কোরবানির ঈদ: আত্মত্যাগের উৎসব, নাকি হারিয়ে যাওয়া চেতনার আনুষ্ঠানিকতা?
পবিত্র জিলহজ মাস এলেই মুসলিম হৃদয়ে এক গভীর আলোড়ন সৃষ্টি হয়—এ যেন আত্মার গভীরতম কণ্ঠ থেকে ওঠা এক মোনাজাতের ধ্বনি। এ মাস শুধুই একটি ধর্মীয় মর্যাদার সময় নয়, বরং তা এক নীরব বিপ্লবের সূচনা—আত্মশুদ্ধির, আত্মত্যাগের ও উম্মাহর ঐক্যের এক মহান প্রশিক্ষণ। পবিত্র হজ ও কোরবানি—এই দুটি ইবাদত আমাদের শুধু ধর্মীয় অনুশাসন শেখায় না, শেখায় হৃদয়ের রাজ্য থেকে কীভাবে প্রিয়তম জিনিসটিও আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য বিসর্জন দিতে হয়; শেখায় ব্যক্তি ও সমাজজীবনে ভারসাম্য, ন্যায় ও আত্মনিয়ন্ত্রণ কীভাবে প্রতিষ্ঠিত করা যায়।
কিন্তু আজকের বাস্তবতায় আমরা যখন এই বার্তাগুলোর দিকে তাকাই, তখন প্রশ্ন জাগে—এই আত্মিক বিপ্লব কি সত্যিই আমাদের সমাজে কোনো রেখা এঁকে দিতে পেরেছে? নাকি হজ ও কোরবানি এখন কেবল স্ট্যাটাসের প্রতিযোগিতা, বাহ্যিক প্রদর্শন আর লোকদেখানো আনুষ্ঠানিকতায় সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে?
পবিত্র ঈদুল আজহার পেছনে রয়েছে সাড়াজাগানো এক ইতিহাস—ইসলামের শ্রেষ্ঠ আত্মত্যাগের অনুপম দৃষ্টান্ত। হজরত ইব্রাহিম (আ.) যখন নিজের আদরের পুত্র ইসমাইল (আ.)-কে আল্লাহর আদেশে কোরবানি দিতে প্রস্তুত হয়েছিলেন, তখন তা ছিল নিঃশর্ত আনুগত্য, হৃদয়ের গহিনতম ভয় ত্যাগ করার এক আলোকিত নজির। সেই আত্মত্যাগ আজও মুসলিম চেতনায় প্রতিফলিত হয় ‘কোরবানি’ নামে—একটি প্রতিশ্রুতি, যেখানে নিজের সবচেয়ে প্রিয় জিনিসটি আল্লাহর প্রতি ত্যাগ করার শক্তি লুকিয়ে থাকে।
কিন্তু আজ? আজ কোরবানির নাম শুনলেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে বিশাল বিশাল গরু, শোভাযাত্রায় ট্রাকবোঝাই পশু, ব্যানার-পোস্টারে মোড়ানো কৃত্রিম ভক্তি, আর লাইভ ভিডিও স্ট্রিমিং—যেখানে ‘কোরবানি’ নয়, প্রতিযোগিতা হয় ‘কে কত বেশি দেখাতে পারি’। এই কি সেই আত্মত্যাগ? এই কি তাকওয়া?
যেখানে একসময় কোরবানির কেন্দ্রে ছিল তাকওয়া—আল্লাহভীতি, আত্মত্যাগ ও বিনয়—সেখানে আজ আমরা দেখছি প্রতিযোগিতার বিষাক্ত দম্ভ। কোরবানির পশুর দাম যত বেশি, ততই যেন বাড়ে আত্মমর্যাদার মিথ্যা জৌলুশ। বহু মানুষের জন্য কোরবানি এখন হয়ে উঠেছে আল্লাহর নৈকট্য লাভের উপায় নয়, বরং নিজেদের অর্থবিত্ত প্রদর্শনের এক কৌশলী মঞ্চ। দামি পশু, জাঁকজমকপূর্ণ প্রচার, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে লাইভ ভিডিও—এসব যেন ইমান নয়, ‘ইমপ্রেশন’-এর খেলায় পরিণত হয়েছে।
কোরবানির আরেকটি মৌলিক উদ্দেশ্য ছিল সমাজের প্রান্তিক ও সুবিধাবঞ্চিত মানুষের মুখে হাসি ফোটানো। ইসলামি জীবনব্যবস্থায় কোরবানি ছিল এক সামাজিক ভারসাম্যের প্রক্রিয়া, যেখানে একজন মুসলমান তাঁর কোরবানির অংশ দিয়ে দরিদ্র মানুষের পাশে দাঁড়াতেন, তৈরি হতো এক মানবিক, ন্যায়ভিত্তিক সমাজের অবয়ব।
কিন্তু বাস্তবতা কত নির্মম! আজ অনেক গৃহে ফ্রিজে মাসব্যাপী মাংস জমে থাকে, অথচ পাড়ার গরিব শিশুটি হয়তো সেই মাংসের গন্ধটুকুই শুধু পায় দূর থেকে। কোরবানির মাধ্যমে যেখানে দরিদ্রের হক প্রতিষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল, সেখানে এখন তা রূপ নিচ্ছে বিত্তশালীদের একচ্ছত্র ভোগ ও উৎসবের পণ্যে। আমরা কি ভুলে গেছি, এই উৎসব কেবল মাংসের নয়, এটি ছিল ভালোবাসার, সহানুভূতির এবং আল্লাহর প্রতি নিঃস্বার্থ আনুগত্যের?
হজ—ইসলামে আত্মশুদ্ধির সর্বোচ্চ বিদ্যালয়। এটি কেবল একটি ভ্রমণ নয়, বরং আত্মত্যাগ, সমতা, সংযম ও আল্লাহর প্রতি নিঃশর্ত আনুগত্যের মহাপাঠ; যেখানে একজন মুসলমান সব সামাজিক পরিচয়, শ্রেণি, পেশা, এমনকি ভাষা ও সংস্কৃতির পার্থক্য ভুলে গিয়ে পরিধান করেন দুটি সাদা কাপড়—ইহরামের। এই পোশাক আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় জীবনের শেষ গন্তব্যও এমনই—সাদা কাফন, নিঃস্ব ফিরে যাওয়া।
লাখো মানুষের ভিড়ে, এক কাতারে দাঁড়িয়ে একজন হজযাত্রী শিখে যান আত্মবিলোপের চরম অভ্যাস। অহংকার সেখানে গলে যায় কাদামাটির মতো। নিজের ‘আমি’ সেখানে মিলিয়ে যায় ‘আমরা’-র ভেতর। আর এই মহা অভিজ্ঞতা একজন মানুষকে তৈরি করে এক বিনম্র, মানবিক, আত্মনিয়ন্ত্রিত জীবনের পথযাত্রার জন্য।
কিন্তু প্রশ্ন জাগে—এই হজের অভিজ্ঞতা কি সত্যিই আমাদের জীবনে রূপ নেয় চরিত্রে, ব্যবহারে, দায়িত্ববোধে? নাকি আজকের দিনে হজও হয়ে উঠছে কেবল একটি মর্যাদার উপাধি?
‘হাজি সাহেব’ টাইটেলটি এখন অনেকের জন্য যেন এক সামাজিক পুঁজি। কেউ কেউ দুর্নীতির ধুয়া ধুয়ে ফেলার জন্য কিংবা নিজেকে ‘ধর্মভীরু’ প্রমাণ করার জন্য হজকে ব্যবহার করেন আত্মবিপণনের এক হাতিয়ার হিসেবে। অথচ হজ যদি একজন মানুষকে আল্লাহভীরু, ন্যায়পরায়ণ ও দয়ারূপী না করে তোলে, তবে সেই হজ হয়তো শুধু আরাফাতের ময়দানে দাঁড়িয়ে একটি আনুষ্ঠানিকতা পালনের নামান্তর।
এ অবস্থায় আমাদের জিজ্ঞাসা করা উচিত, আজকের পৃথিবীতে হজ ও কোরবানির গভীর, নৈতিক ও আধ্যাত্মিক শিক্ষা কি আমরা অন্তরে ধারণ করছি? নাকি আমরা কেবল রীতিনীতির মোড়কে আবদ্ধ হয়ে পড়েছি, যেখানে আত্মশুদ্ধির জায়গায় প্রাধান্য পাচ্ছে সামাজিক স্ট্যাটাস, বাহ্যিকতা ও ব্যক্তিকেন্দ্রিক উদ্যাপন?
যদি আমরা দেখি তাকওয়ার স্থানে এসেছে নিছক নিয়ম রক্ষা, দরিদ্র মানুষের পাশে দাঁড়ানোর পরিবর্তে এসেছে গরিবকে ‘দান দেখানোর’ আত্মতৃপ্তি, আত্মত্যাগের জায়গায় এসেছে আত্মপ্রদর্শন আর উম্মাহর ঐক্যের জায়গা দখল করেছে বিভাজনের বিষ, তবে বুঝতে হবে, কোরবানির ছুরি শুধু পশুর ঘাড়েই চলছে না, কাটা পড়ছে আমাদের অন্তরও, জবাই হচ্ছে আমাদের চেতনা।
কোরবানির শিক্ষা এক গভীর আত্মসংযমের আহ্বান—নিজের সবচেয়ে প্রিয় বস্তু ত্যাগ করার মধ্য দিয়ে নিজেকে আল্লাহর সন্তুষ্টির পথে সমর্পিত করা। এটি এক অনুশীলন, যেখানে হৃদয় শুদ্ধ হয়, আত্মা নত হয়, আর জীবন গড়ে ওঠে তাকওয়ার ভিত্তিতে।
তেমনি হজ—এটি শুধুই একটি ধর্মীয় সফর নয়, এটি এক বিপ্লবী অনুশীলন, যেখানে অহংকার ঝরে পড়ে, শ্রেণিভেদ বিলীন হয় এবং সব মুসলমান এক সারিতে দাঁড়িয়ে শিখে যান একতার দীক্ষা। হজের শিক্ষা আমাদের শেখায়—আমি বড় নই, আমরাই বড়; আমার কিছু নেই, আল্লাহই সব।
কিন্তু এই দুই মহান ইবাদত যদি আমাদের চরিত্র, পারিবারিক বন্ধন, সমাজের ন্যায়বিচার কিংবা রাষ্ট্রের জবাবদিহিতে কোনো পরিবর্তন না আনতে পারে, তবে তা শুধু আনুষ্ঠানিকতা হয়ে রয়ে যায়, অন্তর্হিত হয় তার মহৎ উদ্দেশ্য।
এই আত্মবিশ্লেষণের মুহূর্তে আমাদের প্রতিটি হৃদয়ে প্রতিধ্বনিত হওয়া উচিত একটিই প্রশ্ন—আমরা কি সত্যিই কোরবানি দিচ্ছি, নাকি কোরবানির মূল চেতনা, আত্মত্যাগ ও আল্লাহর প্রতি বিনয়কেই জবাই করে দিচ্ছি?
আসন্ন পবিত্র ঈদুল আজহা হোক আমাদের জন্য এক অভ্যন্তরীণ জাগরণের মুহূর্ত—যেখানে আমরা পশু জবাইয়ের মাধ্যমে কেবল রীতি পালনে সীমাবদ্ধ না থেকে আত্মশুদ্ধি, মানবতা ও তাকওয়ায় উদ্বুদ্ধ হয়ে নতুন এক সমাজ নির্মাণের অঙ্গীকার করি। হজকে দেখি কেবল পবিত্র ভূমির সফর নয়, বরং আত্মা পরিশুদ্ধ করার এক বিপ্লবী সওগাত হিসেবে।
তখনই এ দুই ইবাদত কেবল ইবাদতেই সীমাবদ্ধ থাকবে না, বরং আমাদের পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রে নৈতিক আলো ছড়িয়ে দেবে শান্তি, সমতা ও ভালোবাসার আলোকবর্তিকা হয়ে।
ঈদ মোবারক—আত্মত্যাগ, তাকওয়া ও মানবতার আলোয় আলোকিত হোক প্রতিটি হৃদয়, প্রতিটি ঘর ও প্রতিটি সমাজ।
*লেখক: রহমান মৃধা, গবেষক ও লেখক