‘শ্যানেনডোয়া জ্যালি’—যেমন দেখেছি তারে
১৭৭৬ সালে বিপ্লব ও স্বাধীনতাসংগ্রামের মধ্য দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে ব্রিটিশ উপনিবেশবাদের পতন ঘটে। পৃথিবীর মানচিত্রে যুক্তরাষ্ট্র একটি নতুন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। ওই সময় আটলান্টিকের তীরে অবস্থিত পূর্বাঞ্চলের যে ১৩টি উপনিবেশ নিয়ে প্রথম আমেরিকান ফেডারাল ইউনিয়ন গঠিত হয়, ভার্জিনিয়া তাদের অন্যতম। এ জন্য যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় পতাকায় অঙ্কিত ১৩টি স্ট্রাইপের একটি ভার্জিনিয়ার জন্য। ভার্জিনিয়ার চতুর্সীমানায় আছে উত্তরে ম্যারিল্যান্ড, পুবে আটলান্টিক মহাসাগর, দক্ষিণে টেনেসি ও উত্তর ক্যারোলাইনা এবং পশ্চিমে কেন্টাকি ও পশ্চিম ভার্জিনিয়া। ঐতিহাসিক ও ভৌগোলিক বিবেচনায় ভার্জিনিয়া যুক্তরাষ্ট্রের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গরাজ্য। ভার্জিনিয়াকে বলা হয়ে থাকে দক্ষিণের ফটক। ইংরেজিতে যাকে বলে ‘গেটওয়ে টু দ্য সাউথ’। এই অঙ্গরাজ্য ধারণ করে আছে এক বিশাল বিস্তীর্ণ সমতল ভূমি। এখানে অবশ্য ‘সমতল’ বলতে আমি শাব্দিক অর্থে ফুটবল মাঠের মতো লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড বোঝাচ্ছি না। জায়গাটার চারদিক ঘেরাও করে রেখেছে মাঝারি উচ্চতাসম্পন্ন প্রাচীন অ্যাপেলেশিয়ান পাহাড়। এই ঘেরাও করা ময়লানের নাম ‘শ্যানেনডোয়া ভ্যালী’ । শ্যানেনডোয়া ভ্যালী’ যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে একটি অনন্য তাৎপর্যপূর্ণ স্থান। প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকনের সময় ১৮৬১-৬৫-এর গৃহযুদ্ধে এখানে হয়েছে দীর্ঘ রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ। এ কথায় আসব ফিরে আবার লেখাটির শেষ দিকে।
শ্যানেনডোয়া উপত্যকার বুক চিরে উত্তর-দক্ষিণ বরাবর সোজা চলে গেছে মহাসড়ক ‘আই-একাশি’। এটা যুক্তরাষ্ট্রের একটা অতি গুরত্বপূর্ণ প্রধান মহাসড়ক। এর এক প্রান্ত টেনেসি অঙ্গরাজ্যের নক্সভিল শহর থেকে একটু পুবে এসে আই-চল্লিশের সঙ্গে মিশেছে। আরেক প্রান্ত দিয়ে শেষ হয়েছে সুদূর উত্তরে, নিউইয়র্ক অঙ্গরাজ্য ওয়াটারটাউন শহরে। এ রাস্তা দিনরাত ব্যস্ত থাকে যন্ত্রযানের কোলাহলে। ২৪ ঘণ্টা ধরে চলতে থাকে ছোট ছোট সিস্তান, মাঝারি ফ্যামিলি কার, অ্যান, মিনি জান, পিকআপ জান, এসইউভি, জিপ, বাস, ছোট ট্রাক ও রাজপথের মহারাজা দৈত্যদানবের তো গাড়ি বহনকারী আঠারো চাকার খোলা ট্রাক এবং অন্যান্য মালামাল বহনের জন্য এক ও দুই ওয়াগনের বন্ধ ট্রাক।
৭০ মাইল বেগে শ্যানেনডোয়া অ্যালির এপার থেকে ওপারে যেতে সময় লাগে প্রায় তিন ঘণ্টা। এ থেকে সহজেই বোঝা যায়, ভ্যালিটি কত বড়। গাড়ি করে এ ময়লার পাড়ি দিতে গেলে মাঝেমধ্যে চোখে পড়ে রাস্তার দুই পাশে দোকানপাট, শপিং মল, হাসপাতাল, পাকা বাড়ি, দালানকোঠা, অ্যাপার্টমেন্ট বিল্ডিং, হোটেল-মোটেল, রেস্তোরাঁ ইত্যাদি। কিছুদূর পরপর হাইওয়ে থেকে দুই দিকে ছোট ছোট পাকা সড়ক বেরিয়ে গেছে এঁকেবেঁকে মাঠ চিরে দূরে জনপদের দিকে। মহাসড়কের এক পাশে একটা ছোট্ট কলেজও আছে। নাম তার ‘ব্লু রিজ কমিউনিটি কলেজ’। সাদা, কালো, বাদামি রঙের কত ছেলেমেয়ে রমরমা করে রেখেছে এই কলেজ ক্যাম্পাস। তারা এখানে এসেছে দূরদূরান্ত থেকে লেখাপড়ার তাগিদে। অন্যসব কলেজের মতো এখানেও নিশ্চয়ই পড়তে আসে বিদেশি ছাত্রছাত্রীরাও।
চলার পথে ভ্যালির দুই পাশে যত দূর দৃষ্টি যায়, চোখে পড়ে উঁচু–নিচু জংলি সবুজ ঘাসে ঢাকা বিশাল খোলা মাঠ। কৃষকদের খামার, বনবাদাড়, ঝোপঝাড়, ছোট ছোট টিলা, গাছপালা, জঙ্গল, আর দূরে দূরে ছোট–বড় কৃষকদের বাড়ি। গ্রীষ্মকালে আই-একাশি ধরে চললে দেখা যায়, দুই পাশের খেতে সয়বিন, তুলা, তামাক, ভুট্টা, সূর্যমুখী ফুল, স্ট্রবেরি, মিষ্টিকুমড়া, তরমুজ ও আরও কত জাতের ফল–ফসলের চাষ। শীতকালে অবশ্য এর চেহারা পাল্টে যায়। চারদিকে দৃষ্টিসীমার ভেতরে ধরা পড়ে শুধু মাঠ, খোলা মাঠ, বাদামি রঙের মরা ঘাসে ঘাসে ঢাকা। অথবা দেখতে লাগবে ধবধবে সাদা বরফের চাদরে আচ্ছাদিত বিস্তীর্ণ নরম বিছানা। ভার্জিনিয়ায় ভারী বৃষ্টি খুব বেশি হয় না, তবে হালকা বারিবর্ষণ হয় বারো মাস ধরেই। পানি নামার জন্য এখানে খাল–নালা আছে অনেক, কিন্তু নদী নেই। ছোট ছোট পুকুর বা লেক আছে, কিন্তু বড় জলাধার বলতে কিছুই চোখে পড়ে না।
কোথাও দেখতে পাইনি আম, জাম আর জারুলের গাছ। দেখা যায় শুধু ওক, পাইন, ইউক্যালিপটাস, ম্যাগনোলিয়া, অগটড, আয়রনউড, সিকামোর, সিডর, ম্যাপল, হুনবিম ইত্যাদি। কোনোটার কচি পাতা, কোনোটার ঘন সবুজ ঝাঁকড়া মাথা। কোনোটা পাতাবিহীন হয়ে যেন লজ্জায় মুখ লুকাচ্ছে। কোনো বিশাল গাছ পাহাড়ের সমান উঁচু। ইগল বাসা বেঁধেছে। মানুষ থেকে নিরাপদ উচ্চতায়। ফুলের গাছও আছে বেশুমার। সোনালু ফুলের মতো হলুদ ফুল দেখেছি অনেক।
২.
ছোট–বড় ড্যাপমার্টল আছে বিবিধ রঙের লাল, সাদা, গোলাপি, বেগুনি। আরও আছে কত জাতের কত বর্ণের আংলি ঘাসফুল। গাছে গাছে কাঠবিড়ালি আর ভাগ্য ভালো থাকলে ঘাসের আড়ালে খরগোশ ও হরিণকে দৌড়াদৌড়ি করতে দেখা যায়। সাপ-বিষ্ণুও আছে। না থাকার তো কোনো কারণ নেই।
বাড়িঘর দেখে মনে হয়, কৃষকেরা সবাই সমান সচ্ছল নয়। কারও ঘরে চন্দ্রক নতুনের ঝলসানি। কারও ঘর তেমন আহামরি কিছু নয়। কারও–বা জীর্ণশীর্ণ বাসস্থান। কারও ঘর হেলে আছে শীতের বাতাসে। কারও বসতবাড়ি ঝড়ে পড়ে গেছে এই বৈশাখে। কোথাও দেখা যায় ঘরের পেছনে পড়ে আছে ভাঙা কলের লাঙল। নীরবে দাঁড়িয়ে আছে সেং ধরা অচল পুরোনো গাড়িটা। উঁচু উঁচু ঘাস আর আগাছা চারদিক থেকে উঠে এসে বন্দী করেছে গাড়িটিকে। কোথাও দেখা যায়, একটি–দুটি ঘোড়া হেঁটে হেঁটে ঘাস খায় কৃষকের আঙিনায়। কোথাও চোখে পড়ে গরুর পাল রোদমাখা দুপুরে গাছের ছায়ায় শুয়ে শুয়ে জাবর কাটছে। কোথাও–বা চোখের সামনে ভেসে ওঠে ভেড়ার দল। তারা একসঙ্গে জল খায়। বয়ে যাওয়া খালের পানিতে। সবাই চরে ফিরে যায়। রাখালের দেখা নেই। নেই যেন কারও কোনো দায়। কারও বাড়িতে বাঁধা পোষা কুকুর কারণে–অকারণে ঘেউ ঘেউ করে ওঠে। মাটিতে পড়ে থাকা মরা সাপ কিংবা পশুপাখির খোঁজে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ফেলে বড় গাছের ডালে অথবা কারও ঘরের ছাদে বসে থাকতে দেখা যায় শকুনের মতো এক জাতের বড় কালো পাখিকে।
এই শ্যানেনডোয়া ভ্যালিতে কোথাও আবার দেখেছি ঘুঘু গাছের ডালে একা একা বসে ডাকছে। নিস্তব্ধ দুপুরবেলায়। কে জানে, হয়তোবা সঙ্গীহারা হয়ে মনের দুঃখে কাঁদছে। সাথিকে খুঁজছে। আর ডালে ডালে ছটফট করছে। ছোট্ট লেকের ধারে নরম মাটিতে দাঁড়িয়ে কাদা খোঁচার মতো ছোট ছোট পাখি আর সাদা সাদা বক লম্বা ঠোঁট দিয়ে এক মনে মাছ ধরছে। আহার শেষে ভরা পেটে কেউ নীড়ে উড়ে যায় ঠোঁটে ছানার জন্য খাবার নিয়ে। কেউবা বিলে ভরা পেট নিয়ে উড়ে এসে যোগ দেয় শিকারি পাখিদের ভিড়ে। এমন দৃশ্য দেখে বাংলাদেশের হাওর-বাঁওড়ের কথা মনে না করে কি পারা যায়? আমি তো পারিনি।
দ্রুততম বেগে গাড়িতে যেতে যেতে হঠাৎ চোখে পড়ল এক কৃষকের বাড়ি। সামনে তিন কোণা ছোট্ট একটি পুকুর, জলে ভরা টইটম্বুর। যেন বরষার বাংলাদেশের কোনো গ্রামের পুকুর। পুকুরপাড়ে ফেলতে এসে ছেলেমেয়েরা ফেলে গেছে রাধারের বল। লাল লাল বল নীল পানিতে ভাসছে। পুকুরের এক কোণে। মৃদুমন্দ বাতাসে ওঠা ছোট ছোট ঢেউয়ের মাথায় যেন পাতা হয়েছে দূর থেকে দেখা মহাসাগরে ভাসমান মাইন। আরেক কোণে সাঁতার কাটছে দলছুট এক জোড়া রাজহাঁস। কে জানে, হয়তোবা সুদূর সাইবেরিয়া থেকে উড়ে এসে জুড়ে বসেছে ‘শ্যানেনডোয়া’র শান্ত পানিতে। শিরশির সমীরণ খেলা করে সারা বেলা এখানে। দিনের শেষে শ্রান্ত হয়ে আছড়ে পড়ে সবুজ পাহাড়ের গায়ে। মৌমাছি, প্রজাপতি, পাখি ওড়াউড়ি করে প্রশান্ত বাতাসে। 'শ্যানেনডোয়ার আকাশে। কী সুন্দর সবুজের সমারোহ। জংলি ফুলের পাগল করা তীব্র মধুর গন্ধ পশুপাখি ও মানবের সঙ্গে মিলেমিশে নিরিবিলি শান্তিতে অনবরত ফেলছে স্বস্তির নিশ্বাস। এখানে ‘শ্যানেনডোয়া’র নির্মল নীরব পরিবেশে। মনে হয়, বাড়ি ফিরে লাভ কী শহরের কোলাহলে। থেকে যাই এখানেই, প্রকৃতির কোলে। গড়াগড়ি করি সবুজ ঘাসের মাঠে। যেমনি খেলেছি শৈশবে, কৈশোরে। হাজার হাজার মাইল দূরে।
যখন পেছনে ফিরে তাকাই ইতিহাসের দিকে, দেখি, কী ঘটেছিল এখানে মার সেদিন। দেড় শ বছর আগে। ভাবতে অবাক লাগে। এখানে মেতেছিল তারা কী পৈশাচিক খেলায়। খেলেছিল কত দিন। মেরেছিল কত মানুষ। ঘটেছিল বীভৎস হত্যাযজ্ঞ। ধ্বংসাত্মক যুদ্ধবিগ্রহ। যুক্তরাষ্ট্রের গৃহযুদ্ধের সময়, কত খই ফুটেছিল বন্দুক আর কামানের নলে। এখানেই। এই মাঠে। কত লাশ পড়েছিল কাতারে কাতারে। কত ঘাস ভিজেছিল যুদ্ধরত সিপাহীদের ঘামে আর রক্তে। এই আকাশ, এই বাতাস কাঁপিয়ে সেদিন উঠেছিল আর্তনাদ আর কান্নার রোল। সাবধানে বাতাসে কান পাতলে আজও শোনা যায় ছেলেহারা মায়ের বুকফাটা ক্রন্দন। আহত সেনাপতির হৃদয়ের স্পন্দন। মুমূর্ষু যোদ্ধার বাঘার কাতরানি। বাতাসের ফাঁকে ফাঁকে নাক টানলে এখনো পাওয়া যায় বিষাক্ত বারুদের বমি আসা দুর্গন্ধ।
*লেখক: আবু এন এম ওয়াহিদ, অধ্যাপক, টেনেসি স্টেট ইউনিভার্সিটি, যুক্তরাষ্ট্র
**দূর পরবাসে লেখা, ভিডিও, ছবি, ভ্রমণকাহিনি, গল্প ও নানা আয়োজনের কথা পাঠান [email protected]এ