প্রবাসের রোজা ও ইফতার
অস্ট্রেলিয়াতে দুই ধরনের হিসাবে রোজা রাখা হয়। প্রথমত, বৈজ্ঞানিক পঞ্জিকা অনুসারে, যেদিন চাঁদের উদয় হয়, কিন্তু সেই চাঁদ বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই খালি চোখে দেখা যায় না। তাই দ্বিতীয়ত চাঁদ দেখে রোজা রাখা হয়। বাংলাদেশির বেশির ভাগই দ্বিতীয় মতের অনুসারী। কারণ, দেশে থাকতে সবাই এভাবেই রোজা ও ঈদ উদ্যাপন করেছেন। এখনো অনেকের স্মৃতিতে ছোটবেলার চাঁদ দেখার সেই স্মৃতি অনেক উজ্জ্বল। মনে হয়, এই তো সেদিনের কথা।
মনে পড়ে, আমাদের পাড়ার তেমাথায় সবাই জড়ো হতাম। কারণ, সেখান থেকে পশ্চিম দিকে তাকালে মিন্টুদের বাঁশঝাড়ের ঠিক ওপর দিয়ে চাঁদ দেখা যেত। সেখানে ধর্মবর্ণ-নির্বিশেষে সবাই হাজির হতাম। মিন্টুরা ছিল ব্রাহ্মণ। আমাদের পাড়ায় তখন মুসলমানরাই সংখ্যালঘু, বেশির ভাগই হিন্দু পরিবার। তার মধ্যে ব্রাহ্মণের পাশাপাশি ধোপা, পাল এমনকি বৈরাগীরাও ছিল। ধোপাবাড়ির কর্তার (দাদির) কাছে থাকত চন্দ্র পঞ্জিকা। কারণ, তাঁরা চন্দ্র পঞ্জিকা ধরে পূজা দিতেন। আমরা মাঝেমধ্যে গিয়ে কর্তার কাছে থেকে নিশ্চিত হয়ে আসতাম, সেদিন আসলেই চাঁদ উঠবে কি না।
কে সবার আগে চাঁদ দেখতে পারে, সেটা নিয়েও আমাদের ছোটদের মধ্যে চলত একধরনের নীরব প্রতিযোগিতা। চাঁদ দেখার পর সবাই দাবি করতাম, আমিই সবার আগে চাঁদ দেখেছি।
এরপর বড়দের আমরা দেখিয়ে দিতাম, ওই যে বাঁশপাতাগুলো দুই ভাগ হয়ে আছে, ঠিক তার মাঝখানে চাঁদ উঠেছে। হুবহু ধান কাটা কাস্তের মতো সরু সেই চাঁদের হাসি। এরপর সেই হাসি ছড়িয়ে পরত আমাদের সবার মুখে। মেঘলা আকাশ বা কোনো কারণে চাঁদ দেখা না গেলে মাগরিবের নামাজের পর আমরা হাজির হতাম আমাদের পাড়ার একমাত্র টেলিভিশনের সামনে। সালামদের বাড়ির সেই সাদাকালো ন্যাশনাল টেলিভিশনের খবরে আমাদের মনে রঙিন আনন্দের সঞ্চার হতো। টিভিতে ঘোষণা শোনার পর পাড়ার মসজিদের মাইকে আমাদের হুজুর মালেক চাচা জানিয়ে দিতেন চাঁদ দেখার খবর।
প্রবাসে এ যান্ত্রিক জীবনেও আমাদের পরিবারে চাঁদ দেখার চলটা চালু রেখেছি ছোটদের একটু বাড়তি ও প্রাকৃতিক আনন্দ দেওয়ার জন্য। আমি আগে থেকেই মেয়েকে বলে রাখি, যেন সে বিকেল থেকেই পশ্চিম আকাশে নজর রাখে। আমিও মাঝেমধ্যে অফিসের বাইরে এসে আকাশের দিকে তাকাই। যে আগে দেখে, ফোন করে সে অন্যকে জানায়। এবার অফিস থেকে ফেরার পর সন্ধ্যা হতো ডে লাইট সেভিংয়ের জন্য। আমরা তাই বাড়তি কিছুটা সময় পেতাম।
এবার বুধবার চাঁদ দেখা যাওয়ার কথা। সেদিন আকাশ মেঘলা, তাই আমরা বারবার উঁকি দিয়েও চাঁদের দেখা পাইনি। বৃহস্পতিবারও আকাশে মেঘ ছিল। কিন্তু সেদিন দেখা যাবেই। কারণ, সেদিন ছিল বৈজ্ঞানিক পঞ্জিকা অনুসারে চাঁদের দ্বিতীয় দিন। আমরা বাসা থেকে বেরিয়ে কাছের ভিক্টোরিয়া পার্কে চলে গেলাম পশ্চিম আকাশটা পুরোপুরি দেখার জন্য। সন্ধ্যার অনেক পর পর্যন্ত থেকেও চাঁদের দেখা না পেয়ে বিফল মনোরথে ফিরে এলাম। এরপর স্বপন ভাইয়ের মেসেজ থেকে জানলাম, সেদিন তারাবিহ পড়তে হবে। পরের দিন থেকে রোজা।
আমাদের বাসার খুব কাছেই অস্ট্রেলিয়ান মুসলিম ওয়েলফেয়ার সেন্টার। সেখানেই এখন প্রতি রমজান মাসে খতম তারাবিহ পড়া হয়। আমরা সব সময়ই একটু দেরি করে তারাবিহ পড়তে যাই। কারণ, অনেকেই আট রাকাত পড়ার পর বের হয়ে আসেন। আমরা যাই ওই সময়। আমার সঙ্গে প্রায়ই আমাদের সাত বছরের ছেলে রায়ান যোগ দেয়। ও অবশ্য পুরোটা পড়তে পারে না। তখন মসজিদের চেয়ারে ঘুমিয়ে পড়ে। আমি নামাজ শেষ করে ওকে জাগিয়ে নিয়ে বাসায় ফিরি। আমাদের গ্রামেও একসময় খতম তারাবিহ পড়ার চল শুরু হয়েছিল।
এক মাসের জন্য একজন হাফেজ আসতেন। গ্রামের সবাই চাঁদা দিয়ে তাঁর বেতন দেওয়া হতো। এশার নামাজের সময় সালাম আগেই এসে আমাদের ডাকাডাকি শুরু করতেন। এই তোরা এখনো অজু করিসনি? তাড়াতাড়ি আয়। আমরা দ্রুত অজু করে মসজিদের পথে পা বাড়াতাম। এরপর নামাজ শেষ করে আবারও একসঙ্গে বাসায় ফেরা। প্রবাসেও আমরা তাই হেঁটে মসজিদে যাই। কারণ, বাসা থেকে মসজিদ মাত্র ১০ মিনিটের হাঁটাপথ। নামাজে অনেকের সঙ্গেই দেখা হয়ে যায়। কাছাকাছি থাকা সত্ত্বেও নাগরিক ব্যস্ততার কারণে যাদের সঙ্গে বহুদিন দেখা হয় না, তারাও সন্তানদের নিয়ে আসে। ফলে মসজিদের সামনের খোলা জায়গাটা শিশুদের মিলনমেলায় পরিণত হয়।
সাহ্রি ও ইফতারের সময় দেশের কথা সবচেয়ে বেশি মনে পড়ে। কারণ, এখানে আজান দেওয়ার চল নেই। দেশে আমাদের পাড়ার মাতব্বর মন্টু চাচার নেতৃত্বে সারা পাড়ার মানুষকে জাগিয়ে দেওয়া হয় সাহ্রি খেতে ওঠার জন্য। মসজিদে মালেক চাচাও ডেকে চলেন পাশাপাশি। সারা পাড়ায় একটা উৎসব-উৎসব আমেজ। আব্বা সবার আগে উঠে আমাদের জাগিয়ে দিতেন। এখন প্রবাসে মুঠোফোনের অ্যালার্মে আমি উঠি সবার আগে। তারপর মেয়ে ও মেয়ের মাকে জাগিয়ে দিই। ওরা উঠতে উঠতে আমি ফ্রিজ থেকে ভাত এবং দুধের ঢপ বের করে ফেলি। এরপর বাটিতে ভাত আর দুধ মিশিয়ে মাইক্রোওয়েভে এক মিনিট গরম করতে দিই। গরম হয়ে গেলে বের করে কলা চটকিয়ে ওদের খেতে দিই। এরপর সবাই মিলে একসঙ্গে খেয়ে আবার ঘুম।
অফিস থেকে ফিরে আবার সবাই মিলে একসঙ্গে ইফতার করা। এখানে অনেকেই বাসায় ইফতারি তৈরি করেন। আর যেদিন তাড়া থাকে সেদিন বাংলা দোকান বা রেস্তোরাঁ থেকে মুখরোচক ইফতারি কিনে নিয়ে আসেন। আবার অনেকেই সপরিবার রেস্তোরাঁয় গিয়েও ইফতার করেন। দল বেঁধে ইফতার করার আনন্দ বেশি, তাই সবাই তাদের পরিচিতদের নিয়ে অন্ততপক্ষে এক দিন হলেও রেস্তোরাঁতে ইফতার করেন। পাশাপাশি বিভিন্ন সংগঠনও ইফতারের আয়োজন করে থাকে। কুষ্টিয়াতে আমাদের গ্রামে একসময় বিদ্যুৎ ছিল না।
তখন আমরা অপেক্ষা করতাম কখন কুষ্টিয়া শহরের রেনউইক কারখানা থেকে হুইসেল দেবে। সেই হুইসেল গড়াই পদ্মা পার হয়ে একসময় আমাদের কাছে পৌঁছালে আমরা ইফতার করতাম। এরপর শহরতলি বাড়াদীতে আসার পর মসজিদের আজান শুনেই ইফতার করা হতো। এখন প্রবাসে মুঠোফোনের বিভিন্ন ইসলামিক অ্যাপের অ্যালার্ম শুনে ইফতার করা হয়।
আমার মনে আছে, রেডিওতে রমজান মাসে মাগরিবের নামাজের আগে কোরআন তিলাওয়াত প্রচার করা হতো। এরপর মাগরিবের আজান এবং দোয়ার পর হামদ-নাত প্রচার করা হতো। এ বছর থেকে আমরা তাই যে কয় দিন বাসায় সবাই একসঙ্গে ইফতার করেছি, সেই কয় দিনই ইফতারের আগে ইউটিউবে কাজী নজরুল ইসলামের সেই সব কালজয়ী হামদ-নাত ছেড়ে দিয়ে ইফতার তৈরি করতে থাকি।
এরপর সময় হলে সবাই একসঙ্গে টেবিলে বসে ইউটিউবে বাংলাদেশ টেলিভিশনের সেই বিখ্যাত আজান ছেড়ে দিয়ে ইফতারের জন্য খাবার মুখে দিই। এ যেন আমাদের ছোটবেলাকে আমাদের সন্তানদের মধ্যে ফিরিয়ে আনার একটা ছোট চেষ্টা। সঙ্গে সঙ্গে তাদের বলি, আমাদের শৈশব-কৈশোরের চাঁদ দেখা, তারাবিহ পড়া, সাহ্রি খাওয়া এবং ইফতার করার গল্প।