স্মৃতিতে সালমান শাহ

সালমান শাহ
ফাইল ছবি

ইউটিউব, নেটফ্লিক্স আসার আগে একসময় সিডিতে সিনেমা দেখা হতো। তারও আগে সিনেমা দেখা হতো ভিসিপি ও ভিসিআরে। তবে ভিসিআরে সাধারণত বিদেশি সিনেমাগুলো দেখা হতো। আমরা সেই প্রজন্ম, যারা ভিসিআরে সিনেমা দেখে বড় হয়েছি।

ভিসিআরে সিনেমা দেখার ছিল অনেক ঝক্কি। এলাকার কোনো নির্দিষ্ট দোকান থেকে ভিসিআর ভাড়া করে আনতে হতো কিছু টাকা অগ্রিম দিয়ে। তারপর যাঁদের বাসায় টেলিভিশন আছে, তাঁদের বাসায় সেটা সেট করা হতো আর অপেক্ষা করা হতো কখন রাত হবে এবং ভিসিআর চালানো হবে।

আমাদের সবচেয়ে বেশি ভিসিআর দেখা হতো প্রতিবেশী সালামদের বাড়িতে। সালামদের বাড়ির উঠানের এক কোণে টিভির ওপর ভিসিআরের বাক্সটা রাখা হতো। তারপর সাধারণত ভারতীয় বাংলা ছবির ক্যাসেট ছেড়ে দেওয়া হতো। কারণ, আমাদের বাবা-মায়েরা সেটা দেখে ঘুমিয়ে যাবেন। এরপর রাত বাড়ার পর একটা সময় ভিসিআর এবং টিভিকে ঘরের মধ্যে নিয়ে আসা হতো এবং তখন শুরু হতো ভারতীয় হিন্দি সিনেমা।

হাতে গোনা দু-একটা বাংলাদেশি সিনেমা আনা হতো। তবে সেগুলোর ব্যাপারে দর্শকদের তেমন আগ্রহ দেখা যেত না। কারণ, তখন পর্যন্ত বাংলাদেশের সিনেমাগুলো হলে গিয়ে সপরিবার দেখার চল ছিল। তাই সেগুলোকে অবশ্য ভিসিআরে পাওয়াও যেত না। তবে দোকানিরা কীভাবে যেন দু-একটা বাংলা সিনেমার ক্যাসেট জোগাড় করতেন এবং সেগুলো লুকিয়ে রাখতেন। কেউ চাইলেই শুধু বের করে দিতেন।

‘বেদের মেয়ে জোস্‌না’র প্রভাব তখন কাটতে শুরু করেছে, কারণ ‘বেদের মেয়ে জোস্‌না’ ছিল তখন পর্যন্ত সবচেয়ে ব্যবসাসফল বাংলা সিনেমা। ‘বেদের মেয়ে জোস্‌না’ নিয়ে অনেক গল্প প্রচলিত ছিল। যশোর মনিহার সিনেমা হলে সন্তানসম্ভবা এক নারী সিনেমা দেখতে গিয়ে হলের মধ্যেই মেয়েসন্তানের মা হয়েছেন এবং মেয়ের নাম রেখেছেন ‘জোসনা’। ইলিয়াস কাঞ্চন ও অঞ্জু ঘোষ সেই মেয়েকে দেখতে এসে উপহার দিয়ে গেছেন। তখনকার আড্ডার বিষয়বস্তু ছিল ‘বেদের মেয়ে জোস্‌না’ কে কতবার দেখেছে।

অনেককে বলতে শুনতাম, তিনি ১০০ থেকে ১৫০ বার দেখেছেন। সেটাও আসলে খুবই সম্ভব ছিল। এরপর হঠাৎ একদিন কুষ্টিয়ার বনানী সিনেমা হলে এল নতুন এক সিনেমা। নাম তার ‘কেয়ামত থেকে কেয়ামত’। দেশের আবালবৃদ্ধবনিতা সেই সিনেমা দেখতে হলগুলোয় ভিড় করতে শুরু করল।

মাসের পর মাস সেই সিনেমা চলল। আমাদের আর সেই সিনেমা দেখার সৌভাগ্য হলো না। আমরা ছোটরা হলে গিয়ে সেই সিনেমা দেখার সুযোগ পেলাম না। কিন্তু যতবারই কোথাও সেই সিনেমার পোস্টার দেখেছি, দাঁড়িয়ে পড়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সিনেমার নায়কটাতে দেখতাম। ছোটখাটো একজন মানুষ। নতুনভাবে আঁচড়ানো চুলের স্টাইল। মুখের মধ্যে একটা অদ্ভুত হাসি। সব মিলিয়ে দারুণ একটা ভালো লাগা কাজ করত।

এরপর সময় দ্রুতই গড়িয়ে যেতে থাকে। সালমান শাহর প্রথম সিনেমা মুক্তি পায় আমরা যখন অষ্টম শ্রেণিতে পড়ি। একেবারে উঠতি বয়সী। চোখে নতুন নতুন স্বপ্ন ভিড় করা শুরু করেছে। আর আমরা গ্রামের ছেলেমেয়ে তখনো অমিতাভ বচ্চন, মিঠুন চক্রবর্তী, প্রসেনজিৎ, চিরঞ্জীব আর ভিক্টর ব্যানার্জির বাইরে কাউকে তেমন চিনিও না। হঠাৎ সালমান শাহ এসে আমাদের সত্তাজুড়ে জায়গা করে নিল। উঠতে–বসতে, চলতে–ফিরতে ওনার হাসি–কান্না, কথা বলার স্টাইল পর্যন্ত নকল করতে শুরু করলাম।

সেই বয়সে প্রথম প্রেম নিবেদনের ক্ষেত্রেও সবাই ওনাকেই অনুসরণ করতে শুরু করল। আমাদের সঙ্গে একজন অতীব সুন্দরী মেয়ে পড়ত। সেই মেয়েকে ভালোবাসতেন আমাদের এক ব্যাচ সিনিয়র বড় ভাই। বিভিন্নভাবে সেই মেয়েকে পথেঘাটে উত্ত্যক্ত করতেন এবং ওনার ভালোবাসা কতটা গভীর, সেই প্রমাণ দিয়ে বেড়াতেন।

একবার উনি আমাদের সেই সহপাঠিনীর নাম ওনার বুকে খোদাই করে ঘুরে বেড়াতেন। আমি একবার সামনাসামনি ওনার বুকটা দেখে ভয়ই পেয়ে গিয়েছিলাম। ওনার এমন কর্মকাণ্ডের কারণ সালমান শাহ কোনো একটা সিনেমাতে তার প্রেমিকার নাম সেভাবে বুকে খোদাই করেছিলেন।

ওনার ওপর আমাদের কিঞ্চিৎ রাগ হতো, কারণ আমাদের সমবয়সী সহপাঠিনীরা তখন আমাদের ভাবনা না ভেবে সারাক্ষণই ওনার ভাবনাতে মশগুল থাকত। ওনার কোনো ছবিতে কার কোন অভিনয় বা কোন ডায়ালগ ভালো লেগেছে, সেটা নিয়ে পড়ার ফাঁকে ফাঁকে আলোচনা করত। আমরা যে পাশে বসে আছি, সেদিকে কারও খেয়ালই ছিল না। সহপাঠিনীদের কিঞ্চিৎ মনোযোগ পাওয়ার আশায় ওনার পোশাকপরিচ্ছদের হুবহু নকল করতে শুরু করলাম আমরা।

এমনকি কোনো প্রেমিক তার প্রেমিকাকে মনের কথা প্রকাশ করার জন্য দোকান থেকে দুই টাকা দিয়ে ওনার কোনো ভিউকার্ড কিনে তার পেছনে মনের কথা লিখে প্রেয়সীর কাছে পাঠিয়ে দিতেন। এভাবেই একটা প্রজন্মের আইডলে পরিণত হয়েছিলেন সালমান শাহ নামের সেই পরশপাথর, যার ছোঁয়ায় বাংলাদেশি সিনেমার জগতে বিপ্লব ঘটে গিয়েছিল।

ব্যক্তিগতভাবে আমি ওনার যতগুলো ছবি দেখেছি, তার মধ্যে ‘আশা ভালোবাসা’ ছবিটার কথা এখনো মনে আছে। সেই সিনেমার একটা গান ‘গান আমি গেয়ে যাব এই আসরে’ আমার খুবই ভালো লাগত। এমনকি এখনো আমি ইউটিউবে ঘুরেফিরে এ গান বাজাই। এ ছাড়া ‘স্বপ্নের ঠিকানা’ সিনেমার টাইটেল গানটা এখনো অনেক প্রিয়। এ ছাড়া ‘সত্যের মৃত্যু নেই’ ছবির ‘চিঠি এল জেলখানাতে অনেক দিনের পর’ শিরোনামের গানটা মনে দাগ কেটেছিল।

এই গানগুলো এতটা ভালো লাগার কারণ, এগুলোর কথা বা সুর নয়, এই গানের সঙ্গে যিনি ঠোঁট মিলিয়েছিলেন, সেই মানুষটার অকৃত্রিম অভিনয়। ওনার অভিনয় দেখলে আমার কখনই মনে হতো না আমি কোনো সিনেমা দেখছি। আমার মনে হতো, বাস্তব জীবনে আমার চোখের সামনে এই ঘটনাগুলো ঘটছে। ওনার প্রতিটি ছোটখাটো অভিনয় ছিল একেবারে নিখুঁত। এত দিন পর এসেও আমরা পুরো পরিবার মিলে বসে ওনার সিনেমাগুলো উপভোগ করি।

পাড়ায় কোথাও ভিসিআর ভাড়া এনেছে শুনলেই আমরা খোঁজ নিতাম সালমান শাহর কোনো সিনেমার ক্যাসেট এনেছে কি না? যেই শুনতাম সালমান শাহর সিনেমার ক্যাসেট এনেছে, আমরা দুই ভাই যেভাবেই হোক বাড়ি থেকে টাকা চুরি করে যত রাতই হোক চলে যেতাম সিনেমা দেখতে। এই ব্যাপারে আমাদের দুই ভাইকে আশপাশের পাড়ার সবাই চিনত সালমান শাহর ভক্ত হিসেবে।

বাংলাদেশের সিনেমায় এমন এক সময় সালমান শাহর আগমন, যখন সিনেমায় চরিত্রের শূন্যতা দেখা দিয়েছিল। সিনেমায় বিভিন্ন অজুহাতে একটু একটু করে অশ্লীলতা ঢোকা শুরু করেছে। তখন সালমান শাহ এসে পুরো সিনেমাজগৎকে খোল নলচে বদলে দিলেন। প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গেল এমন সিনেমা বানানোর, যেটা মানুষ সপরিবার হলে গিয়ে দেখতে পারবে। সালমান শাহ এমন একজন মানুষ ছিলেন, যিনি একক ব্যক্তি হিসেবে অভিনয় শুরু করে পুরো বাংলাদেশের চলচ্চিত্রজগতের চেহারা বদলে দিয়েছিলেন রাতারাতি।

তাই সালমান শাহর হঠাৎ মৃত্যু যেমন একদিকে আমাদের প্রজন্মকে শোকে ভাসিয়েছিল, তেমনই বাংলাদেশের সিনেমাতে শুরু হয়েছিল একটা কালো অধ্যায়ের। এরপর বাংলাদেশের সিনেমা প্রায় দুই যুগ ধরে ধুঁকতে ধুঁকতে আজকের এই জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে। ওনার মৃত্যুর পর চলচ্চিত্রের ভাষায় পুরোপুরি বদলে গেল। শুরু হয়ে গেল নানা খিস্তিখেউড়।

আর অভিনয়ের নামে শুরু হলো শরীরের প্রদর্শনী। তাই স্বাভাবিকভাবেই হলমুখী মধ্যবিত্ত সিনেমা হলগুলো থেকে মুখ ফিরিয়ে নিল। এরপর একে একে বহু সিনেমা হল বন্ধ হয়ে গেল। আমার মনে হয় ওনার মৃত্যু বাংলাদেশের সিনেমাজগৎকে ২০ বছর পিছিয়ে দিয়েছিল এবং সেই ধাক্কা বাংলা সিনেমা এখনো কাটিয়ে উঠতে পারেনি।

সালমান শাহদের কখনোই মৃত্যু হয় না, কারণ তাঁরা বেঁচে থাকেন মানুষের হৃদয়ে হাজার বছর ধরে। ওনার মৃত্যুর এত দিন পর এসেও ওনার অভিনীত সিনেমা বা গানের চাহিদা এতটুকু কমেনি। আমি এখনো অবসরে ওনার অভিনীত সিনেমার গান শুনি। এমনকি আরও একটু সময় পেলে পুরো পরিবার নিয়ে বসে যাই ওনার সিনেমা দেখতে।

উনি বাংলাদেশের সিনেমাজগতের একজন ধ্রুবতারা, যিনি আকাশে অবস্থান করেও আলোকিত করেন মানুষের মনকে। ওনার মৃত্যুদিন এলে তাই স্বভাবতই আমাদের প্রজন্মের ছেলেমেয়ে, এমনকি অভিভাবকদের মন খারাপ হয়ে যায়।

আবার তার কিছুদিন পরই আসে ওনার জন্মদিন। তখন আবার এই ভেবে ভালো লাগে যে উনি স্বল্পায়ু হলেও এই বাংলাদেশেই অন্তত জন্মেছিলেন, সেটাই আমাদের সৌভাগ্য। জন্মদিনে স্বল্পায়ু এই মানুষটিকে অন্তরের অন্তস্তল থেকে ভালোবাসা এবং শুভেচ্ছা।

যেখানেই থাকুন ভালো থাকুন হে বাংলাদেশের সিনেমাজগতের ধ্রুবতারা। সালমান শাহর পুরো নাম শাহরিয়ার চৌধুরী ইমন। দেখতে দেখতে তাঁর মৃত্যুর দুই যুগ পেরিয়েছে। আজ তাঁর ২৬তম মৃত্যুবার্ষিকী।