বিবি আমিনার দেশে

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

চলতি শতাব্দীর গোড়ার দিকে কোনো এক গ্রীষ্মের ছুটিতে টেনেনি স্টেট ইউনিভার্সিটি থেকে আরও দুজন সংকর্মীসহ আমি গিয়েছিলাম পূর্ব আফ্রিকার লালমাটির দেশ মালাওয়িতে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল গভর্নমেন্টের একটি অনুদানের অধীনে সে দিন আমাদের আমন্ত্রণ এসেছিল মালাওয়ি ইনস্টিটিউট অফ মেনেজম্যান্ট (এমআইএম) থেকে। এমআইএম তাদের দেশের রাজধানী শহর লিলোংওয়েতে। এটি একটি আধুনিক শিক্ষা ও গবেষণাসংস্থা। গত শতকের শেষদিকে বিশ্বব্যাংকের সাহায্যে গড়ে ওঠে ওই প্রতিষ্ঠানটি। সূচনালগ্ন থেকে এটি মালাওয়ির সরকারি ও বেসরকারি অফিসের কর্মকর্তা এবং এনজিওযুক্ত উন্নয়ন ও সমাজকর্মীদের প্রশাসন ও সুশাসন বিষয়ে নিম্নরে প্রশিক্ষণ দিয়ে যাচ্ছে। তাঁদের এই গুরুত্বপূর্ণ মহৎ উদ্যোগের সাময়িক অংশীজন হিসেবে আমরাও গিয়েছিলাম সেখানে। এর কয়েকজন শিক্ষক-প্রশিক্ষক ও রিসার্চ ফেলোর সঙ্গে যৌথ গবেষণা কাজে সহযোগিতা দিতে।

সফরসঙ্গী ছিলেন আমাদের কলেজের ব্যবসা প্রশাসন বিভাগের অধ্যাপক- ফিস্টাস গুলোরনিও এবং অ্যালেন মিলার। সহকর্মী ফিস্টাস নাইজেরীয় বংশোদ্ভূত। তিনি মালাওয়ি যাওয়ার পথে স্বদেশে আত্মীয়স্বজনদের সঙ্গে দেখা করে যাবেন। তাই, ন্যাশভিল থেকে আমাদের দুই সপ্তাহ আগেই রওয়ানা দিয়েছিলেন। এ জন্য যাওয়ার দিন আমার সঙ্গে ছিলেন শুধুই বন্ধু অ্যালেন। অ্যালেন এবং আমি ন্যাশভিল থেকে ডেট্রয়েট, অ্যামস্টারড্যাম এবং জোহানেসবার্গ হয়ে দুই দিনের পথ পেরিয়ে মালাওয়ির রাজধানী লিলোংওয়েতে পৌঁছাই। আমার এই ভ্রমণ ছিল দীর্ঘদিনের স্বপ্নে লালিত আফ্রিকা দেখার প্রথম সুযোগ। নেদারল্যান্ডসের সবুজ সাগর সৈকত থেকে কয়েক ঘণ্টা উড়ার পর জানালা দিয়ে নিচের দিকে চক্ষু মেলে যখন দেখলাম বালুর সাগর সাহারা মরুভূমি, তখন গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল। উড়ছি তো উড়ছি, সীমাহীন বালুকারাশির কোনো শেষ নেই। ধূসর মরুভূমিরও যে এক অপরূপ রূপমাধুর্য আছে, তা স্বচক্ষে না দেখলে উপলব্ধিতেই আসত না। ৩৫ হাজার ফুট উঁচু থেকে দেখা বালুর পাহাড়, বালুর টিলা, বালুর ক্ষেতে ফণিমনসার ডালপালা মেলা। কী মন ভোলানো দৃশ্যপট। যেন কোনো সফল শিল্পীর হাতে আঁকা সার্থক ছবি। সাহারার বুকে জলহীন শুভ্র বালুপ্রান্তরে শুকনা খাল-নালার আকাবাকা প্রবাহ—সব মিলে বিস্তৃত একখণ্ড জমি। ঘাস নেই। তরুলতা নেই। নেই সবুজের সমারোহ। দেখে দেখে ক্লান্ত দুটি চোখ। ক্লান্ত মন। ঘুমপাড়ানি সোনার স্বপন। বিমান উড়হে পাখির মতো। আমার মনপাখিও ফুটছে যাওয়ায় ভেসে। বাতাসের ঢেউয়ে উড়ছে আকাশে। সারাদিন উড়ে উড়ে অবসন্ন দেহে যখন জোহানেসবার্গ গিয়ে নামলাম, তখন স্থানীয় সময় রাত ১২টা। কোলাহলহীন টার্মিনালে সুনসান নীরবতা। যেন নগরবাসীর সঙ্গে সেও আরামের ঘুম ঘুমোচ্ছে। লিলোংওয়ের ফ্লাইট পরদিন সকালে। অতএব, অগত্যা সেখানেই আমাদের যাত্রাবিরতি, রাতযাপন। এয়ারপোর্ট থেকে হোটেলে যাচ্ছিলাম শাটল বানে। মে মাসের মাঝরাতে থর থর করে শীতে কাঁপতে কাঁপতে। এর আগে পৃথিবীর দক্ষিণ গোলার্ধে আমার যাওয়ার সুযোগ হয়নি। তাই এই অভিজ্ঞতা ছিল একেবারেই আনকোরা। অবাক করা।

দক্ষিণ গোলার্ধের আরেকটি বৈশিষ্ট্য আরও পরিষ্কারভাবে ধরা পড়ল যখন স্বপ্নের দেশ মালাওয়িতে গিয়ে নামলাম। ওই সময় বাংলাদেশে যখন গাছে গাছে আমের গায়ে কাঁচাপাকা রং ধরে, ঠিক তখন মালাওয়িতে দেখলাম সবুজ-শ্যামল আম্রকাননে মাত্র আমের মুকুল এনেছে। ঝাঁকে ঝাঁকে মৌমাছির উদভ্রান্ত ওড়াউড়ি। উন্নত উৎসবের আমেজে অভিসিক্ত তারা। মেঘবিহীন নিখুঁত নীল আকাশের নিচে মৃদুমন্দ দখিনা হাওয়ায় ডালে ডালে মুকুলগুলো দুলছে আর রবিঠাকুরের ভাষায় কানে কানে যেন বলছে–

...আমি তোমায় ডাক দিয়েছি, ওগো বিদেশি (মূল শব্দ উদানী), আমি আমের মারী।

তোমায় চোখে দেখার আগে তোমার স্বপন চোখে লাগে, বেদন জাগে গো- না চিনিতেই ভালোবেসেছি...।

মালাওয়ি যেমন আমাকে না চিনেই ভালোবাসেছে, ঠিক তেমনি আমিও তাকে তযশা মনের না কালো দূর করে দিনের আলোয় ভালোবেসে ফেলেছি। দেশটির মাটি-পানি-জল হাওয়া দেখে মনে হলো- এখানে লাগালে বকুল ফুলও ফুটবে। বাড়িতে বাড়িতে বাগানবিলাসের বাগান তো সাজানো আছেই। চারদিকে যত্রতত্র ছড়িয়ে আছে গাঢ় লাল ও বেগুনি রঙের ফুল-কুঁড়ির মেলা। কোথাও পরগাছার মতো গাছ বেয়ে উঠেছে বাগানবিলাস। কোথাও ঘরের দেওয়াল ঘেঁষে তর তর করে উঠে গেছে হাসে। ঘন সবুজ লতাগুল্মের ডগার বাড়বাড়ন্তের কী নজরকাড়া বাড়াবাড়ি। ছাদেও যেন সে সীমাবদ্ধ থাকতে চায় না। যেতে চায় ছাদ থেকে ছাদে। দূর আকাশে হাত বাড়ায় রূপালি চাঁদের পানে। প্রথম দর্শনেই মালাওয়ির প্রাকৃতিক সৌন্দর্য-বৈচিত্র্যের সাগরে হাবুডুবু খেতে লাগলাম। বিস্মিত ও বিমোহিত হলাম। বাহ্, কী সুন্দর দেশ।

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

২.

যাওয়ার সময় প্রজেক্ট খরচ, স্থানীয় পার্টনারের সম্মানী এবং নিজের হাতখরচ বাবদ নিতে হয়েছিলো নগদ প্রায় চার হাজার ডলারের মতো। সংকর্মী ফিস্টাস, চেক তৈরি হওয়ার আগে চলে যাওয়ায়, তাঁর টাকাগুলোও আমার পকেটে ছিল। টাকা বেশি হওয়ায় নগদ না নিয়ে আমেরিকান এক্সপ্রেস ট্রেভেলারস চেক করে নেওয়ার জন্যে বিশ্ববিদ্যালয় অ্যাকাউন্টস অফিস থেকে বলা হয়েছিল। সরকারি টাকা, তাই সরকারি নির্দেশ শিরোধার্য। আমি আর অ্যালান যে দিন মালাওয়ির লাল মাটি স্পর্শ করলাম, তার পরদিনই ফিস্টাস নাইজেরিয়া থেকে এসে যুক্ত হলেন। মালাওয়ি মুদ্রা (কোয়াচা) আমাদের কারও কাছেই ছিল না। তাহাড়া প্রজেক্ট পার্টনারদের তাদের পারিতোষিক টাকাও বুঝিয়ে দিতে হবে। তাই দেরি না করে ফিস্টাস আনার পরদিনই ট্রেভেলারস চেক ভাঙাবার জন্যে আমরা তিনজনই লিলোংওয়ের সিটি সেন্টারে গেলাম। সঙ্গে স্থানীয় পার্টনার নেলসন। দিনটি ছিল সপ্তাহের শেষদিন অর্থাৎ শুক্রবার। লিলোংওয়ের নগরকেন্দ্র দেখে রীতিমতো হতাশ হলাম। একটি দেশের রাজধানী অথচ বাংলাদেশের যেকোনো উপজেলা শহর থেকেও পেছনে। সারা শহরে একটি মাত্র মাঝারি আকারের পাকা ভবন। দেশের কেন্দ্রীয় সরকারের সচিবালয়।

ট্রেভেলারস চেকগুলো ভাঙানোর জন্যে প্রথমে আমাদের নিয়ে যাওয়া হলো একটি বিদেশি প্রাইভেট ব্যাংকে। ওখানকার গ্রেট ভালো না হওয়ায়, আমরা একে একে কয়েকটা ছোট ছোট দেশি ব্যাংকের রেট জানলাম। তারপর এলাম এক মানি-এক্সচেঞ্জ সেন্টারে। কাচের জানালার পেছনে ছোট্ট একটি ঘর। সিনেমা হলের টিকিট ঘরের মতো। সামনে একটু বসার জায়গা আছে। আমরা সবাই দলবেঁধে জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। ভেতরে দেখলাম দু-তিনজন কর্তব্যরত তরুণী। একজন মাঝবয়সী সুপুরুষ। সম্ভবত তিনিই ব্যবসার মালিক অথবা ম্যানেজার। আমরা কেউই মালাওয়ির আঞ্চলিক ভাষা জানি না। নেলসন আমাদের হয়ে কথা বলছিলেন। শুরুতেই আমরা সব কটি ট্রেভেলারস চেক এবং নিজ নিজ পাসপোর্ট জমা দিলাম। একপর্যায়ে আমাকে বলা হলো, প্রত্যেকটি ট্রেভেলারস চেকের অরিজিনাল রিসিট বের করে দিতে হবে। ন্যাশভিলে যখন ট্রেভেলারস চেক কিনি, তখন আমাকে ব্যাংক টেলার রিসিট দিয়ে বলেছিলেন এগুলো সব যত্নের সঙ্গে চেক থেকে সব সময় আলাদা করে রাখতে, যাতে ট্রেভেলার্স চেক এবং রিসিট কখনো এক সঙ্গে হারিয়ে না যায়। তিনি আরও বলেছিলেন, ট্রেভেলারস চেক ভাঙানোর সময় পাকা রসিদ সঙ্গে করে নিয়ে না দিলে ওই সব দেশে চেক ক্যাশ করতে অসুবিধে হবে।

আমি রিসিটগুলো আলাদা করে যত্নের সঙ্গে রেখেওছিলাম। কিন্তু ওই দিন বেরুবার সময় স্যুটকেস এবং অ্যান্ড ব্যাগে অনেক খোঁজাখুঁজি করে কোথাও জরুরি কাগজগুলোর কোনো হদিস পেলাম না। তখনই বুঝতে পেরেছিলাম, আমি একটা বড় ঝামেলার মধ্যে পড়ে যেতে পারি। মানি-এক্সচেঞ্জ কর্মকর্তাদের অনেক বুঝাবার চেষ্টা করলাম। আমি একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। আমেরিকা থেকে সরকারি কাজে এনেছি। আজ টাকা তুলতে না পারলে আমার অসিবিধে হবে। তোমাদের দেশের লোকদের পাওনা দিতে পারব না। প্রজেক্টেরও ক্ষতি হবে ইত্যাদি। কিন্তু কার কথা কে বুঝে। আর কেই বা শুনে। সব চেষ্টা বিফলে গেল। আমার প্রজেক্ট পার্টনারও নাছোড়বান্দা। অনেক ক্ষণ ধরে তর্কবিতর্ক করলেন। বুঝালেন। অনুনয় বিনয় করলেন। কোনো কিছুতেই কোনো কাজ হলো না। অবশেষে মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল। কী করব, ভেবে পাচ্ছি না।

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

এমন সময় দেখলাম, মানি-এক্সচেঞ্জ অফিসের ভেতর থেকে আমার পাসপোর্ট হাতে নিয়ে কুড়ি-বাইশ বছরের একটি লাজুক মেয়ে সামনে এসে দাঁড়াল। দেখতে মনে হলো ভারতীয় বংশোদ্ভূত। সেই মেয়েটি মালাওয়ি ভাষায় নেলসনের কাছে আমার সম্পর্কে অনেক কিছু জানতে চাইল। নেলসন আমাকে কীভাবে চেনেন? আমি ওখানে কেন গিয়েছি? কোথায় উঠেছি? কতো দিন মালাওয়িতে থাকব? আরও হাজারো কৌতূহলি প্রশ্ন তাঁর। তারপর আমাকে এনে বলল, ‘আপনি কি রিসিটগুলো হারিয়ে ফেলেছেন? লিলোংওয়েতে বাংলা কথা শুনে, মনে হলো আমি যেন আকাশের চাঁদ হাতে পেয়ে গেছি। উত্তর দিলাম, হ্যাঁ, আপনি কী করে বুঝলেন, আমি বাংলাদেশি? মেয়েটির প্রতিভ উত্তর, ‘আপনার পাসপোর্টেই তো লেখা আছে, জন্মস্থান-বাংলাদেশ। তারপর অভয় দিল এই বলে, ‘আপনি আমাকে তুমি করে বলতে পারেন।’ ভাবলাম, বাহ্‌, আমার সমস্যার সমাধান তা হলে হয়েই গেছে। হলোও তা–ই। আমাদের সবাইকে ঝটপট টাকাপয়সা, পাসপোর্ট সব বুঝিয়ে দিল। আমার জন্য মনে হলো অন্যরাও রেট একটু ভালো পেল। তারপর মেয়েটির সঙ্গে একটু ক্ষণ কথা বললাম। আমাকে তার বাড়ি যাওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানাল। নিজের নাম-ঠিকানা ও ফোন নম্বর লিখে একটি চিরকুট হাতে ধরিয়ে দিল। মিষ্টি মেয়েটির নাম—বিবি আমিনা।

অল্প সময়ে তার কাছ থেকে যেটুকু জানতে পারলাম, আর সারসংক্ষেপ এ রকম। আমিনার বাবার নাম আবদুল মান্নান। দেশের বাড়ি বাংলাদেশের নোয়াখালীর সেনবাগ উপজেলায়। পেশায় ইঞ্জিনিয়ার। অনেক বছর আগে এক বিদেশি কোম্পানিতে চাকরি নিয়ে এসেছিলেন অফ্রিকার ভাগ্যের সঙ্গে নিজের ভাগ্যকে বিলীন করে দিতে। কিন্তু বিধি বাম। হঠাৎ কোম্পানি লালবাতি জ্বালিয়ে বন্ধ হয়ে গেল। তবে আত্মপ্রত্যয়ী ও জেদি মান্নান আর দেশে ফেরেননি। শুরু করেন ব্যবসা। দিনে দিনে ব্যবসা তাঁকে ধরা দিল। মালাওয়িতে তিনি একজন সফল ও প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী। সময়ের অভাবে কথা আর বেশি বাড়ালাম না। আসার সময় বুঝলাম, আমিনার দাওয়াত আর দাওয়াত রইল না, দাবিতে পরিণত হয়ে গেল। দৃঢ়তার সঙ্গে বলল, আপনি কাল অবশ্যই আমাদের বাসায় আসছেন। আমি তাকে কথা দিয়ে সবার সঙ্গে মালাওয়ি ইনস্টিটিউট হোস্টেলে ফিরে এলাম।

পরদিন সকলে আমিনার বাবাকে ফোন করলাম। মান্নান সাহেব কথা বলতে বলতে আমাকে নেওয়ার জন্য গাড়িসহ তাঁর ছেলেকে পাঠিয়ে দিলেন, মালাওয়ি ইনস্টিটিউট হোস্টেলে। নিরাপত্তার কারণে আমাদের টিম লিডার মান্নান সাহেবের বাড়িতে আমাকে নাও যেতে দিতে পারেন। জোর করে নিয়ে যেতে চাইলে তিনি আমাকে সন্দেহ করতে পারেন। এই ভয়ে আমি মান্নান সাহেবের ছেলেকে ফিরিয়ে দিলাম। এভাবে ছেলেটিকে নিরাশ করায় আমার ভীষণ খারাপ লেগেছিল। কিন্তু কিছুই করার ছিলো না। নয়-এগারো দুনিয়াটাকে বদলে দিয়েছিল। দিনকাল খারাপ। চারদিকে সব্দের আর সংশয়।

মান্নান সাহেবের সঙ্গে যখন টেলিফোনে কথা বলি তখন আমার মনে হয়েছিল তিনি যেন আমার কত দিনের চেনাজানা মানুষ। কত আপনজন। আফসোস লিলোংওয়েতে মান্নান সাহেবের বাড়িতে আমার যাওয়া হলো না। বিবি আমিনাকে কথা দিয়েও আর আমন্ত্রণ রাখতে পারলাম না। তবে দু-তিন দিন পর, ডেটা কালেকশনে বিদেশে আমার স্বদেশি বন্ধুর ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে যেতে হয়েছিল। দেখেছি তার রমরমা ব্যবসা। তিনি ঘুরে ঘুরে দেখালেন তাঁর বিশাল গুদামঘর। মালসামান থরে থরে সাজানো। মালাওয়ির অন্য শহরেও তার ব্যবসার শাখা অফিস আমার দেখা। মান্নান সাহেব সারা দেশে চাল, ডাল, তেল, আটা, ময়দা, চিনি, সিমেন্ট, রড, ঢেউটিন ইত্যাদির সোল আমদানিকারক ও বিপণনকারী। তিনি মালাওয়ির সবচেয়ে বড় ব্যবসায়ী না হলেও নিঃসন্দেহে তাঁদের অন্যতম। মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিন্টন একবার আফ্রিকা সফরে গিয়ে বলেছিলেন, ‘We should not ask, what can we do FOR Affrica. We should rather ask, what can we do WITH Africa’ মান্নান সাহেব আপন ভাগ্য গড়তে আফ্রিকাতে এসে নিজেই হয়ে গেছেন একজন অতি সংবেদনশীল আফ্রিকান। কথায় কথায় আমাকে বলছিলেন, সাম্প্রতিক দুর্ভিক্ষের বছর তিনি তার খাদ্যগুদামের সদর দরজা ক্ষুধার্থ মানুষের জন্যে একাধিক সপ্তাহব্যাপী উন্মুক্ত করে দিয়েছিলেন। মানুষ লাইন ধরে যার যা প্রয়জন বিনা মূল্যে নিয়ে গেছে। আমি পৃথিবীর আরও অনেক দেশে গিয়েছি। অনেক বাংলাদেশির সঙ্গে দেখা হয়েছে। অনেকের সঙ্গে কথা বলেছি। অনেকের বাড়িতেও গিয়েছি। অনেকের ঘরে খেয়েছি। কারও আথিতেয়তাও গ্রহণ করেছি। কিন্তু কোথাও আরেকজন মান্নান সাহেবের দেখা পাইনি। আরেকজন বিবি আমিনার খোঁজ মেলেনি। বিদেশে বসবাসকারী প্রতিটি বাংলাদেশি পিতা হোক একজন মান্নান। প্রতিটি সন্তান হোক একজন বিবি আমিনা। আজ এটুকুই আমার ঐকান্তিক প্রার্থনা।

লেখক: অধ্যাপক, অর্থনীতি, টেনেসি স্টেট ইউনিভার্সিটি ও এডিটর, জার্নাল অব ডেভেলপিং এরিয়াজ

‘দূর পরবাস’-এ জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]