কবির কৃতজ্ঞতা তাঁদের কাছে
‘তবক দেওয়া পানের কবি’ চলে গেলেন। তাঁকে ঘিরে একটি পর্যবেক্ষণ তুলে ধরছি। শুরু হোক এভাবে। পেরিয়ে এসেছি বেশ কিছু সময়। মেলবোর্নের সাহিত্যপ্রেমীদের অতিথি হয়ে বাংলাদেশ থেকে কবি আসাদ চৌধুরী এসেছিলেন ২০১৭ সালে। কবির সহধর্মিণীও সঙ্গে ছিলেন। আমাদের সদানন্দে ভরপুর সাদামাটা জীবন ও কবির মতো সহজ-সরল আপনজনকে পেয়ে সে আনন্দ দ্বিগুণ হয়ে উঠল। আসাদ চৌধুরী ও কবির সহধর্মিণী শাহানা চৌধুরীর স্বল্পকালীন অবস্থানের দিনগুলো নানা আনুষ্ঠানিকতায় হয়ে উঠেছিল ব্যঞ্জনময়।
তখন পবিত্র রমজানের শুরু। প্রথম দিন শেষ রাতে সেহ্রি খাওয়ার জন্য উঠে অবাক! খাবার টেবিলের ওই দিক থেকে ক্ষীণ আলো দেখা যাচ্ছে। চমকে গেলাম। আমার শঙ্কা হলো। কী হলো, আলো কেন? রাত তখন সাড়ে তিনটা। ধীর পায়ে ঘরে ঢুকে দেখি, কবি জেগে আছেন। তাঁর পানের সরঞ্জাম ও ছোট্ট একটি নোট বই খুলে বসে আছেন।
কবির স্বল্পকালীন অবস্থানের সময়ে শাহানা চৌধুরী ও আমার শেষ রাতের খাবার খাওয়ার পরও ওই টেবিলেই গল্পগুজবে সকাল ৯-১০টা বেজে যেত। আসাদ চৌধুরী কথা বলেন অত্যন্ত আকর্ষণীয়ভাবে। তথ্যেঋদ্ধে একজন মানুষ। তাঁর ছোট্ট নোট বই থেকে মুনীর চৌধুরীর একটি উক্তি পড়ে শোনালেন। বুঝে গেলাম, ওই নোট বই সাধারণ নয়, কবির রত্নভান্ডার।
আমার পর্যবেক্ষণে গল্প ও উপন্যাস লেখক ও কবির মধ্যে সূক্ষ্ম এক পার্থক্য ধরা পড়েছে। কবি হঠাৎই পারিপার্শ্বিকতা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে কেমন যেন এক ঘোরে ডুবে যান। এমনই এক রমজানের সকালে সেহ্রি-পরবর্তী গল্প চলছে। টেলিফোন বাজল। ক্যানবেরা থেকে বাংলাদেশ হাইকমিশন কবিকে দাওয়াত দিল। মেলবোর্ন থেকে কবি ব্যক্তিগত ভ্রমণে ক্যানবেরা যাবেন, এমনই কথা ছিল।
হাইকমিশনের দাওয়াত শুনে আমি বলে উঠলাম, বাংলাদেশি আমলারাও কবি-সাহিত্যিকদের খুব পছন্দ করেন। দেখুন না, হাইকমিশনার সাহেবও কবির বিষয়ে আগ্রহী।
কবি আবেগঘন গলায় বললেন, দেশটা স্বাধীন তো, তাই আজ বাংলাভাষা, বাংলাসাহিত্য সম্মানিত, আদৃত!
দেশ-ভাষা সবকিছুর নিরিখে নিজের অস্তিত্বকে মিশিয়ে দেখার অপূর্ব এক আখ্যান।
একটু চুপ থেকে কবি আচমকা সেই ঘোরে তলিয়ে গেলেন। এরপর দ্রুতই ঘোর কাটিয়ে বুক ভরে শ্বাস নিয়ে বললেন, ‘এর জন্য কৃতজ্ঞ বঙ্গবন্ধুর কাছে। কৃতজ্ঞ বীর মুক্তিসেনার কাছে।’
কথাটা ছোট্ট, তবে অন্তরের অন্তস্তলে কাঁপন জাগাল!