কানাডার প্রথম মসজিদ আল রাশিদ প্রতিষ্ঠায় নারীর ভূমিকা
কানাডার প্রথম মসজিদ হিসেবে স্বীকৃত এডমন্টনের ফোর্ট আল রাশিদ মসজিদ। কানাডার মুসলিম জনগণের অন্যতম স্বতন্ত্র পরিচয়ের প্রতীক হয়ে আছে মসজিদটি। নানা প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও মসজিদ নির্মাণের যাঁরা নিরলস অবদান রেখেছেন, তাঁদের লেবানিজ বংশোদ্ভূত নারী হিলউই হামদনের নাম প্রণিধানযোগ্য।
১৮৭১ সালের শুরুতে ইসলাম ধর্মালম্বীদের কানাডায় আসা শুরু হয়। ১৯৩০ সালের শুরু হতেই কানাডায় মুসলিম অভিবাসীরা বিশেষ করে সাস্কাচুয়ান আলবার্টা ও ব্রিটিশ কলাম্বিয়া অভিবাসীরা ধর্মীয় বিধিবিধান অনুযায়ী কানাডায় নুতন প্রজন্ম লালনপালনের বিশেষ প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন। সেই ভাবধারায় কানাডার তৎকালীন পুরুষ আধিপত্যময় সমাজ উপেক্ষা করে লেবানিজ বংশদ্ভুত মুসলিম অভিবাসী নারীকর্মী হিলউই হামদন মুসলমানদের ধর্মচর্চার ও প্রার্থনার জন্য পৃথক প্রতিষ্ঠান গঠন করার উদ্যোগে এগিয়ে আসেন। স্থানীয় কয়েকজন নারীর সমন্বয়ে তিনি ‘লোকাল মুসলিম উইমেন কাউন্সিলের’ প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব নিয়ে স্থানীয় মুসলিম আরব সম্প্রদায়কে আহ্বান জানান সংগঠনে।
হিলউই তাঁর সংগঠনের নারী সদস্য এবং মুসলিম সম্প্রদায়ের বিভিন্ন পেশাজীবী অভিবাসীদের নেতৃত্বে দেন এবং নিয়মিতভাবে প্রাসঙ্গিক বিভিন্ন আলোচনা করেন। সবাই ঐক্যবদ্ধভাবে এডমন্ডনের মেয়রের কাছে মসজিদ নির্মাণের গুরুত্বের দিক তুলে ধরেন। এ কর্মপ্রক্রিয়ায় হিলউইসহ সমভাবধারার কয়েকজন অভিবাসী নারী ও পুরুষ এডমন্টনের জেসপার সড়কের বিভিন্ন সংগঠন, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে ও ইহুদি–খ্রিষ্টান ধর্ম প্রতিষ্ঠান হতে কানাডায় মুসলিম জনগণের প্রথম মসজিদ নির্মাণের প্রয়োজনীয় অর্থ তহবিল সংগ্রহ প্রক্রিয়া শুরু করেন। হিলউই হামদন স্থানীয় বিভিন্ন সম্প্রদায় ও ধর্ম প্রতিষ্ঠানে সম্প্রদায়ের কাছে মসজিদ নির্মাণের আলোকে ধর্ম বিকাশ, কানাডায় সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি এবং এর দ্বারা সাংস্কৃতিক বহুত্ববাদ রক্ষার স্বপক্ষে মতামত গঠন এবং তহবিল সংগ্রহ করেন। তিনি এডমন্টনে মেয়রের জন ফ্রের কাছে আবেদন করেন। তাঁরা ঈদ ও রমজানের সময় নিজ উদ্যোগে স্থানীয় মুসলিম নারী ও পুরুষ স্থানীয়ভাবে আয়োজিত স্কুলে ছোট অনুষ্ঠানের মাধ্যমে ধর্মীয় অনুষ্ঠানের মধ্যপ্রাচ্যর জনপ্রিয় খাবার প্রস্তুত করে সবার মধ্যে ছড়িয়ে দিয়ে বিভিন্ন ধর্ম ভিন্ন সংষ্কৃতির প্রচার ও প্রসারের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরেন।
হিলউইয়ের দৃঢ় প্রত্যয় এবং সমমনাদের নিরলস প্রচেষ্টায় সংগৃহীত অর্থ এবং মেয়রের সার্বিক তত্ত্বাবধানে রয়েল আলেক্সান্দ্রা হাসপাতালের পাশের স্থানে জমি কেনা হয়। ১৯৩৮ সালের শুরু হয় কানাডার প্রথম মসজিদ নির্মাণের কাজ। আনুষ্ঠানিকভাবে সেই একই বছরের ১২ ডিসেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে প্রথম মসজিদ যাত্রা শুরু করে। ইসলামের পবিত্র ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্যের আবহে ঐতিহাসিক উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে এডমন্টন ও আলবার্টার মেয়র, ইংরেজি ভাষায় কোরআনের সুন্দর ব্যাখ্যার জন্য পারদর্শী দ্বিভাষিক ইমাম ব্যক্তিত্ব আবদুল্লাহ ইউসুফ আলীসহ অনেক গণ্যমান্য ব্যক্তি উপস্থিত ছিলেন। ইউক্রেনীয়-কানাডিয়ান ঠিকাদার মাইক ড্রেইথ মসজিদের স্থাপন ও নকশা করেন। তাই বিষয়টি অনেকেই ইউক্রেনের স্থাপত্যরীতির সঙ্গে এর সাদৃশ্য আছে বলে অভিহিত করেছিলেন।
সূচনালগ্ন হতেই মসজিদে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায়ের পাশাপাশি পবিত্র কোরআন পাঠ ও আরবি ভাষাশিক্ষা, জানাজার নামাজ, মেয়েদের পৃথকভাবে নামাজ আদায় এবং শরীরচর্চা, তরুণদের খেলাধুলা, ঈদের অনুষ্ঠান, ইসলামিক বিভিন্ন সাংষ্কৃতিক–সামাজিক বিষয়ে, ইসলামিক সেন্টার ও স্কুল গঠন ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয়ে প্রাধান্য দেওয়া হয়। মসজিদ নির্মাণের ফলশ্রুতিতে স্বভাবিকভাবে সমগ্র কানাডার মুসলিম অভিবাসীরা এডমন্টনে বসবাসের প্রতি আকৃষ্ট হয়। ষাটের দশকে ক্রমবর্মান মুসলিম জনগোষ্ঠীর স্থান সংকুলান হওয়ার নিরিখে একটি নুতন মসজিদ নির্মাণে প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হয়। ১৯৮২ সালের ১৬ হাজারের বেশি ইসলাম ধর্মালম্বীদের জন্য নতুন ও বৃহৎ পরিসরে নুতন আল রাশিদ পুনর্গঠিত হয়। উল্লেখ্য যে প্রথম এবং পুরাতন মসজিদ ভবনের কার্যক্রম প্রায় ১০ বছর বন্ধ ছিল। ইতিমধ্যে হাসপাতাল ও একটি স্কুল সম্প্রসারণের জন্য এডমন্ডন সিটি কর্তৃপক্ষের সিদ্বান্তে প্রথম ও পুরাতন মসজিদ ভবনটি ভেঙে ফেলার উদ্যোগ নেন। এ পরিস্থিতে কানাডার ‘এডমন্টন চ্যাপ্টার অব লোকাল মুসলিম উইমেন কাউন্সিল’এর মহিলা সদস্যরা এ স্থাপনাকে কানাডার প্রথম মসজিদ রূপে ঐতিহাসিক ও ধর্মীয় গুরুত্ব তা সংরক্ষণের তাৎপর্য উল্লেখ করে বিশেষ প্রতিবাদ জানান। এই কাউন্সিলের দায়িত্বে হিলউই হামদনের নাতনিও ছিলেন। কানাডার মুসলমান সমাজ ও ‘কানাডিয়ান কাউন্সিল অব মুসলিম উইমেন’–এর অবিরত দাবির প্রেক্ষিতে কানাডায় প্রথম মসজিদ হিসেবে নির্মিত আল রাশিদ মসজিদের পুরাতন ভবনটি ১৯৯২ সালে ঐতিহাসিক দর্শনীয় স্থান রূপে স্বীকৃতি লাভ করে এবং পুনঃস্থাপিত হয়। বর্তমানে তা সর্বসাধারণের জন্য ঐতিহাসিক দর্শনীয় স্থান রূপে ফোর্ট এডমন্টন পার্কের প্রশাসনের সার্বিক তত্ত্ববধানে আছে।
কানাডার এডমন্টনে বর্তমানে আরও কয়েকটি মসজিদ স্থাপিত হয়েছে। বহু ঘাত–প্রতিঘাত পেরিয়ে কানাডার সমাজ ও সংষ্কৃতিতে আল রাশিদ মসজিদ ঐতিহাসিকভাবে মুসলমানদের অন্যতম মূলকেন্দ্র রূপে বিবেচিত হয়। ২০১৩ সালে মসজিদ আল রাশিদ পরিদর্শনকালে কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো সংবিধান অনুসারে মুসলমান অভিবাসীদের কানাডার বহুমাত্রিক সাংস্কৃতিক আদর্শ রক্ষার্থে বিভিন্ন উদ্যোগের প্রশংসা করেন।