সৃজনশীল এবং সেলিব্রিটি

নিজের ঘরে বসে লিখছেন গীতিকবি রতন কাহার। ছবি: সংগৃহীত

সম্প্রতি ভারতের একটি খবর আমার মতো হাজারো মানুষের মন ছুঁয়ে নিয়েছে। খবরটি প্রধানত প্রথম আলোতে প্রকাশিত হয়েছিল। খবরটি হলো, ‘বড় লোকের বিটি লো’ গানের স্রষ্টা রতন কাহার পাচ্ছেন পদ্মশ্রী পুরস্কার। ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার এই পুরস্কার দিয়ে থাকে। বাংলাদেশের রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যাও একই পুরস্কার পাচ্ছেন।
পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম জেলার সিউড়ি গ্রামের বাসিন্দা, বর্তমানে ৮৮ বছর বয়সী রতন কাহার একজন গীতিকবি। নিজে গান রচনা করেন, নিজেই সুর দেন আর নিজেই গান। কত আর রোজগার?

ভদ্রলোক নিঃসন্দেহে একজন সৃজনশীল মানুষ। গ্রামগঞ্জে এমনি নানা দিক থেকে সৃজনশীল মানুষজন রয়েছেন, যাঁরা ততটা সচ্ছল নন। তাঁদের মোটামুটি সচ্ছলতা ফেরানো কাদের দায়িত্ব? ভদ্রলোক ৮৮ বছর পার করেছেন। সচ্ছলতার মুখ দেখেননি। তিনি সৃজনশীল কিন্তু সেলিব্রিটি হননি। জীবনের সায়াহ্নে এসে তবুও তো সৃষ্টিশীল কাজের জন্য স্বীকৃতিটুকু পেলেন এবং যে অর্থকড়ি পাবেন, তা দিয়ে পরিবার–পরিজন কিছুকাল ভালো থাকতে পারবেন।

সত্তর দশকের আগুন ঝরানো কবি দাউদ হায়দার লিখেছিলেন, ‘জন্মই আমার আজন্ম পাপ’। কেউ সোনার চামচে মধু খেয়ে পৃথিবীর আলো–বাতাসে আসে আর কেউ বুকটা পানি পান করেই জন্ম নেয়। কিন্তু মানুষমাত্রই বাঁচার মতো বাঁচতে চায়।

৩ ফেব্রুয়ারির খবর, মেটার (ফেসবুক) মালিক মার্ক জাকারবার্গের এক দিনে ৩০ বিলিয়ন ডলার সম্পদ বেড়ে গেছে। খবরটা বিস্ময়কর! স্টক মার্কেটে জাকারবার্গের যে পরিমাণ স্টক আছে, তা এক দিনে প্রতি শেয়ার ৮০ ডলার করে বেড়ে গেছে। হতেই পারে। তবে আমেরিকার ধনকুবেররা গরিব–দুঃখীদের জন্য অনেক দান করে থাকেন। বাংলাদেশেও প্রচুর কোটিপতি আছেন। তাঁদের সেদিকে মনোযোগ কম। আমাদের এ উপমহাদেশের দরিদ্র সৃজনশীল মানুষেরা গরিবই থেকে যান।

রতন কাহার এবার সেলিব্রিটি হয়ে গেলেন। তাঁর মৃত্যুর পর অন্যান্য সেলিব্রিটিদের মতো পত্রপত্রিকায় খবর বেরোবে এবং মজার কথা হলো, সেলিব্রিটিদের মৃত্যুর সংবাদ আমরা যারা বেঁচে আছি, তাঁদের মরণের কথা মনে করিয়ে দেয় বারবার।

সাধারণ মানুষের কাছে সেলিব্রিটিরা ধরা ছোঁয়ার বাইরে। কিন্তু সাধারণ মানুষ যখন জানতে পারেন, তাঁদের প্রিয় সেলিব্রিটি মারা গেছেন, তাঁরা অবশ্যই মুষড়ে পড়েন। আমার মনে আছে, এমন ঘটনা ঘটেছে যে তাঁর প্রিয় সেলিব্রিটি হঠাৎ মরে যাওয়ার খবর পেয়ে আত্মহত্যা করেছেন। এটাকেই হয়তো বলা হয় সেলিব্রিটি পাওয়ার। মাইকেল জ্যাকসনের মৃত্যুর খবরের পর প্রায় ১২ জন আত্মহত্যা করেছেন।

অনেক সেলিব্রিটিই ৯০ বছরের বেশি বেঁচে মারা গেছেন। তা–ও যেন মনে হয় আরও বেঁচে থাকলে ভালো হতো। আবার অনেকেই অল্প বয়সে মারা যান। আমার নিজের তখন খুবই খারাপ লাগে। আমি তখন খুঁজতে থাকি কেন মারা গেলেন?
যুক্তরাজ্যে সাধারণত কীভাবে অথবা কেন মারা গেল, বলা হয় না অথবা সংবাদিকেরা জানলেও লিখতে পারে না। এটাকে বলা হয় প্রাইভেসি অ্যাক্ট। হয়তো কিছুদিন পর জানা যায়।

আমি যখন খবরে পড়ি একজন সেলিব্রিটি মাত্র ৩০ বছরে মারা গেছেন। আমার স্বগতোক্তি, আহা রে! এই যেমন বাংলাদেশের হোমায়ারা হিমু মাত্র ৩৭ বছরে মারা গেলেন। তবে ৯০ বছর বয়সে মারা গেলেও দুঃখবোধ একটা রয়েই যায়। এই যেমন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, লতা মঙ্গেশকর, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়, আবদুল গাফফার চৌধুরী, দিলারা হাশেম, শর্মিলী আহমেদ, মাসুম আজিজ এবং আরও অনেকে মোটামুটি ভালো একটা বয়সেই মারা গেছেন।

সাম্প্রতিক সেলিব্রিটি হওয়া রতন কাহারের ৮৮ বছর হয়েছে। ভদ্রলোক শতবর্ষী হোক, সে কামনাই করছি।

*লেখক: জীবেন রায়, অধ্যাপক, মিসিসিপি ইউনিভার্সিটি ফর উইমেন, কলম্বাস, মিসিসিপি, যুক্তরাষ্ট্র

**দূর পরবাস-এ ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল অ্যাড্রেস [email protected]