নিউইয়র্কে বাংলা বর্ষবরণের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি
জীবনে কিছু কিছু দিন আসে, যখন মানুষ কেবল নিজে বেঁচে থাকতে চায় না। সে তখন সবার হতে চায়। মনে হয়, তার জীবনের সব ভালো কাজ সব মানুষের হোক। মহৎ অর্জনের সুখ সবার অনুভববেদ্য হোক। আমার জীবনের এ রকম একটি দিন ২২ জানুয়ারি (২০২৫)। বাংলাদেশ, ভারত ও অন্য দেশ থেকে আসা বাঙালি জাতি যুক্তরাষ্ট্রে শত ফুলের মালা গেঁথেছে শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি ও সংগ্রামমুখর জীবনে। এখানে বৈচিত্র্যের মধ্যে আছে ঐক্য, সংকটের মধ্যে আছে সম্প্রীতি, বিভেদের মধ্যে আছে সহিষ্ণুতা। এ জন্য ২২ জানুয়ারি সম্মিলিত বাঙালি জীবনে আনন্দের বারতা নিয়ে এসেছে। ১৪ এপ্রিল ‘বাংলা নববর্ষ’-এর স্বীকৃতিলাভের জন্য একাধিক সিনেটরকে প্রস্তাব প্রদান এবং সিনেট সভায় উত্থাপনের নেপথ্যে কৃতিত্ব আমার হলেও অর্জনের আনন্দ সবার। মনে রাখা দরকার, বাংলাদেশের বাইরে অন্য কোনো দেশের সিনেট কিংবা রাজ্যসভায় বাঙালির উৎসবকে এভাবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি। বিরল এ ঘটনা আমাদের সবার জন্য গৌরবের।
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, স্বামী বিবেকানন্দ প্রমুখ মেধাবী বাঙালি ও খ্যাতনামা ব্যক্তিত্ব অনেক আগে থেকেই আমেরিকায় পরিচিত। উনিশ শতকের শেষের দিকে বাংলাদেশি অভিবাসীরা যুক্তরাষ্ট্রে আসতে শুরু করেন। বিদেশে বাঙালির যে মুখগুলো এখনো সমুজ্জ্বল, তাঁরা হলেন বিশ্বখ্যাত স্থপতি এফ আর খান, সেতারবাদক আলী আকবর খান, লেখক রুমানা আলম, কবি শহীদ কাদরী, সাহিত্যিক ঝুম্পা লাহিড়ী, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অবদান রাখা এনায়েতুর রহিম, বিজ্ঞানী দেবব্রত বসু, মূলধারার লেখক অমিতাভ ঘোষ, বিজ্ঞানী ইকবাল কাদির, ইউটিউবের সহপ্রতিষ্ঠাতা জাওয়াদ করিম, সারা বিশ্বের যুবসমাজকে বিনা ফিতে অঙ্ক শেখানোর সবচেয়ে জনপ্রিয় ‘খান একাডেমি’র প্রতিষ্ঠাতা ও পরিচালক সালমান খান, ইন্টেলের চেয়ারপারসন বিজ্ঞানী ওমর ইশরাক প্রমুখ। এই বিশিষ্ট ব্যক্তিরা বহু জাতিগোষ্ঠী–অধ্যুষিত যুক্তরাষ্ট্রে বাংলা ও বাঙালিদের পরিচিতিকে মহিমান্বিত করেছেন। নিউইয়র্কে বসবাসরত বাঙালিরা বিশ্বের রাজধানীখ্যাত এই সিটি তথা স্টেটে বাঙালি সংস্কৃতির ফল্গুধারা বিকাশের নিরন্তর প্রয়াস চালাচ্ছেন।
বর্তমান বাঙালিরা তিন বছর যাবৎ বাংলা বছরের প্রথম দিন পয়লা বৈশাখ ঘটা করে উদ্যাপন করছেন টাইমস স্কয়ারসহ নিউইয়র্কের বিভিন্ন স্থানে। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় পয়লা বৈশাখ বরণে এখন হাজারো নারী-পুরুষের সঙ্গে নতুন প্রজন্মের বাঙালিরাও উচ্ছ্বাসে মেতে ওঠেন। বাংলাদেশ, ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের শতাধিক সংগঠনের শিল্পী-কলাকুশলীরা হাজার বছরের ঐতিহ্যমণ্ডিত বাঙালি সংস্কৃতির জয়গান করেন। পাশাপাশি মেধা ও শ্রমের বিনিয়োগ ঘটিয়ে নিউইয়র্ক অঙ্গরাজ্য তথা যুক্তরাষ্ট্রের উন্নয়নেও বাঙালিরা অবদান রেখে চলেছেন। সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যকে আরও গৌরব ও অহংকারের সঙ্গে উদ্ভাসিত করতে নিউইয়র্ক অঙ্গরাজ্যের সিনেটর লুইস সেপুলভেদা ১৫ জানুয়ারি সিনেটে একটি প্রস্তাব উত্থাপন করেন ‘১৪ এপ্রিলকে নিউইয়র্কে বাংলা নববর্ষ’–এর স্বীকৃতি প্রদানের জন্য। ২৩৪ নম্বরের এই রেজল্যুশন ২২ জানুয়ারি সর্বসম্মতভাবে পাস হয়েছে।
অর্থাৎ আগামী ১৪ এপ্রিল ঘটা করে উদ্যাপিত হবে ‘বাংলা নববর্ষ’ এবং এ উপলক্ষে কর্মসূচি গ্রহণে আর কোনো বাধা থাকবে না। এ ধরনের একটি ঘোষণাপত্র শিগগিরই স্টেট গভর্নর ক্যাথি হোকুল বিতরণ করবেন। উল্লেখ্য, নিউইয়র্কের মুক্তধারা ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা ও সিইও হিসেবে আমি এমন একটি রেজল্যুশনের জন্য স্টেট সিনেটর লুইস সেপুলভেদাসহ একাধিক সিনেটরের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলাম এবং পাস হওয়া রেজল্যুশনেও তা উল্লেখ রয়েছে।
ওই ঘোষণায় উল্লেখ করা হয়, ১৪ এপ্রিল, অর্থাৎ বাংলা বছরের প্রথম মাসের প্রথম দিন পয়লা বৈশাখকে নিউইয়র্ক অঙ্গরাজ্যে বাংলা নববর্ষ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। এই অঙ্গরাজ্যের সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের স্বীকৃতি হিসেবে এবং এই অঙ্গরাজ্যে বসবাসরত বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে সম্প্রীতি দৃঢ় করার লক্ষ্যেই এ সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে।
বাংলা নববর্ষের ইতিহাস বর্ণনা করে এতে আরও বলা হয়, ভারতের মুঘল সাম্রাজ্যে পয়লা বৈশাখ উদ্যাপনের সূচনা হয়েছিল। বর্তমানে বাংলাদেশ ছাড়াও এশিয়ার বিভিন্ন কৃষিপ্রধান দেশে, যেমন লাওস, ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া, থাইল্যান্ডসহ ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে একই সময়ে নববর্ষ উদ্যাপিত হয়ে থাকে। বাংলা ভাষায় কথা বলেন—এমন অভিবাসীর কথা উল্লেখ করে ঘোষণায় বলা হয়, বাংলাদেশ ও পশ্চিম বাংলা থেকে আগত বিপুলসংখ্যক অভিবাসী এ রাজ্যে নানাভাবে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে যাচ্ছেন। বর্তমানে প্রতিবছর প্রায় ১০ হাজার বাংলাদেশি স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্য যুক্তরাষ্ট্রে আসছেন। তাঁদের অর্ধেকই নিউইয়র্ক অঙ্গরাজ্যের বাসিন্দা। পয়লা বৈশাখ বাঙালির জীবনে অতি গুরুত্বপূর্ণ উল্লেখ করে ঘোষণায় বলা হয়, প্রতিবছরই বিপুল সমারোহে দিনটি উদ্যাপিত হয়ে থাকে। ২০২২ সাল থেকে দিবসটি নিউইয়র্কের টাইমস স্কয়ারে উদ্যাপিত হয়ে আসছে।
লেখা বাহুল্য, টাইমস স্কয়ারে বাংলা নববর্ষ বরণের এই যাত্রায় এনআরবি ওয়াল্ড ওয়াইডির সেক্রেটারি তোফাজ্জল লিটন ও সহযাত্রী শিবলী সাদেক, সৌম্যব্রত দাসগুপ্ত, নূরুল বাতেন, কল্লোল বসু, রায়হানের কথা উল্লেখ না করলেই নয়। শিল্পী মহিতোষ তালুকদার তাপসের নেতৃত্বে টাইমস স্কয়ারে শতকণ্ঠ থেকে সহস্রকণ্ঠে হয়ে ওঠা যে কত আনন্দ ও গৌরবের, তা ভাষায় প্রকাশের নয়। নিউইয়র্কের তথা যুক্তরাষ্ট্রের সংস্কৃতিপ্রেমী বাঙালিরা একত্র হয়ে যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন, তা সারা বিশ্ব অবাক হয়ে দেখেছে। প্রতিটি শিল্পী ও সংস্কৃতিপ্রেমী বর্ষবরণ অনুষ্ঠানটিকে নিজের করে নিয়েছেন। টাইমস স্কয়ারে বাংলা নববর্ষ বরণের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণই সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি।
২০২৫ সালের বর্ষবরণ উৎসব হবে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায়। নিউইয়র্ক অঙ্গরাজের গভর্নর কার্যালয় এপ্রিলের ৭ তারিখে বাংলা নববর্ষ উদ্যাপন করবে। যেহেতু ৮ তারিখে অধিবেশন শেষ, তাই আলবিনে আয়োজিত রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে আইনপ্রণেতারা বাঙালির সর্বজনীন ও সবচেয়ে বড় এ উৎসব নিয়ে এক আলোচনায় অংশ নেবেন। সেখানে উপস্থিত থাকবেন বাংলাদেশ সরকারের রাষ্ট্রদূতসহ উচ্চপদস্থ ব্যক্তিরা। আমন্ত্রণ জানানো হবে নিউইয়র্ক শহরের সাংস্কৃতিক সংগঠনের প্রধানদের। বিষয়টি প্রত্যেক বাঙালির গর্ব বলে আমি মনে করি। বাংলা বছরের প্রথম দিনে আনন্দ আয়োজনে যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন অঙ্গরাজ্য থেকে শিল্পী ও দর্শনার্থীরা অংশগ্রহণ করেন। আবহমান বাংলার ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতি, নাচগান, যাত্রাপালা—সবকিছুই থাকে আয়োজনে। নিউইয়র্কের বর্ষবরণ উৎসব পয়লা বৈশাখের ভোরের সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে রমনার বটমূলের আদলে এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা আয়োজিত মঙ্গল শোভাযাত্রার অনুপ্রেরণায় প্রাণিত।
*লেখক: বিশ্বজিত সাহা, এনআরবি ওয়ার্ল্ড ওয়াইডের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি এবং প্রতিষ্ঠাতা ও সিইও, মুক্তধারা ফাউন্ডেশন, নিউইয়র্ক।