চীন ভ্রমণ, ‘খোয়াইজ্যা’ ও ‘জাই জিয়্যান’

ছবি: সংগৃহীত

প্রত্যেক মানুষের জীবনে একটা শখ থাকে। ঠিক তেমনি ছোটবেলা থেকেই আমার শখ ছিল পৃথিবী ঘুরে দেখার। কিন্তু সেটা ছিল অবাস্তব চিন্তা। কারণ, আমার অর্থনৈতিক অবস্থা তেমন ভালো ছিল না। তা ছাড়া এমন একটা দেশে জন্ম নিয়েছি, এই দেশের সবুজ পাসপোর্টের তেমন কোনো মূল্যই নেই। কোনো দেশের ইমিগ্রেশনে গেলে অনেক প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়, যা খুবই দুঃখজনক।

আমি নাছোড়বান্দা। সব বাধা দূরে ঠেলে অনেকগুলো দেশ ভ্রমণের সুযোগ পেয়েছি। তবে পদে পদে বাধার সম্মুখীন হয়েছি। সবচেয়ে বড় যে সমস্যা তা হলো ভাষাগত। তবে আমার ইংরেজি জানা থাকার দরুন কোথাও কোথাও বাধা অতিক্রম করতে পেরেছি। আমার একটা অভ্যাস হলো, কারও বশ্যতা স্বীকার না করা। যা করেছি, তার সবই নিজের যোগ্যতাবলে করে গেছি, কারও শরণাপন্ন হইনি। ১৯৯৪ সাল লেখাপড়ার পাট চুকিয়ে প্রথম গন্তব্য হলো ব্রিটিশের শাসনাধীন ছোট্ট রাষ্ট্র হংকং। (হংকং ১৯৯৭ সালের চীনের অধীনে আসে)। পৃথিবীর সবচেয়ে ব্যয়বহুল নগরী ব্রিটিশরা ১০০ বছরে তিল তিল করে হংকংকে ভূস্বর্গ বানিয়ে রেখেছে, যা চোখে না দেখলে বিশ্বাস করার মতো নয়। এ যেন এক স্বপ্নপুরী। বাংলাদেশ থেকে থাই এয়ারে প্রথমে থাইল্যান্ডের রাজধানী ব্যাংককে যাই। এক দিন থেকে পরদিন সকালে আমাদের বিমান হংকংয়ের উদ্দেশে রওনা হয়।

ছবি: সংগৃহীত

জীবনের প্রথম বিদেশ, তারপর আবার হংকংয়ের মতো দেশ দেখে আমার চক্ষু চড়কগাছ, মাথা ঠিক রাখতে পারছিলাম না। সব রাস্তাঘাট এক রকম মনে হচ্ছিল। দোকানপাটগুলো এত সুসজ্জিত, যা বলার মতো নয়। লাখো বিদেশি পর্যটকের ভিড়ে নিজেকে খুব অসহায় মনে হলো।

হংকংয়ের একটি কম্পিউটার স্কুলে চাকরির ব্যবস্থা হলো। কিছুদিন কাজ করলাম। কিছু অর্থ উপার্জিত হলে আমার ভ্রমণবিলাসী মন কিছুতেই টিকছিল না। অন্য দেশ দেখার জন্য মন ছটফট করছিল। তারপর চীনে যাব চিন্তা করলাম, সেই অনুযায়ী কাজ। বিমানের টিকিট কাটলাম, গন্তব্য চীনের কুনমিং শহর। যথাসময়ে আমাদের বিমানযাত্রা শুরু হলো এবং নির্দিষ্ট সময়ে কুনমিংয়ে পৌঁছালাম।

ছবি: সংগৃহীত

চিরবসন্তের শহর কুনমিং

চীন বলতেই আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে সুন্দর কর্মপ্রিয় সুশৃঙ্খল ও ভারসাম্যপূর্ণ একটি দেশ। বর্তমান বিশ্বে যাকে অর্থনীতির দ্বিতীয় পরাশক্তি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। বর্তমান বিশ্বে চীন শুধু অর্থনীতিতেই নয়, শিক্ষা-দীক্ষাসহ বিজ্ঞানচর্চা, স্থাপত্যবিদ্যায় অনেক এগিয়ে। চীন এমন একটি দেশ, যার জনগণ শুধু আচার-আচরণেই নয়—সময়, শ্রম, সততা, নিয়মানুবর্তিতা উদারতা—সব দিক থেকেই এগিয়ে। সময়জ্ঞান আর কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে লক্ষ্যে পৌঁছানোই তাদের মূলমন্ত্র। এদের সময়জ্ঞান অবাক করে দেওয়ার মতো। কিশোর-কিশোরী, নারী-পুরুষ—সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত যে যাঁর কাজ নিয়ে ব্যস্ত। আলাদা করে তাগিদ দেওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই। একবার না হলে একাধিকবার চেষ্টা করেন, কোনো অজুহাতেই কাজটি অসম্পূর্ণ রেখে দেওয়ার মানসিকতাও তাঁদের নেই।

চীন কিন্তু মোটেই ছোট কোনো দেশ নয়। আয়তনের দিক থেকে রাশিয়া আর কানাডার পরই চীন। যুক্তরাষ্ট্র, ব্রাজিল আর অস্ট্রেলিয়ার মতো দেশগুলোও এর পেছনে। পার্শ্ববর্তী ভারত ও এশিয়ার অন্য দেশগুলোর কথা না হয় না-ই বললাম। এর প্রদেশের সংখ্যাও নেহাত কম নয়। মোট ২৩টি।

১৯৭৯ সালের আগপর্যন্ত চীনে সন্তান গ্রহণের কোনো আইনকানুন ছিল না। ১৯৭৯ সালে তারা এক পরিবার, এক সন্তান নীতি গ্রহণ করে। দীর্ঘদিন পর ২০১৬ সালের শুরুর দিকে এসে তারা এক পরিবার, দুই সন্তান নীতির প্রবর্তন করে। আজকের চীন একটি পরিকল্পিত আধুনিক, বাসযোগ্য, নান্দনিক, স্বয়ংসম্পূর্ণ, বিজ্ঞানমনস্ক দেশ।
পুরো চীনে রয়েছে বিশাল পর্যটনশিল্প। পুরোটাই এক পর্যটন এলাকা। চীনের নির্দিষ্ট করে কোথাও ঘুরতে যাওয়ার বদলে বলতে পারেন, ‘চীনে ঘুরতে যাচ্ছি’। এর সবটাই সুন্দর, তবে বিশেষ কিছু এলাকার নাম না বললেই নয়, যেমন গ্রেট ওয়াল, হুয়াং হু হ্রদ, কু-কুং মিউজিয়াম, ছিংশিহোয়াংপিং মাইয়োং (শি’আন), ডালি, (ইউনান)। চীনে যদি চিরবসন্তের নগরীতে যেতে চান এবং সারাক্ষণ বসন্তের স্বাদ নিতে চান, তো আপনাকে আসতে হবে কুনমিংয়ে। এর পাহাড়ঘেঁষা এলাকা আর চোখজুড়ানো অপরূপ সৌন্দর্য আপনাকে মুগ্ধ করবে।

কুনমিং বাংলাদেশ থেকে চীনের সবচেয়ে কাছের রাজ্যও বটে। দেশটি যেমন বড়, তার খাবারের মেনুও ততটাই বড়। বলে রাখা ভালো, খাবারগুলো সেদ্ধ অবস্থাতেই পরিবেশন করা হয়। খাবারের বৈজ্ঞানিক গুণমান ধরে রাখার যতটা চেষ্টা করা দরকার, তারা তা করে থাকে। চীনারা মোটামুটি সবই খান। তবে এটা নির্ভর করে প্রদেশগুলোর ওপর। কিছু এলাকায় মানুষ কুকুরের মাংসও তৃপ্তি করে খান। কুনমিংয়ের খাদ্যাভ্যাস অনেকটা বাংলাদেশের মতোই। মানে পোকামাকড়ের মেনু মূল মেনু থেকে কিছুটা দূরে। আপনি যেখানেই খান না কেন, আপনাকে কাঠির ব্যবহার করতে হবে। দুই কাঠিকে মানিকজোড় মনে করে দুই আঙুলে আড়াআড়ি করে চেপে ধরে খাদ্য খেতে হবে। এ কাঠির নাম ‘চপস্টিক’ চীনারা বলেন ‘খোয়াইজ্যা’।

ছবি: সংগৃহীত

এবার চীনা ভাষা সম্পর্কে বলছি। চীনে এসে মানুষ প্রথম যে সমস্যার মুখোমুখি হয় তা হলো ভাষা। এটা শিখে পড়তে পারাটা হয়তো কিছুটা সহজ, কিন্তু চায়নিজদের সঙ্গে কথা বলা আর তাঁদের কথা বোঝা বেশ কঠিন। এ ক্ষেত্রে বিদেশিদের আতঙ্ক হচ্ছে টোন। একে তো ভিনদেশি ভাষা, তারপর আবার টোন। তবে হ্যাঁ, নিয়মিত চর্চা করলে হয়তো কিছুটা উপকার পাওয়া যায়।

এখন বদলে গেছেন চীনারা। এখন তাঁরা ইংরেজিতে বেশ চটপটে। চায়নিজ মেগা সিটিগুলোতে ভাষাগত সমস্যায় এখন আর পড়তে হয় না। ওসব জায়গায় দোকান, শপিং মল আর রেস্তোরাঁ সর্বত্র ইংরেজি চলে। চীনে আসার আগে ভদ্রতার খাতিরে দুটি শব্দ শিখে রাখতে পারেন। ইংরেজি ‘হ্যালোর’ বদলে ‘নি হাও’ আর ‘গুড বাই’-এর জায়গায় ‘জাই জিয়্যান’—ব্যাস, কেল্লা ফতে। এতে শুধু যে ভদ্রতাই দেখালেন তা নয়, খানিকটা যত্নআত্তি বেশিও পেতে পারেন আপনি।

শেষ করার আগে বলব, দেশের বাইরে কোথাও ঘুরতে যেতে চাইলে পছন্দের তালিকায় চীন ওপরের দিকে রাখতে ভুলবেন না।

**দূর পরবাসে লেখা, ভ্রমণ, গল্প পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল অ্যাড্রেস dp@prothomalo.com