যে শহরে দেখা যায় বিস্তৃত আকাশ

‘হৃদয় তব হোক আকাশসম বৃহৎ ও উদার।’ আকাঙ্ক্ষা দোষের কিছু না। শৈশব থেকেই ঘরে বা রেস্টুরেন্টে, বিদ্যালয়ে, মহাবিদ্যালয়ে, বিশ্ববিদ্যালয়ে, কর্মস্থলে সব ছাদের নিচেই কেন যেন জানালার পাশের আসনটি আমায় টানে। অন্য কোনো কারণ নয়, কেবল একটু আকাশ দেখতে পাবার জন্য। এটি এমন অস্বাভাবিক বা অসাধারণ কোনো বিষয় নয়। প্রায় সবারই এমন হওয়ার কথা। আমরা সবাই আকাশ দেখতে ভালোবাসি। আমি তিন বছরের অধিককাল ধরে হাঙ্গেরির বুদাপেস্ট শহরে বাস করছি। সম্প্রতি একাডেমিক কাজে মাস খানেকের জন্য টরন্টো, কানাডায় গিয়েছিলাম। অত্যাধুনিক শহর। আধুনিকতার (সাধারণ অর্থে) সকল অবকাঠামোই চূড়ান্ত রকমভাবে গড়ে তোলা হয়েছে। আমি মূল শহর থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরে ছিলাম। তবে মূল শহরে কয়েক দিন কাটানোর পর মনে এই অনুভূতির উদয় হলো।

ঢাকা শহরের দীর্ঘদিনের বাসিন্দা হওয়ার কারণে নাগরিক জীবনের অনেক অসঙ্গতিই স্বাভাবিক হয়ে গিয়েছে। বিশেষ করে শব্দদূষণ, বাতাস দূষণ, ঘনবসতি ও অপরিকল্পিত নগরায়নে বিজ্ঞাপনে আকাশ ঢেকে যাওয়া। আরও অনেক কিছুই পীড়া দিলেও, গা সয়ে গিয়েছে। কিন্তু টরন্টো সিএন টাওয়ার দেখতে যাবার জন্য ‘ইউনিয়ন’ স্টেশন মেট্রো-আন্ডারগ্রাউন্ড থেকে ভুল করে বাস টার্মিনালের দিকে বাইরে বের হয়েছিলাম। কয়েক পা ফেলার পর আমি কিছুক্ষণের জন্য থমকে গেলাম; আমি কী আন্ডার গ্রাউন্ডেই আছি, না বের হয়েছি। হাঁটতে হাঁটতে যতই বাস টার্মিনালের দিকে যাচ্ছি ততই যেন সুউচ্চ দালান আর উড়ালসড়কের ভিড়ে খেই হারিয়ে ফেলছিলাম। আমি অনেক চেষ্টা করেও দীর্ঘক্ষণ আকাশ দেখতে পাইনি। তাই বলে পুরো টরন্টো শহর এমন নয়, তবে এই শহরের অনেক জায়গাই এমন— এটি আমার ব্যক্তিগত ও ক্ষণিকের পর্যবেক্ষণ। অনেক পয়েন্টেই বা চত্বরেই আমার একটা দমবন্ধ অনুভূতি সৃষ্টি হয়েছে।
বুদাপেস্টের সাথে টরন্টোর বৈষয়িক দিক নিয়ে তুলনা করে হয়তো উৎরানো যাবে না।

বুদাপেস্ট শহরের লিবারর্টি স্কয়ারে লেখক।
ছবি: সেলফি

এটি আমার আলোচনার বিষয়ও না। তিন বছরের বেশি সময় ধরে যেহেতু একটি শহরে থাকি, অন্তত পক্ষে মূল শহরটি মোটামুটি দেখা হয়েছে বলতেই পারি। এই শহরের কোনো অংশই আকাশ দেখা থেকে আপনাকে তেমন একটা বঞ্চিত করবে না। এই আকাশ দেখাটি আমার মনে হয় প্রত্যেক মানুষেরই স্বাভাবিক জীবনযাপনের জন্য খুব জরুরি। আমি খুব ভাগ্যবান যে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়টি দানিয়ুব নদীর তীরে অবস্থিত। আমি যে ডরমিটরিতে থাকি, সেটিও নদী তীরবর্তী। ফলে অতি ভাগ্যবান হিসেবে ঘরের জানালা দিয়ে আকাশ দেখার পাশাপাশি দানিয়ুব নদীর বয়ে যাওয়ার কলকল ধ্বনিও অনুভব করতে পারি। এ শহরের প্রায় পুরো অংশেই আপনি বিস্তৃত আকাশ দেখার সুযোগ পাবেন। সাত-আট তলার বেশি উচু ভবন নাই বললেই চলে। সুপ্রশস্ত রাস্তা, কয়েকটি ভবনকেন্দ্রিক বৃহৎ পার্ক বা খোলা জায়গা। বিগত কয়েক বছরে পৃথিবীর আরও কয়েকটি দেশের রাজধানী শহর দেখার সুযোগ হয়েছে। বুদাপেস্টের প্রতিবেশী শহর অস্ট্রিয়ার ভিয়েনা ও স্লোভাকিয়ার ব্রাটিস্লাভার কথা যদি বলি, সেসব শহরেরও বেশ কয়েকটি চত্বরে আপনি আকাশ হারিয়ে ফেলবেন।

আমরা ঘনবসতিপূর্ণ একটি গরিব দেশের নাগরিক, তাই নাগরিক জীবনে আকাশ দেখার উপকারিতার আলাপ অবান্তরই মনে হতে পারে। হাঙ্গেরিও, কানাডা তো বটেই, ইউরোপের অন্যান্য দেশ থেকে অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল। তবে তাদের জনসংখ্যা অনেক কম এবং স্বাস্থ্যসম্মত নগরজীবন বজায় রাখার জন্য নগরপিতা ও সরকার বদ্ধপরিকর। তাই বুদাপেস্টের কেন্দ্রে থেকেও মন চাইলেই খুব সহজেই নীল আকাশ বা সাদা-কালো মেঘের খেলা দেখতে পারি। গবেষণার কাজে দিনের বেশির ভাগ সময়ই কম্পিউটার ও ডেস্কেই বসে থাকতে হয়। যখন একাডেমিক চিন্তা, কাজ করতে করতে একটু হাঁপিয়ে উঠি তখন ডেস্ক থেকে উঠে জানালাটা খুলে জানালার নিকট দাঁড়িয়ে থাকি। একটু সজীব বাতাস, দানিয়ুব নদীর কলকল শব্দ এবং নীল আকাশ এ শারীরিক ও মানসিক—উভয় ধরনের শক্তি ও উদ্যম ফিরে পাই। তা না হলে হয়তো একাকী এই প্রবাস জীবন আরও দুর্বিসহ হয়ে উঠত। একাডেমিক ও ভ্রমণের উদ্দেশ্যে প্রায়শই বিভিন্ন দেশে যাওয়ার চেষ্টা করি। সে অর্থ সংস্থানের জন্য আমি সপ্তাহান্তে একটি রেস্টুরেন্টে দৈনিক ১২ ঘণ্টা কাজ করি। আমার জন্য এটি অনেক শারীরিক পরিশ্রমের কাজ।

কিন্তু কাজ শেষে প্রায় মাঝরাতে রেস্তোরাঁ থেকে বের হয়ে যখন আকাশের দিকে তাকাই, কিছুটা পথ বাসে করে, কিছুটা পথ দানিয়ুবের তীর ঘেঁষে হেঁটে ডরমে ফিরি, আমার ক্লান্তি অনেকটাই কেটে যায়। এ কারণেই হয়তো দ্বিতীয় দিনেও ১২ ঘণ্টা কাজ করা আমার জন্য সহজ হয়ে যায়। একই কারণে সপ্তাহের প্রথম দিনে একাডেমিক জগতে প্রবেশেও তেমন একটা বেগ পেতে হয় না। জানালার ধারে দাঁড়িয়ে একটু রবীন্দ্রসংগীত, এক টকুরা আকাশ, নির্মল হাওয়া ও দানিয়ুবের নিরন্তর বয়ে যাওয়া। ক্লান্তি অবসানে এই জীবনাচরণেই রয়েছি সুন্দর বুদাপেস্ট নগরীতে। তাই মনে হয় মনের খোরাক না থাকলে শরীরও বেশিদিন খোরাক নিতে পারে না। তবে সে জন্য ঢাকার মতো নগরের অধিবাসীদের বুদাপেস্ট এ আসতে বলছি না বা সম্ভবও নয়। একটু পরিকল্পিত নগর হলেই আকাশ কিছুটা হলেও দৃশ্যমান রাখা যায়।  

*লেখক: সুদীপ রায়, পিএইচডি গবেষক, করভিনাস ইউনিভার্সিটি অব বুদাপেস্ট, বুদাপেস্ট, হাঙ্গেরি।

**দূর পরবাসে ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]