রাজনীতি: বাংলাদেশ ও কানাডা
বাংলাদেশে কি সবাই রাজনীতি করে? আচ্ছা বাংলাদেশে এত লোক রাজনীতি করে কেন? যার নামই শুনছি, সে–ই সরকারি দলের বিশেষ কেউ ছিলেন। এমনকি সংগীত বা অভিনয়শিল্পী, লেখক, খেলোয়াড়, নাটক–সিনেমার শিল্পী, সাংবাদিক, পুলিশ বা আর্মি, চিকিৎসক, আইনজীবী—কেউ নেই যে সরকারি দল করত না? অথচ আমরা যে কানাডায় থাকি, এ রকমভাবে রাজনীতি তো করে খুব কম লোক। ভোট দেয় কেউ অনলাইনে বা বাই পোস্টে বা অ্যাডভান্স ভোটিং ডে–তে। ভোটে কোনো কারচুপি হতেও তো দেখি না। তাহলে কি কানাডিয়ানরা রাজনৈতিকভাবে সচেতন নন?
আসলে কানাডায় রাজনীতি করা মানে এখানকার প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে এমপি বা এমপিপিরা তাঁদের নিজস্ব পেশা ছেড়ে একটা সরকারি চাকরিতে যোগ দেন মাত্র। এ দেশের প্রধানমন্ত্রী তাঁর ক্রেডিট কার্ডে এক পেনিও ব্যক্তিগত খরচ করলে তাঁর জবাবদিহি করতে হয়। কিন্তু বাংলাদেশে কেন এত মানুষের রাজনীতি করতে হয়? বাংলাদেশের রাজনৈতিক নেতাদের কেন এ রকম জবাবদিহি নেই, কেন ভোটে এত কারচুপি হয়?
বাংলাদেশে কি সরাসরি রাজনীতি না করে টিকে থাকা যায়? বাংলাদেশে আমি শিক্ষকতা করতাম। বাংলাদেশে আমি কখনোই কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত ছিলাম না। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়ে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ছিলাম। ময়মনসিংহ গার্লস ক্যাডেট কলেজের প্রভাষক হিসেবে চাকরি শুরু করি এবং পরে বিসিএসের মাধ্যমে সরকারি কলেজে যোগ দিই। বিএল কলেজে থাকা অবস্থায় ২০তম বিসিএসের মাধ্যমে আমার তথ্য ক্যাডারে, শাহবাগে পোস্টিং হয়। কিন্তু আমি অস্ট্রেলিয়ান গভর্নমেন্ট স্কলারশিপ নিয়ে টেসলে মাস্টার্স করি ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজি, সিডনি, অস্ট্রেলিয়া থেকে। এরপর জাহাঙ্গীরনগর ইউনিভার্সিটি এবং খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি বিভাগে সহকারী অধ্যাপক পদে চাকরির ইন্টারভিউ দিই। আমি দুই বিশ্ববিদ্যালয়েই চাকরি পাই এবং খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দিই। আমার স্বামী সৈয়দ আমিনুল ইসলাম বাগেরহাটের শহীদ স্মৃতি ডিগ্রি মহাবিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা প্রিন্সিপাল। তিনি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন ছাত্ররাজনীতি করতেন আর সেই সুবাদেই খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাকেও বিএনপির তকমা লাগিয়ে দেওয়া হলো। আশ্চর্যজনকভাবে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার ডিপার্টমেন্টের হেড এবং তখনকার উপাচার্য যাঁদের উভয়েরই নিয়োগ হয়েছিল বিএনপির আমলে, তাঁরা আমার প্রমোশন আটকালেন, সিন্ডিকেটে সৌদি আরবের কিং খালিদ বিশ্ববিদ্যালয়ে লিয়েন নিয়ে যাওয়ার আদেশ বাতিল করলেন। কারণ, তখন খুলনার রাজনৈতিক নেতারা আমার স্বামী সৈয়দ আমিনুল ইসলামকে তাঁদের প্রতিদ্বিন্দ্বী মনে করতেন। খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার স্বামী সৈয়দ আমিনুল ইসলামের ট্রেজারার হিসেবে নিয়োগপত্রটি এ কারণেই শেষ মুহূর্তে বাতিল করা হয়। তাঁর নিয়োগ বাতিল হলো কারণ সে বিএনপি করত—বুঝলাম এক ঘাটে দুই বাঘ পানি খেতে পারে না। কিন্তু আমার দোষটা কোথায়? আমি তো কোনো দলের রাজনীতি করিনি কখনো, আমি নিতান্তই একজন শিক্ষক। কখনো কোথাও কোনো রাজনৈতিক বক্তব্য পেশ করিনি, রাজনৈতিক পেশিশক্তিও দেখাইনি।
শুধু আমার স্বামীর ছাত্রজীবনের রাজনৈতিক পরিচয়ের কারণে আমি দুই দলের কাছ থেকেই অন্যায়-অবিচারের শিকার হয়েছি। আমার পদোন্নতি আটকে দেওয়া হয়, সিন্ডিকেটে শেষ মুহূর্তে আমার ছুটি বাতিল করা হয়। কে ছিলেন তখন খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি ডিপার্টমেন্টের হেড? আমারই সহকর্মী, যাঁর পদোন্নতির ফাইল আমি ছেড়ে দিয়েছিলাম (হেড ছুটিতে থাকায় এক দিনের অস্থায়ী হেডের দায়িত্বে ছিলাম)। ফাইল সাইন করার পরপরই বিভাগীয় প্রধান এবং স্বয়ং উপাচার্য স্যার টেলিফোনে ভীষণ বকাঝকা করলেন। ‘তুমি ওর প্রমোশনের ফাইল ছেড়ে দিলে, যেটা ঝুলে আছে অনেক দিন থেকে। তুমি জানো না ও কোন ব্লকের লোক? তোমাকে দিয়ে কিচ্ছু হবে না, তুমি শিক্ষক রাজনীতির কিছুই বোঝো না।’ এ প্রসঙ্গে কয়েক বছর আগে আমার একটি লেখা বেরিয়েছিল প্রথম আলোতে।
আমি লাল-সবুজ-নীল কোনো দলেরই ছিলাম না কোনো দিন। যাহোক বিশ্ববিদ্যালয়ের অস্বস্তিকর পরিবেশ এড়ানোর জন্য আমি আর্ন লিভ নিয়ে স্বামী ও সন্তানদের নিয়ে সৌদি আরব চলে যাই। ইচ্ছে ছিল নতুন দেশে নতুন পরিবেশে কিছুদিন চাকরি করে, নতুন অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করে, হজ্জ, ওমরাহ করে দেশে ফিরে যাব। এরপর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে আমি ছুটিতে থাকা অবস্থায় খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার চাকরিটা চলে গেল। আমি রিট করেছিলাম এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে—কিছুই হয়নি সেই আবেদনের। আমার প্রভিডেন্ট ফান্ডের টাকা আটকে আছে। আমি কি সেগুলো ফেরত পেতে পারি না? আমার বিরুদ্ধে যে অন্যায় করা হয়েছে, অ্যাট লিস্ট সেটি কি ইউনিভার্সিটি স্বীকার করবে? সবাই বলে, আমরা অকৃতজ্ঞ, দেশ থেকে সব সুযোগ–সুবিধা নিয়ে দেশ ছেড়ে চলে এসেছি, ব্রেন ড্রেন হয়—আসলে কি তাই? নাকি আমাদের দেশে থাকতে দেওয়া হয় না? আমরা আসলে দেশে থাকার যোগ্যতা রাখি না। দেশে থাকতে গেলে লেজুড়বৃত্তির রাজনীতি করতে হবে, শাসক শ্রেণির সব অন্যায়–অপরাধ মেনে নিয়ে জি হুজুর, জি হুজুর করতে হবে, আপা আপা করতে করতে নাভিশ্বাস ওঠাতে হবে, তবেই আপনি বাংলাদেশে থাকতে পারবেন। আমার ছোট ভাই অ্যাডমিন ক্যাডারে—তাঁর দীর্ঘদিনের আটকে থাকা পদোন্নতি হয়েছে গতকাল।
সৈয়দ আমিনুল ইসলামের নামে মিথ্যা হয়রানিমূলক মামলা দেওয়ার কারণে সে আজ ১৬ বছর দেশে যেতে পারেনি। সে অনেকবারই চেয়েছে দেশে গিয়ে এই মিথ্যা মামলা মোকাবিলা করতে। এখন মনে করি, এটি মহান আল্লাহ তাআলার বিশেষ নেয়ামত—সে দেশে গেলে জেলে যেতে হতে পারত, আয়নাঘরে আটকা পড়তে পারত।
আমি সারা জীবনই একজন আশাবাদী মানুষ। যেসব ছাত্রদের জীবন এবং ত্যাগ–তিতিক্ষায় আজকের শেখ হাসিনা সরকারের পতন ঘটেছে, তাঁদের প্রতি রইল আমার অশেষ কৃতজ্ঞতা। নতুন সরকার বাংলাদেশে নতুন স্বপ্নের বাস্তবায়ন ঘটাবে, এটিই আমার ঐকান্তিক কামনা। ভালো থাকুক আমার বাংলাদেশ, ভালো থাকুক আমার দেশের মানুষগুলো। ধন্যবাদ সবাইকে।
*লেখক: মাহমুদা নাসরিন, টিইএসএল সার্টিফাইড ইংলিশ টিচার অ্যান্ড অন্টারিও সার্টিফাইড সোশ্যাল সার্ভিস ওয়ার্কার
দূর পরবাসে ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]