বড়ি সমাচার!

বাঙালির রসনাবিলাসে ডালের বড়ি অন্যতম একটি খাবারের নাম। যদিও বর্তমানে এটি আর আঞ্চলিকতায় সীমাবদ্ধ নেই। হাঁসের মাংস ভুনা, কালাভুনা, কই মাছ ভাজা, পাবদা মাছের ঝোল, সাতকড়া, চুইঝালের মতো বাংলার খাদ্যসংস্কৃতিতে ডালের বড়ি নিয়েও একটু বাড়াবাড়ি রকম আচরণ পরিলক্ষিত হয়।

দেশে যতবারই বেড়াতে যাই, ফিরে আসার সময় প্রতিবারই শাশুড়ি এক বয়াম ডালের বড়ি লাগেজে পুরে দেন। আমার শাশুড়ি আগে থেকেই নানা মাধ্যমে বড়ি জোগাড় করে রাখেন। কারণ, ওনার কর্তাব্যক্তিটির মতো তাঁর বড় ছেলেরও ডালের বড়ি খুব পছন্দের।

কিন্তু এই বড়ি নিয়ে আমার একটু বিড়ম্বনা ছিল। আমার বাবার বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়; আর বাবার চাকরির সুবাদে বড় হওয়া ও পড়াশোনা সবই চট্টগ্রাম শহরে। তাই আমি কোনোভাবেই বিয়ের আগে ডালের বড়ির সঙ্গে পরিচিত ছিলাম না, যদিও এখন অনলাইন ব্যবসার কারণে প্রায় সারা দেশেই ডালের বড়ির প্রচলন আছে। একেবারে পরিচিত ছিলাম না বললে ভুল হবে। কারণ, ‘মাগো, ওরা বলে’—আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ রচিত কবিতার কথা কি কারও মনে পড়ে?

কুমড়ো ফুলে-ফুলে,
নুয়ে পড়েছে লতাটা,
সজনে ডাঁটায়
ভরে গেছে গাছটা,
আর আমি,
ডালের বড়ি শুকিয়ে রেখেছি।
খোকা তুই কবে আসবি ?
কবে ছুটি?

চিঠিটা তার পকেটে ছিল
ছেঁড়া আর রক্তে ভেজা।
মাগো, ওরা বলে
সবার কথা কেড়ে নেবে...।

এই কবিতায় প্রথম ডালের বড়ির কথা জেনেছিলাম। তবে এ নিয়ে বিশদভাবে মাথা ঘামাইনি, কারণ তখন কবিতাটি মুখস্থ করাই মুখ্য ব্যাপার ছিল। তবে কবিতাটিতে মায়ের আকুতি ও অপেক্ষার বিষয়টি মন ছুঁয়ে গিয়েছিল। যাহোক, সে অন্য কথা।

বিয়ের পর শ্বশুরবাড়ির রান্নাঘরে জীবনে প্রথম ডালের বড়ি আবিষ্কার করলাম। প্রায় কিছুদিন পরপর শাশুড়ি পরম যত্নে আমার শ্বশুরের জন্য বিভিন্ন রকমভাবে ডালের বড়ি দিয়ে তরকারি রান্না করতেন। সেই সঙ্গে শাশুড়ির মুখে শুনতাম বড়ির বিশাল ফিরিস্তি—গ্রামবাংলার ঘরে ঘরে কীভাবে ডালের বড়ি বানানো হয়, কীভাবে শুকানো হয়; ডাল দিয়ে বানানো বড়ি ডালের বড়ি এবং ডালের লেইয়ের সঙ্গে চালকুমড়ার মিহি কুচি মিশিয়ে বানানো বড়ি কুমড়ার বড়ি নামে পরিচিত, শজনে ডাঁটার সংযোগে রান্না করলে ডালের বড়ি আরও উপাদেয় হয় ইত্যাদি।

উল্লেখ্য, আমার শাশুড়ি খুব ভালো গল্প বলতে বা আড্ডা দিতে পারেন। এসব গল্প শুনে মনে হতো, বিশাল একটা ইতিহাস আমার অজানা ছিল! যা-ই হোক, আমি দিন দিন ডালের বড়ির শিক্ষায় শিক্ষিত হতে থাকলাম ও চোখের দেখায় রান্নাটাও মোটামুটি রপ্ত করলাম। কিন্তু বিরোধ বাধে তখনই, যখন ডালের বড়ি পাতে পড়ে। কী যন্ত্রণা! কোনো রকম মজা পেতাম না, বরং মনে হতো ডালের বড়ি পুরো তরকারির স্বাদটাই নষ্ট করে দিয়েছে।

কিন্তু পরিবারের অন্যরা, বিশেষ করে আমার শ্বশুর এত তৃপ্তি নিয়ে খেতেন, তা দেখেই অবাক হতাম। মাঝেমধ্যে বদহজমেরও শিকার হয়েছি। আমার মনে হয়, আমাদের দেশে বেশির ভাগ মেয়েই বিয়ের পর এমন অভিজ্ঞতার বা বিড়ম্বনার সম্মুখীন হন। কারণ, আমাদের দেশে অঞ্চলভেদে খাবার সংস্কৃতি ভিন্নতর হয়ে থাকে। নতুন পরিবেশে এসে একটি মেয়ে তা মানিয়ে নেন এবং একসময় এটি তাঁর অভ্যাসগত স্বাদে পরিণত হয়, যা পরবর্তী সময়ে কারও কারও কাছে সুস্বাদু হয়ে ওঠে। আমার ক্ষেত্রেও তা-ই হয়েছে।

একদিন আমার শাশুড়ি বেগুন, সাদা মুলা ও চিংড়ি দিয়ে ডালের বড়ি রান্না করলেন। অসাধারণ রান্না হয়েছিল। যদিও মুলার অনেক বদনাম আছে! আমার শ্বশুর কী যে মজা করে খেয়েছিলেন, সেই দৃশ্য আজও স্পষ্ট দেখতে পাই। তারপর ধীরে ধীরে আমার স্বাদেন্দ্রিয় কাবু হতে বাধ্য হলো। আমিও এখন আমার সংসারে বিভিন্ন সবজি, মাছ ও শজনে ডাঁটার সংযোগে ডালের বড়ির বিভিন্ন রকম পদ করে থাকি।

আর সামনে বসা মানুষটার তৃপ্তি করে খাওয়ার দৃশ্য উপভোগ করি। তবে এখন যখনই ডালের বড়ি দিয়ে কিছু রান্না করি, তখনই আমার শ্বশুরের কথা খুব মনে পড়ে যায়। আমরা খাবার টেবিলে বসে নানান স্মৃতিচারণা করতে থাকি, কখনোবা আবেগাপ্লুত হয়ে পড়ি। আমার শ্বশুর করোনায় আক্রান্ত হয়ে ২০২১ সালের ১৩ এপ্রিল মারা গেছেন।

আজকাল যখন দেশে ফোন দিয়ে শাশুড়ি মায়ের সঙ্গে বড়ি রান্নার গল্প করি ও কথার সূত্রধরে জিজ্ঞাসা করি, ‘বাবার পছন্দের রান্নাগুলো কি করা হয়, মা?’ ওপার থে‌কে আবেগঘন কণ্ঠে উত্তর আসে, ‘না, ইচ্ছা হয় না আর ওসব করতে।’

আমাদের ভালোবাসার মানুষগুলো চিরতরে হারিয়ে যায়, কিন্তু কত-না স্মৃতি পেছনে রেখে যায়। সামান্য একটা খাবার উপাদান ‘ডালের বড়ি’। কিন্তু শুধু এই খাবারের সঙ্গে জড়িয়ে আছে কত ভালোবাসা, মায়া, আবেগ ও স্মৃতি, যা বারবার মনে করিয়ে দেয় অনেক কিছু।

শাশুড়ির দেওয়া বয়ামভরা ডালের বড়ি ফুরিয়ে গেছে, আবার যে আনতে হয়। এমন করেই খাবারের সঙ্গে জড়িয়ে থাকুক আমাদের ভালোবাসাবাসি। আবু জাফর ওবায়দুল্লাহর কবিতাটি দিয়েই শেষ করি আজ।

কুমড়ো ফুল
শুকিয়ে গেছে,
ঝরে পরেছে ডাঁটা,
পুঁই লতাটা নেতানো।
‘খোকা এলি?’

ঝাপসা চোখে মা তাকায়
উঠানে-উঠানে
যেখানে খোকার শব...।