আমি টাকা গিলতে চাই

আমি বাংলাদেশের অত্যন্ত সাধারণ পরিবারের সন্তান। খুব অল্প বয়সেই বেঁচে থাকার জন্য সংগ্রাম করতে শিখেছি। বয়সের তুলনায় ছোটবেলার স্মৃতিগুলো হৃদয়ে বেশ শক্ত হয়ে আজও গেঁথে আছে। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের আগেরও কিছু কিছু ঘটনা মনে আছে। তখন সন্ধ্যায় মাঝেমধ্যে বাড়িতে মিটিং হতো, কীভাবে পাকিস্তানি শাসকদের হাত থেকে দেশকে মুক্ত করা যায়। তখন বাপ-চাচাদের বলতে শুনেছি, ২০০ বছর ব্রিটিশ আমাদের সব শোষণ করে নিয়ে গেছে। জমিতে নীল চাষ করেছে আর আমরা হয়েছি বঞ্চিত। ব্রিটিশ তাড়িয়ে ভেবেছিলাম ভালো থাকব, কিন্তু তা আর হলো না। চলছে পাঞ্জাবিদের অত্যাচার–অবিচার। পরে সেই ১৯৭১ সালে দেশ স্বাধীন হলো। পরিবার এবং দেশের লাখো লাখো মানুষের রক্তের বিনিময়ে আনা হলো বাংলার স্বাধীনতা। বুকভরা আশা নিয়ে সোনার বাংলা গড়ার নতুন চেতনা সবার বুকে। সে যে কী আনন্দ, যা আজও চোখে ভাসে। কিন্তু কী হতে কী হয়ে গেল! তারপরও বেঁচে থাকার তাগিদে থেমে গেলে চলবে না। সংগ্রাম করতেই হবে, মুক্তি একদিন হবেই ইনশা আল্লাহ।

আমরা মূলত ১১ ভাইবোন। মা–বাবার প্রথম সন্তান জন্মের চার বছর পর কলেরায় মারা যায়। তারপর একে একে ১০ ভাইবোনের সংসার। ১৯৮৪ সালে বিদ্যুৎস্পৃষ্টে আমার ছোট এক ভাই মারা যায়, বর্তমান আমরা ছয় ভাই ও তিন বোন বেঁচে আছি। তবে দেশে বসবাস করেন মাত্র একজন। মা–বাবা মারা গেছেন।

যখন দেশে সবাই গ্রামের পরিবেশে বসবাস করেছি, তখন দেখেছি বড় একটি মাছ রান্না হয়েছে। মাছের মাথা সবারই পছন্দ, কিন্তু মা সম সময় এমনভাবে ভাগ করেছেন, যেন কেউ বঞ্চিত না হয়। অর্থাৎ একবার পেল একজন, তার পরেরবার পাবে অন্যজন। নির্ভুলভাবেই তিনি এমন করতেন। সেই থেকেই মূলত শিক্ষা পেয়েছি কীভাবে পরস্পর পরস্পরকে সাহায্য করতে হবে। পরে নিজে বাবা হয়েছি। আমার এক ছেলে ও এক মেয়ে। কখনো তাদের আলাদাভাবে দেখিনি, দুজনকেই সমমানের সুযোগ-সুবিধার মধ্যে গড়ে তুলতে শতভাগ চেষ্টা করে চলছি। আবার যখন পরিবারের বাইরে দেশের কথা ভাবি, তখন ভাবি যে দেশের জন্য কিছু করতে হবে। অন্যরাও যেন আমাদের মতো সুযোগ-সুবিধা পায়—এমন মন–মানসিকতা আমাদের সবার মধ্যে কমবেশি রয়েছে। কারণ, আমি সব সময় মনে করি দেশের উন্নতি হওয়া মানেই আমারও উন্নতি, যদিও আমি দেশে থাকি না তারপরও আমার মন-মানসিকতার বিন্দুমাত্র পরিবর্তন হয়নি। এখন আমার ভাবনা যাঁরা দেশে থেকে দেশের মানুষের জন্য সবকিছু করার জন্য জীবন–যৌবন দিয়েছেন, তাঁদের নিয়ে। যেমন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কথাই বলি। তিনি জেল খেটেছেন। তারপরও মানুষের জন্য কিছু করা, নিজের দেশের জন্য কিছু করা থেকে বিরত হননি কখনো। তাহলে কেন এমন হলো? যাঁরা ক্ষমতায় এসেছেন, তাঁরাই লুটপাটে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। আমরা স্বাধীন, কোনো ঔপনিবেশিক শক্তি আমাদের শাসন করছে না। আমরা এখন পরস্পর পরস্পরের খুব কাছের মানুষ। তারপরও কেন এত ভেদাভেদ!

রাষ্ট্রের দায়িত্বে যাঁরা আছেন, তাঁরাও সেই আমার নিজের মা–বাবার মতো একটি বড় পরিবারের দায়ভার নিয়েছেন। তাঁদেরও ঠিক আমার মায়ের মতো ‘কেউ যেন বাদ না যান না পড়েন’ করে ম্যানেজ করার কথা? কিন্তু সমস্যাটি তাহলে কোথায়? এত বড় দায়িত্ব পেতে দরকার পরম করুণাময় রাব্বুল আল–আমিনের আশীর্বাদ! এত বড় সুযোগ পেয়ে কীভাবে সম্ভব দেশের মানুষের পেটে লাথি মেরে তাদের ন্যায্য অধিকার হরণ করে ব্যক্তিকেন্দ্রিক টাকার পাহাড় গড়া? ভেবেছে কি তারা এর শাস্তি কত মারাত্মক হবে? মনে হচ্ছে এরা পথভ্রষ্ট হয়ে গেছে। এত পথভ্রষ্ট যে এরা মনে করছে এমনটি, ‘আমি সব খেয়েছি কিন্তু কিছুতেই আমার মন, প্রাণ পেট ভরছে না। কী করি? সম্পদের পাহাড় গড়েছি কিন্তু মনে শান্তি নেই। সব রয়েছে, সব হয়েছে, কিন্তু রাতে ঘুম আসে না। আমার শরীরে তাবৎ জায়গায় শুধু জ্বালাপোড়া। এটা নেই, সেটা নেই, শুধু নেই আর নেই। অন্যদিকে, যা আছে তা–ও ঠিকমতো উপভোগ করার সময় নেই।

কারণ, আমি তো ব্যস্ত। ওই যে আমার ওটা নেই। ওটার কখনো শেষ হবে না কারণ, ওটা চলমান। এ অবস্থায় আমার মতো শত শত লোভী ও পাপীর একমাত্র কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে শুধু অর্থ গলাধঃকরণ। আমাদের এখন এ ছাড়া কিছু করার নেই। যুগে যুগে এমনটিই হয়েছে, যদি আমরা পুরোনো ইতিহাস খুলে দেখি। কিন্তু এগুলো দেখিয়ে কোনো লাভ হবে না, কারণ আমি আরও চাই। আমি এখন খেতে নয়, গিলতে চাই। তাই আমি টাকা গিলতে চাই। দাও আমাকে তোমার যা কিছু আছে, আমি শুধু নেব আর গিলব। আমার বিশাল উদর পূর্তি করতে প্রয়োজন কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা। টাকা দাও টাকা চাই, টাকা দাও টাকা চাই, টাকা, টাকা, টাকা...।