‘বারো রকমের মানুষ’
আমার বর্তমান যা বয়স, তাতে জীবনের গড় আয়ু হিসাব করলে বেশি অর্ধেক আমি পার করে ফেলেছি। সামনে আছে কম অর্ধেক বা আরও কম। এ নাতিদীর্ঘ জীবনে আমি বিচিত্র বিচিত্র মানুষের সন্ধান পেয়েছি, কেউ কেউ তো একদম জাদুঘরে রেখে দেওয়ার মতো, আবার পেয়েছি উল্লেখ করার মতো ভালো মানুষও, যাদের দেখলে নিজেকে অনেক ক্ষুদ্র মনে হয়। আজকের লেখাটি সব ধরনের মানুষকে নিয়ে। বিভিন্ন মানুষের স্বভাব ও আচরণ পর্যবেক্ষণ করে সময় নিয়ে লেখা।
মানুষ তার স্বভাবের দাস। স্থান কাল পাত্র যতই বদলাক, উন্নত বা অবনতি ভালো বা মন্দ যেকোনো অবস্থায় মানুষ তার চিরাচরিত স্বভাবে অটল থাকে, সে তার স্বভাব থেকে বের হতে পারে না। আগে ভাবতাম, উন্নত পরিবেশে মানুষ হয়তো বদলায়, নিজের ভেতরের ভুলগুলো অনুধাবন করে শোধরায় আর নিজের ভালো গুণগুলোর আরও প্রসার ঘটায়। কিন্তু না, সেই সংখ্যা খুবই নগণ্য বা ধরার মধ্যে পড়ে না। মানুষ তার এ স্বভাবের কারণেই কখনো নন্দিত কখনো বা নিন্দিত। ছোটবেলায় শুনে এসেছি, মানুষ বারো রকমের। আসলেই কি তাই? মানুষ হতে পারে বারো রকম বা তেরো বা সতেরো! আজকে নিজের অভিজ্ঞতার আলোকে কিছু স্বভাবগত বৈশিষ্ট্যের ওপর ভিত্তি করে বারো রকমের প্রকারভেদ করার চেষ্টা করলাম, কিছু বাদ পড়লে অবশ্যই কমেন্ট করে জানাতে অনুরোধ রইল। কারণ, আমিও মানুষ, ভুলত্রুটির ঊর্ধ্বে নই।
১.
এমন কিছু মানুষ আছেন, তাঁরা যেকোনো সময় বা পরিস্থিতিতে বিনয়ী থাকতে পারেন। অনেক গুণের অধিকারী হলেও কখনো গর্ব বা বলে বেড়ান না। নিজের মতো নিজে থাকতে পছন্দ করেন, অন্যকে ঘাঁটান না। ঝামেলা এড়িয়েই চলেন। কিন্তু কেউ খোঁচালে বিরক্ত হন মনে মনে, বারবার খোঁচানো হলে একসময় অপর পক্ষকে থামাতে রূঢ় হতেই হয় তাকে। তখন হয়তো অপর পক্ষ উচিত জবাব পেয়ে চুপসে যায় অথবা উল্টোপাল্টা ও বলে বেড়ায়, তাতে অবশ্যই এ ধরনের মানুষদের তেমন কোনো সমস্যা হয় না।
২.
কিছু মানুষ আছেন অতি চালাক, বুদ্ধিমান নয় কিন্তু। চালাক আর বুদ্ধিমানের মধ্যে পার্থক্য আছে। তাঁরা সব সময় দুই নৌকায় পা দিয়ে বেড়াবেন এবং এক নৌকার মাঝিকে অন্য নৌকার মাঝির কীর্তন ইনিয়ে বিনিয়ে শোনাবেন এবং সে খুবই ব্যথিত আপনার প্রতি বলে আপনার কাছে থেকে তথ্য সংগ্রহ করে অন্য মাঝির কাছে যাবেন একই কাজে। কিছুদিন পর দুই নৌকা থেকেই লাথি খেয়ে ডোবায় পরে কাদাপানি খাবেন। অতি চালাকি করতে গিয়ে তার যে আম-ছালা (মানসম্মান) সবই গেল, তা তার মাথার রাডার এ ঢুকবে না, ঢুকলেও স্বীকার করবে না, বরং ওই কাদাপানিতে বসেই দুই মাঝিকে গালাগালি করবেন। নিজে যে ডুবে গেছেন সেই খেয়াল নেই।
৩.
কিছু মানুষ আছেন দিন দুনিয়ার সবকিছুর ওপরে বিরক্ত। কোনো কিছুই তাদের মনমতো হয় না, পছন্দ হয় না, ভুল সবই ভুল। ফেরেশতারা নেমে এলেও বিরক্তি আর কালো মুখ নিয়েই থাকবেন। সব সময় ভ্রু কুঁচকে থাকার জন্য মধ্যে ললাট এ স্থায়ী দাগ পড়ে যায় দু–তিনটে। তাতে তাদের কোনো বিকার হয় না। উনারা হাসেন ও কপাল কুঁচকে, হাসির সময়েও বিরক্তি প্রকাশ পায়। কাজে যান বিরক্তি নিয়ে, কাজ করেন বিরক্তি নিয়ে, বাসায় ফিরেও বিরক্তি। কারও জীবনেই যে কোনো কিছুই মনমতো হয় না, তারপরও যে সবাই চলছে সেটা ইনারা বুঝতে পারেন অনেক অনেক দেরিতে কিন্তু তত দিন এ কপাল এ স্থায়ী তিন–চারটা ভাঁজ পড়ে যায় ও চেহারায় বিরক্তির।
৪.
কিছু মানুষ আছেন দরবেশ লেভেলের ভোলেভালে ভেক ধরা। কিছুই জানে না, কিছুই বুঝে না কিন্তু সানি লিওনির ভিডিও ছাড়া এদের এক দিনও চলে না। বাইরের মানুষদের জন্য জানও দিয়ে দিতে রাজি, টাকাপয়সা তো কোনো ব্যাপারই না; লাগলে শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ও দান করে দিতে রাজি। কিন্তু তবুও সবার কাছে ভালো হতে হবে, হোক না রাত কালো। দিনরাত ভালোর ভেক, বাসায় ফিরে ভাল্লুকের বেশ। তার বাড়ির মানুষেরা তার অত্যাচার এ আধমরা হয়ে বাঁচে নাকি মরে—ওপরওয়ালা ভালো জানেন কিন্তু এরা একদম এমনি থাকেন, লাগ ভেলকি লাগ দেখিয়ে কিছু বেকুবদেরও পটিয়ে ফেলেন।
৫.
কিছু মানুষ আছেন, তারা জন্মেছেন অন্যের ভুল ধরতে, অন্যের ভুল ধরার আগে তার সেটা নিয়ে কথা বলার বা ধরার যোগ্যতা তার আছে কি না, তা নিজেরাও জানে না, জানার চেষ্টা করে না। অন্যের যত রকমের ভুল আছে, তাদের মুখস্থ কিন্তু তাকে যদি বলেন আপনার নিজের কোনো দোষ বা ভুল কি নেই! খুঁজে দেখেন তো? উনারা একদম আকাশ থেকে পড়বেন, তাদের ভুল হয় কেমনে? তারা তো সদ্য ভূমিষ্ঠ শিশু, এক্ষুনি ওয়া ওয়া করে কান্না শুরু করবেন। তারা শুধুই উপদেশ আর পরামর্শ দিবেন, সর্বজ্ঞানী কি না। ভুল সবই ভুল, এদের জীবনের পাতায় পাতায় যা লেখা সব ভুল।
৬.
কিছু মানুষ আছেন, সব সময়ই হীনম্মন্যতায় ভোগেন, সবকিছু নিয়ে। সে চায় সবাই তাকে সম্মান করুক, কিন্তু নিজে কাউকেই সম্মান দিতে চায় না। অপরকে তুচ্ছ–তাচ্ছিল্য করে কথা বলে, হতে চায় নেতা গোছের কিছু, সারা জীবনের শিক্ষাগত যোগ্যতা অতি হাস্যকরভাবে নিজের আকিকা দিয়ে রাখা নামের সামনে বসিয়ে দেয়! প্রায়ই নিজের বংশমর্যাদা নিয়েও ঢাকঢোল পেটায়, জীবনে কাউকে দুই টাকার খাওয়ালে তিন টাকা খরচ করে সেটার প্রচার করে। প্রচণ্ড মাত্রায় বৈষয়িক এবং হিংসা। কারও ভালো সহ্য হয় না। এসবই ওই যে হীনম্মন্যতা! সেখান থেকেই শুরু...এর শেষ কোথায় কেউ জানে না...লোক দেখানো ভাবসাব চলতে থাকে; ভাবে, তা–ও যদি কেউ দাম দেয়! মাঝখান থেকে যেটুকু সম্মানের যোগ্য ছিল, সেটাও হারায়।
৭.
কিছু মানুষ আছেন অসম্ভব কর্মঠ, কথা কম কাজ বেশি, নিজের পরিধি এবং সীমারেখা জানেন, তাই কাজের মধ্যেই ব্যস্ত থাকেন, অসামাজিক হন না, আবার ঢলে পড়ে গলেও যান না। যেকোনো পরিস্থিতিতে উপস্থিত বুদ্ধি খাটিয়ে সাবলীল থাকার চেষ্টা করেন, কেউ খেপালে তেমন একটা খেপেও যান না। কারণ, জীবনবোধ সম্পর্কে ধারণা আছে। মনের ভেতরে রসবোধ প্রবল কিন্তু বাইরে প্রকাশ কম। এ ধরনের মানুষ সমাজের ইদানীং বিরল কিন্তু আছেন, দেখার চোখ থাকলে খুঁজে পাওয়া যায়।
৮.
কিছু মানুষ আছেন চরম পর্যায়ের স্বার্থপর, দিন–দুনিয়া উল্টে গেলেও এরা নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত, নিজেকে ছাড়া এ দুনিয়ায় যে আরও মানুষ আছে, এটা তারা ভাবতেই পারে না। কেয়ামত শুরু হয়ে গেলেও এরা নিজেদের নিয়ে নিমগ্ন থাকবে কোনো সন্দেহ নেই, আজরাইল এসে দাঁড়ালেও এরা সময় চেয়ে নেবে একটা হাসিমুখের সেলফি তোলার জন্য, মরার আগে কেমন চেহারা হলো দেখতে চায়! এরা আপনার সরাসরি কোনো ক্ষতি করবে না কিন্তু স্বার্থে আঘাত লাগলে সর্বনাশ। এ ধরনের মানুষ থেকে যত দূরে থাকা যায়, তত মনের জন্য ভালো। কারণ, মানবতার এত চরম অবক্ষয় বেশিক্ষণ কাছে থেকে সহ্য করা যায় না।
৯.
কিছু কিছু মানুষ আছে, সারাক্ষণ কথা বলে, কথা বলতে না পারলে এরা মরে যাবে, কোথায় শুরু কোথায় শেষ, তারা নিজেরাও জানে না, বলতেই থাকে, বলতেই থাকে, বলতেই থাকে...এদের কথার জ্বালায় কেউ কোনো কথাই বলতে পারে না।
এরাই সব বলবে, বাকিরা কিছু জানে নাকি যে বলবে? খালি তারাই সব জানে, তারাই সব বলবে...থামলে তো অন্যরা বলবে! তবে এরা মানুষ হিসেবে খারাপ হয় না, খারাপ হওয়ার সময় কই? কথাই তো শেষ হয় না...
১০.
কিছু মানুষ আছেন জগৎ অলস। মনে মনে চিন্তা করে, আইনস্টাইনের থিওরিও মিলিয়ে ফেলেন, কিন্তু বাস্তবে একটা পা–ও কম্বল থেকে বের করেন না, একটি কলম ও হাতে ধরবেন না কিন্তু বিদ্যাসাগর। তবে বিদ্যার কোনো প্রসার নেই এটা ইচ্ছেকৃত দেরি বা অদক্ষতা নয় কিন্তু, সবার মূলে ওই যে ‘অলসতা’। একটা জীবন এদের ভাবতে ভাবতেই গেল। নড়াচড়া করতে খুবই কষ্ট, যদি নোবেল প্রাইজ পেয়ে যান! হায় হায় তখন তো আবার আনতে যেতে হবে...,ধুর ছাই, তার চেয়ে ঝিমানো ভালো।
১১.
কিছু মানুষ আছেন এ জগতে, আবার নেই। উনাদের শরীর আছেন কিন্তু মন নেই। মনের ঠিকানা কোথায় কেউ জানে না। উনি নিজেও জানেন না। কখনো ধ্যান এ থাকেন, কখনো আকাশে ভাসেন, কখনো জিন–পরির রাজ্যে, কখনো কল্পনার সপ্তম স্তরে। অনেক বন্ধুর সঙ্গে আড্ডায় বসে আছেন কিন্তু উনি সেখানে নেই, অন্যলোকে, ভুলোকে, দুলোকে, ছায়াপথে খালি পৃথিবীতে নেই। এত দিবাস্বপ্ন দেখেন যে আসল স্বপ্ন দেখার সময় নেই। ভাবের জগৎ থেকে পিঁপড়ের কামড় খেয়ে ধরাধামে জ্ঞান ফিরলেও মুচকি হাসি দিয়ে আবার ভাবতে বসে যান। ইনারা প্রেমিক পুরুষ/নারী। জগতের সবার সাথেই এদের প্রেম হয়, মনে মনে ফ্যান্টাসিতে প্রেমিক/প্রেমিকাকে নিয়ে ঘুরতে থাকেন, গল্প করতে থাকেন, হাসতে থাকেন খালি বাস্তব জীবনে বউ/স্বামীর জন্য এদের কোনো সময় নেই। (যত দ্রুত সম্ভব মনোরোগের চিকিৎসক দেখানো প্রয়োজন )
১২.
ইদানীং কিছু মানুষ দেখা যায়, যারা ধর্ম, রাষ্ট্র, সমাজকে পুঁজি করে চলেন। সস্তা জনপ্রিয়তার আশায় বিভিন্ন জনবহুল জায়গায়, ফেসবুকে তারা নিজ ধর্মের দোষ ধরবেন, কোনো ধর্ম সম্পর্কে সুগভীর জ্ঞান নেই কিন্তু সংখ্যালঘু, মৌলবাদ, নারীবাদ, ধর্মান্ধ—এসব শব্দের বহুল ব্যবহার করে ব্লগ লিখবেন, যেকোনো বিতর্কিত বিষয়কে আরও বিতর্কিত করতে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে রং চড়িয়ে বিশাল স্ট্যাটাস লিখবেন। এরা দ্রুত টিকটিকির মতো রং বদলায় প্রায়শই নতুন রঙের আবির্ভাব ঘটে। কিন্তু ব্যক্তিগত জীবনে নীতিহীন, প্রায়ই দেশপ্রেমের ভরং ধরে, দেশী পণ্যের জন্য মুখে ফেনা তুলে বিদেশি পণ্য ও সুযোগ–সুবিধা সুদে–আসলে আদায় করে দাঁত কেলানো হাসির ছবি একটার পর একটা পোস্ট করতে থাকেন। আমার জীবনে দেখা সর্বনিকৃষ্ট মানুষ এরা, এদের জন্য চিড়িয়াখানায় ঘর বরাদ্দ সময়ের দাবি। এরা সুস্থ সমাজের পরিপন্থী।
অনেক দূর থেকে দেখা পদ্ম ফুলটি পানি থেকে তুলে এনে কাছে থেকে দেখতে তেমন একটা ভালো লাগে না, তেমনি অনেক দূর থেকে দেখা মানুষও কাছে এলে তাকে আর তেমন আর ভালো লাগে না, তখন তার ভেতরের কদর্যতা, স্বার্থপরতা আর লোকদেখানো চাটুকারিতা বিষের ফলার মতো লাগে। তাই কিছু মানুষ দূরে থাকাই সবার জন্য মঙ্গল। মনের শান্তি বড় শান্তি।
আমি বিশ্বাস করি, মানবিক বোধসম্পন্ন ভালো মানুষের সাহচর্যে থাকতে পারাটাও আশীর্বাদ। কারণ, আপনি উনার কাছ থেকে অন্তত খারাপ কিছু শিখবেন না, যা আপনার মনকে বিষণ্ণ করে দেবে বরং ভালো কিছুই শিখবেন। এ জন্যই গুরুজনেরা বলেছেন, ‘সৎ সঙ্গে স্বর্গবাস, অসৎ সঙ্গে সর্বনাশ।’
*লেখক: শায়লা জাবীন, মেলবোর্ন, অস্ট্রেলিয়া