে শান্তিনিকেতনে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। ফলে ১৯০২ সাল থেকে জাপান ও বাংলা অঞ্চলের মধ্যে বিরল এক সাংস্কৃতিক ভাববিনিময় সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং বিশ্বখ্যাত জাপানি পণ্ডিত শিল্পাচার্য ওকাকুরা তেনশিনের যৌথ প্রয়াসে। দুই অঞ্চলের অনেক শিল্পী উভয় অঞ্চলে যাতায়াত করেছেন, শিল্পকলা বিষয়ে কাজ করেছেন, প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণ করেছেন। তারই ধারাবাহিকতায় আজকের আলোচ্য প্রদর্শনীটি একটি উজ্জ্বল উদাহরণ।
এবারের প্রদর্শনীতে বাংলাদেশ ছাড়াও ভারত, নেপাল, ফ্রান্স, বেলজিয়াম, স্লোভাকিয়া, মঙ্গোলিয়া, ইংল্যান্ড ও আফ্রিকা মহাদেশের শিল্পীদের বিভিন্ন মাধ্যমে অঙ্কিত ৫৪টি বর্ণিল, বৈচিত্র্যময় চিত্রকর্ম স্থান পেয়েছে। বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধ স্মরণে বিমূর্ত চিত্র অঙ্কন করেছেন বাংলাদেশের শিল্পী ইমরুল চৌধুরী ‘দ্য জেনোসাইড ১৯৭১’ নামে। ফরাসি শিল্পী আলেক্সান্ডার বারাখার অঙ্কিত চিত্র ‘টুগেদার’ অসামান্য এক শিল্পকর্ম। ‘বিউটি অব বাংলা’ নামক বর্ণিল চিত্রটি এঁকেছেন শিল্পী কামরুল হাসান লিপু, যা একাধারে ঐতিহ্যিক ও রোমান্টিক। ‘ভিলেজ অব বাংলাদেশ’ শীর্ষক প্রাণবন্ত চিত্রটি এঁকেছেন আবদুল মান্নান, যা বাংলার চিরাচরিত রূপকে দেখার সুযোগ করে দিয়েছে। প্রায় প্রতিটি চিত্রকর্মই নিজস্ব বৈশিষ্ট্যে স্বতন্ত্র, যা নিঃসন্দেহে চিত্রকলাপ্রিয় যে কাউকে অপার আনন্দে আপ্লুত করবে।
এমন বর্ণাঢ্য প্রদর্শনীর উদ্বোধন করেন জাপানে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত শাহাবুদ্দিন আহমেদ। নিয়ম অনুযায়ী এবারও একজন বিশিষ্ট শিল্পীকে জীবনভর শিল্পকলায় অমূল্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ‘কাহাল সম্মাননা’ প্রদান করা হয়। এবার এই পুরস্কার প্রদান করা হয় বাংলাদেশের খ্যাতিমান চিত্রশিল্পী মুস্তাফা মনোয়ারকে। এ ছাড়া অংশগ্রহণকারী শিল্পীদের চিত্রকর্মকে যাচাই-বাছাই করে আটন শিল্পীকে বিশেষ পুরস্কারে ভূষিত করা হয়। তাঁরা হলেন প্রথম গ্রেন্ড অ্যাওয়ার্ড আবদুল মান্নান, দ্বিতীয় গ্রেন্ড অ্যাওয়ার্ড দিদারুল লিমন, তৃতীয় ছয়জন—যথাক্রমে প্রদীপ কুমার সাউ, মৃণাল রাজুকর, ডেনিস ওলেকজা বোগোডালিকোভা, নিয়ামুল কাদিম লোটাস, ইমন আলী ও রুমানা ইসলাম রূপা। বিচারক ছিলেন জাপানের বিশিষ্ট গ্রাফিক ডিজাইনার ও ছাপশিল্পী ফুকুজাওয়া ইকুফুমি, ফ্রান্সের শিল্পী আলেক্স ওজমোসে ব্রাখা এবং আয়োজক শিল্পী কামরুল হাসান লিপু।
প্রদর্শনীটি হয়ে উঠেছিল একটি ছোটখাটো প্রাণচঞ্চল আন্তর্জাতিক মিলনমেলা। জাপানপ্রবাসী একাধিক গণ্যমান্য ব্যক্তি উপস্থিত থেকে তরুণ শিল্পীদের উৎসাহিত করেছেন। যেমন আবদুর রহমান, মুন্সী আজাদ, রেণু আজাদ, কাজী ইনসানুল হক, বাদল চাকলাদার, চৌধুরী হোসাইন মুনির প্রমুখ। অনুষ্ঠানটি উপস্থাপনা করেন বিশিষ্ট আবৃত্তিকার, কথাসাহিত্যিক ও জাপানি টিভিনাট্যাভিনেতা জুয়েল আহ্সান কামরুল। প্রদর্শনীটি শেষ হয় ২১ জুলাই।